অর্ণব দাস, বারাকপুর: 'সে আমাদের বাংলাদেশ/ আমাদেরই বাংলা রে...' ছন্দের জাদুকরের এহেন মধুর ছন্দ সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে একেবারেই কেটে গিয়েছে। হাসিনা পরবর্তী জমানায় দুই বাংলার ভ্রাতৃত্বে ভাটা তো পড়েছেই খানিকটা। গত কয়েকদিনে সেই ভ্রাতৃত্বের অভাব আরও স্পষ্ট হল। বন্ধুর টানে বন্ধু-দেশে গিয়ে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে পড়লেন বেলঘরিয়ার যুবক সায়ন ঘোষ। বাংলাদেশ বেড়াতে যাওয়া তাঁর কাছে হয়ে উঠল দুঃস্বপ্ন। শেষে নির্যাতনের শিকার হয়ে শরীরে ক্ষত নিয়ে কোনওক্রমে বাড়ি ফিরলেন। শরীরের সঙ্গে সঙ্গে জীবনেও তাঁর ক্ষতচিহ্ন হয়ে রইল।
গত ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশের ঢাকায় বন্ধুর বাড়িতে ঘুরতে গিয়েছিলেন বেলঘরিয়ার সোনার বাংলা এলাকার বাসিন্দা সায়ন ঘোষ। নিজের দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশি বন্ধুর টানে সেখানে গিয়ে অবশ্য মধুর স্মৃতি নয়, বরং দুঃসহ অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরলেন সায়ন। বেলঘরিয়ার বাড়িতে যখন সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হলেন, তখন তাঁর মাথায়, গালে ব্যান্ডেজ। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে এখনও। কিন্তু মনের কষ্ট তার চেয়ে ঢের বেশি। ওপারে অন্ধকার দৃশ্যগুলো চোখের সামনে যেন ভাসছে।
কী হয়েছিল ঠিক? সায়ন জানাচ্ছেন, কিছু ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে ধ্রুব নামে এক বন্ধুর ডাকে গিয়েছিলেন ঢাকা। সেখানকার বাগানবাড়ি এলাকায় বন্ধুর বাড়িতে ছিলেন। ততক্ষণে ঢাকা বিমানবন্দর থেকে ইসকনের সন্ন্যাসী চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা রুজু করতেই জ্বলে উঠেছে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়। চিন্ময় প্রভুর নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে জনসমাবেশে ছয়লাপ বাংলাদেশের পথঘাট। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পুলিশের দমনপীড়নও। এই পরিস্থিতিতে ২৬ নভেম্বর রাতে সায়নের ফেরার কথা ছিল কলকাতায়। সন্ধেবেলা বন্ধুর সঙ্গে সামনের বাজারে গিয়েছিলেন। আর সেসময়ই অতর্কিত হামলা হয় তাঁর উপর।
সায়নের কথায়, ''প্রথমে কয়েকজন মুসলিম যুবক আমাকে ঘিরে ধরে। জানতে চায় আমার ধর্ম, পরিচয়। আমি জানাই যে ভারত থেকে এসেছি। আমি হিন্দু। তাতেই তারা একেবারে মারমুখী হয়ে ওঠে। আমাকে টানতে টানতে বন্ধুর থেকে আলাদা করে দূরে নিয়ে যায়। আমার পকেট থেকে মোবাইল, টাকা সব বের করে নেয়। তার পর বলতে থাকে, ও ভারতীয় হিন্দু। বলেই প্রথমে মাথায় ইটের টুকরো দিয়ে মারে। তার পর সবাই মিলে মারতে থাকে। আমার বন্ধু ছুটে আসে আমাকে বাঁচাতে। তাঁকেও ওরা আঘাত করে। ওর মোবাইলও হারিয়ে যায়। তবু সে আমাকে মারধর থেকে উদ্ধার করে।'' সায়ন বলছেন, ''রাস্তা দিয়ে লোকজন যারা যাচ্ছিল, তারা আমার পরিচয় হিন্দু, ভারতীয় শুনে তারা আর কেউ আমায় সাহায্য করেনি। বরং মারধরের জন্য কেউ কেউ জুটে গিয়েছিল।''
বন্ধুর সাহায্যে সায়ন হামলা থেকে রক্ষা পেয়ে পুলিশের সাহায্য চান। কিন্তু তাতেও হতাশাই জোটে। সায়ন বলছেন, ''আমি ওখানের পুলিশের এমার্জেন্সি নম্বর ৯৯৯-এ ফোন করি। সবটা বলে সাহায্য চাই। উলটে পুলিশ আমার কাছে জানতে চায়, আমি কেন এখানে এসেছি? বন্ধু কতটা ঘনিষ্ঠ? কী সম্পর্ক? এমনই নানা প্রশ্ন। তার পর পুলিশ বলে, তারা সব তদন্ত করে দেখছে। আমাকে ঘটনাস্থল থেকে চলে যেতে বলে।'' এখানেই ভোগান্তির শেষ নেই। মাথায়, শরীরে আঘাত নিয়ে সায়ন বেসরকারি হাসপাতালে ছুটতে থাকেন। একে একে তিনটি হাসপাতালে মেলেনি চিকিৎসা। শেষে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে চিকিৎসা হয়। মাথায় চারটে, মুখে দুটো সেলাই পড়েছে। মুখের ভিতরে সহ হাত-পায়েও ক্ষত হয়েছে।
এর পর আর সে দেশে থাকার প্রশ্ন নেই। সায়ন বলছেন, "আমাকে আশ্রয় দেওয়ার কারণে ঘটনার পরেরদিন ভোরে বন্ধুর বাড়িতে অনেকে জড়ো হয়ে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে শাসানো হয়েছিল। যতদিন অসুস্থতার কারণে আশ্রয়ে ছিলাম ততদিন একই ঘটনা ঘটেছে। শেষে শনিবার লুকিয়ে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরে আসি।" আঘাত নিয়েই সীমান্ত পেরিয়ে সায়ন ফিরেছেন স্বদেশে। সেখানেও আরেক অভিজ্ঞতা। সায়নকে প্রায় তল্লাশি না করেই দ্রুত ছেড়ে দেওয়া হয় অভিবাসন দপ্তর থেকে। তবে এপারের অভিবাসন, সীমান্তরক্ষী বাহিনী যে তাঁকে সাহায্য করেছে, তা জানান সায়ন। এখানে তিনি বাংলাদেশে আক্রান্ত হওয়া নিয়ে অভিযোগ দায়ের করেছেন। তার ভিত্তিতে তদন্তও শুরু হয়েছে বলে জানান বেলঘরিয়ার যুবক। তাঁর কথায়, "ঢাকায় গিয়ে বুঝেছি, সেখানে সংখ্যালঘুরা সুরক্ষিত নয়। কারণ প্রশাসন কোনও পদক্ষেপ নেয় না। যতদিন পরিস্থিতি ঠিক না হচ্ছে আমার মনে হয় ভারতীয়দের বাংলাদেশে যাওয়া উচিত। সে হিন্দু হোক বা মুসলিম।"
দেখুন ভিডিও: