shono
Advertisement

‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’ জলপাইগুড়ির নিয়ন্ত্রক চা শ্রমিকরাই, এবার কার দখলে এই কেন্দ্র?

এই কেন্দ্রে গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী নিয়ে জোর চর্চা হলেও তৃণমূল ও অন্যান্য বিরোধীদের মুখে কুলুপ।
Posted: 05:43 PM Mar 08, 2024Updated: 01:39 PM Mar 09, 2024

বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য: জঙ্গল ঘেরা ‘দুটি পাতা একটি কুঁড়ি’-র সবুজ গালিচায় মোড়া নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা উত্তরের অন্যতম লোকসভা কেন্দ্র জলপাইগুড়ি (Jalpaiguri)। এখানেই রয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বৃহত্তম শৈবতীর্থ জল্পেশ মন্দির। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাসের পটভূমি ছিল এই এলাকার বৈকুন্ঠপুর জঙ্গল, তিস্তা নদী। সেখানেই একসময় শোনা গিয়েছে সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পদধ্বনি। ঐতিহাসিক দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ওই লোকসভা কেন্দ্রের ছুয়ে গিয়েছে প্রাচীন পৌন্ড্রদেশ ও প্রাগজ্যোতিষপুরের সীমারেখা পুণ্যতোয়া করতোয়া নদী। চিনা পরিব্রাজক হিউয়েন সাং ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দে ওই নদী অতিক্রম করে পৌন্ড্রদেশ থেকে কামরূপে যান। পরবর্তীতে তেভাগা, টানা ভগত-সহ বিভিন্ন আন্দোলনের সাক্ষী থেকেছে আজকের জলপাইগুড়ির মাটি। ১৯৩৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জলপাইগুড়ি শহরে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের অধিবেশন মঞ্চ থেকেই সুভাষচন্দ্র বসু ‘ব্রিটিশ কুইট ইন্ডিয়া’ স্লোগান বেধে দিয়েছিলেন।

Advertisement

চা বাগান ঘেরা কেন্দ্র জলপাইগুড়ি। নিজস্ব চিত্র।

গবেষক মহলে ‘কিরাত ভূমি’ নামে পরিচিত এই এলাকা মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত রাজবংশী তথা কামতাপুরী, রাভা, মেচদের পীঠস্থান হলেও চা বাগানের (Tea Garden) হাত ধরে এখানে ওঁরাও, খেড়িয়া, মুন্ডা ইত্যাদি জনজাতির বসতি গড়ে ওঠে। ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি, রাজগঞ্জ, ডাবগ্রাম–ফুলবাড়ি, মালবাজার এবং কোচবিহারের মেখলিগঞ্জ বিধানসভা নিয়ে এই লোকসভা কেন্দ্র। মালবাজার, ধূপগুড়ি (Dhupguri) বিধানসভা এলাকায় বড় চা বাগান রয়েছে ৭০টি। এখানেই মূলত ওঁরাও, খেড়িয়া, মুন্ডা জনজাতির বসবাস। এছাড়াও ছোট প্রায় ২৫ হাজার ছোট চা বাগান ছড়িয়ে রয়েছে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র জুড়ে। একসময় এলাকার অর্থনীতি দাঁড়িয়ে ছিল চা, কাঠ ও তামাকের উপরে। আশির দশক থেকে সেই ছবি ক্রমশ পালটেছে। চা এবং আলু চাষ হয়ে উঠেছে অর্থনীতির বুনিয়াদ। তবে শুধু কৃষি নয়। সংরক্ষিত জঙ্গল এলাকা এই লোকসভা কেন্দ্রের অন্যতম আকর্ষণ। এখানেই রয়েছে একশৃঙ্গ গণ্ডারের আবাসস্থল গরুমারা জঙ্গল। এছাড়াও রয়েছে চাপরামারি, খুট্টিমারি জঙ্গল। বিস্তীর্ণ জঙ্গল ও জলঢাকা, মূর্তি, ডায়না, চেল, ঘিসের মতো পাহাড়ি নদী ঘেরা লাটাগুড়ি, রামশাই, খুট্টিমারি, মালবাজার এলাকায় গড়ে উঠেছে পর্যটন শিল্প। কালজয়ী ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ উপন্যাসের লেখক সমরেশ মজুমদার এই লোকসভা কেন্দ্রের গয়েরকাঁটা এলাকার বাসিন্দা ছিলেন।

[আরও পড়ুন: ‘হাতজোড় করে মমতাকে বলি, আমাকে ছেড়ে দিন’, ‘অবসর’ নিয়ে বিস্ফোরক চিরঞ্জিত]

ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে কেন্দ্রটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে রয়েছে বাংলাদেশ। অন্যদিকে ভুটান। বরাবর এই লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থীদের ভাগ্য নির্ধারণ করেছে চা বলয়ের ভোট। চা শ্রমিকদের ভোট যে দলের দিকে ঝুঁকেছে, বেশি আসন তাদের দখলে চলে গিয়েছে। এটাই এই আসনের সরল সমীকরণ। চা শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের সুবাদে ১৯৮০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্র ‘লাল দুর্গ’ হিসেবে পরিচিত ছিল। কিন্তু রাজ্যে পালাবদলের পর এখানে বাম শক্তির মারাত্মক অবক্ষয় শুরু হয়। কার্যত বামেদের ভোট ব্যাঙ্ক দখলে নিয়ে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে (Lok Sabha Election) গেরুয়া শিবিরের উত্থান ঘটে। যদিও পরবর্তীতে ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের জেরে তৃণমূল কিছুটা ঘর গোছাতে সক্ষম হয়েছে।

জনবিন্যাস 

জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে মোট ভোটদাতা ১৭ লক্ষ ৩১ হাজার ৮৩৪। তাদের মধ্যে ১১ লক্ষ ৭০ হাজার ৭২০ জন অর্থাৎ ৬৭.০৬ শতাংশ গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা। শহরে বসবাস করেন ৫ লক্ষ ৬১ হাজার ১১৪ জন অর্থাৎ ৩২.০৪ শতাংশ। এর মধ্যে তফসিলি জাতির সংখ্যা ৮ লক্ষ ৫৫ হাজার ৫২৬। অর্থাৎ ৪৯.০৪ শতাংশ। জনজাতি রয়েছে ১ লক্ষ ৩১ হাজার ৬১৯। অর্থাৎ ৭.০৬ শতাংশ। মুসলিম ভোটদাতা রয়েছে ২ লক্ষ ৫৭ হাজার ১৬৭ জন। অর্থাৎ ১৪.০৮ শতাংশ।

নির্বাচনী ইতিহাস

১৯৬২ সাল থেকে কংগ্রেসের দখলে থাকা জলপাইগুড়ি লোকসভা আসনে বামেরা (Left Front) থাবা বসায় ১৯৮০ সালের ভোটে। সিপিএম নেতা সুবোধ সেন সেবার জয়ী হন। এর পর থেকে চা বাগান অধ্যুষিত জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্র উত্তরে ‘লাল দূর্গ’ নামে বেশি পরিচিতি পায়। এই আসনে ৯ দফায় জয়লাভ করেন সিপিএম প্রার্থী (১৯৮০, ১৯৮৪, ১৯৮৯, ১৯৯১, ১৯৯৬, ১৯৯৮, ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৯ সাল)। এর পর তৃণমূল একবার (২০১৪) এবং বিজেপি একবার (২০১৯) জয়লাভ করে। ১৯৯৮ থেকে ২০০৪ তিন দফায় সাংসদ ছিলেন সিপিএমের মিনতি সেন।

প্রাক্তন সিপিএম সাংসদ মিনতি সেন।

কার শক্ত ঘাঁটি, উত্থান কার?

২০০৯ লোকসভা নির্বাচন পর্যন্ত চা বাগান অধ্যুষিত জলপাইগুড়ি লোকসভা আসনে বাম বিরোধীরা এতটুকুও আঁচড় কাটতে পারেনি। ওই বছর নির্বাচনে বামেদের দখলে ছিল ৪৫.৪৯ শতাংশ ভোট। কংগ্রেস পেয়েছিল ৩৬.৯৯ শতাংশ ভোট। মাত্র ৯.১৬ শতাংশ ভোট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে গেরুয়া শিবিরকে। ২০১১ রাজ্যে পালা বদলের ধাক্কায় বাম দূর্গে ফাটল ধরে। চা শ্রমিক সংগঠনে ভাঙন শুরু হয়। গ্রামীণ এলাকায় ব্যাপক সাংগঠনিক ভূমিক্ষয় ঘটে। ক্রমশ শক্তিশালী হতে শুরু করে তৃণমূল। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে ঘাসফুল শিবির ৩৩.০৪ শতাংশ ভোট পেয়ে আসনটি বামেদের থেকে ছিনিয়ে নেয়। বামেদের ভোট কমে হয় ৩৩.০৪ শতাংশ। কংগ্রেসের পরিস্থিতি শোচনীয় হয়। তাদের ভোট কমে দাঁড়ায় মাত্র ৬.৮২ শতাংশ।

[আরও পড়ুন: ‘রামমন্দির উদ্বোধন বিজ্ঞাপন ছাড়া কিচ্ছু না’, কলকাতায় বসে বিস্ফোরক অনুরাগ কাশ্যপ!]

তবে এই সময় থেকেই বিজেপির উত্থান ছিল স্পষ্ট। গেরুয়া শিবিরের ভোট বেড়ে হয় ১৭.২৫ শতাংশ। কার্যত ২০১৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন সমাজ সেবা মূলক কর্মসূচির মাধ্যমে চা বলয়ে বামেদের সাংগঠনিক শক্তি পুরোপুরি কবজা করতে শুরু করে বিজেপি এবং সংঘ পরিবার। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় বাম শ্রমিক সংগঠনগুলো আন্দোলন গড়ে তোলার মতো লোকজন খুঁজে পায়নি। এরই মধ্যে চলে আসে ২০১৯ লোকসভা নির্বাচন। গেরুয়া শিবির বাম ও কংগ্রেসের সাংগঠনিক ভিত তছনছ করে ৫১.২৮ শতাংশ ভোট পেয়ে আসনটি দখলে নেয়। তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোট ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের তুলনায় সামান্য বাড়ে। ২০১৯ নির্বাচনে তাদের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৩৮.৯৫ শতাংশ। সিপিএমের ভোট কমে দাঁড়ায় ৫.১৫ শতাংশ এবং কংগ্রেসের ১.৯৩ শতাংশ। নির্বাচনে ভরাডুবির পর বাম ও কংগ্রেস শিবির ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও পথ খুঁজে পায়নি। যদিও বিজেপি শিবিরে ‘নব্য’ বনাম ‘আদি’ দ্বন্দ্ব চরমে পৌঁছে যায়। দলের পুরনো নেতাদের অনেকেই বসে যান। ওই সুযোগে তৃণমূল ধারাবাহিক রাজনৈতিক কর্মসূচি রেখে সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে শুরু করে। বিশেষত চা বলয়ে বিজেপির শক্তি খর্ব করেই বাড়তে শুরু করে ঘাসফুলের প্রভাব। এখন দেখার ২০২৪ নির্বাচনে সেই প্রভাব কতটা ভোট বাক্সে পড়ে।

সম্ভাব্য প্রার্থী

‘নব্য’ বনাম ‘আদি’ বিবাদের জেরে বিজেপির (BJP) প্রথম দফার প্রার্থী তালিকায় জলপাইগুড়ি আসনের জায়গা হয়নি। ‘আদি’ অর্থাৎ পুরনো বিজেপি কর্মীদের একাংশের সূত্রে ইতিমধ্যে বিকল্প প্রার্থী হিসেবে অ্যাথলেট স্বপ্না বর্মনের নাম সামনে এসেছে। জানা গিয়েছে, এছাড়াও দুলালচন্দ্র রায়, সৌজিত সিংহ, চন্দন বর্মন-সহ দু’জন চিকিৎসক, অধ্যাপক এবং শিক্ষকের নাম রয়েছে।

কালিয়াগঞ্জের বিজেপি বিধায়ক সৌমেন রায় এবারের লোকসভা ভোটে জলপাইগুড়ির সম্ভাব্য প্রার্থী।

এদিকে দলের রাজ্যস্তরের একটি অংশ সদ্য তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়া কালিয়াগঞ্জের বিধায়ক সৌমেন রায়কেও প্রার্থী হিসেবে চাইছেন। যদিও দলের ‘আদি’ নেতা-কর্মীরা তো বটেই। জলপাইগুড়ি জেলা কমিটিও সেই প্রস্তাবে ‘ভেটো’ দিতে ভুলছে না। পাহাড়ের মতো এখানেও ‘ভূমিপুত্র’-কে প্রার্থী করার দাবি জোরাল হয়েছে। দলের বর্তমান জেলা নেতৃত্ব ফের জয়ন্ত রায়কে প্রার্থী হিসেবে চাইছেন। এদিকে বাম শিবিরেও সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে একাধিক নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন অমূল্য রায়, হরিহর বসুনিয়া, মমতা রায়। তৃণমূল শিবির এবারও মুখে কুলুপ এঁটেছেন। 

হালফিলের হকিকত

জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রের অধীনে সাতটি বিধানসভার মধ্যে ২০২১ নির্বাচনে চারটি দখল করে তৃণমূল। ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি ও ডাবগ্রাম-ফুলবাড়ি চলে যায় বিজেপির দখলে। বিধায়কের মৃত্যুর কারণে ২০২৩ উপনির্বাচনে ধূপগুড়ি বিধানসভা আসনটি ফিরে পায় তৃণমূল। লোকসভা কেন্দ্রে চারটি পুরসভা রয়েছে। প্রতিটি তৃণমূলের দখলে। জলপাইগুড়ি জেলা পরিষদের ২৪ আসন এবং ৯টি পঞ্চায়েত সমিতি তৃণমূলের। মোট ৮০টি গ্রাম পঞ্চায়েত রয়েছে। তার মধ্যে ৬৬টিতেই তৃণমূল রয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েতে মোট আসন রয়েছে ১ হাজার ৭০১টি। তার মধ্যে তৃণমূলের দখলে রয়েছে ৯৫৭টি। বিজেপির ৪৩৯টি এবং বামেদের ৬৭টি। টিকিট না পেয়ে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রমন্ত্রী বেসুরো হয়েছেন। বিজেপির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন। এই ঘটনার প্রভাব চা বলয়ে পড়বে। এছাড়াও কামতাপুর পিপলস পার্টি (কেপিপি) এবার লোকসভা নির্বাচনে খোলাখুলি বিজেপির বিরুদ্ধে প্রচারে নেমেছে। সেটাও বিজেপিকে অস্বস্তিতে রাখবে।

জলপাইগুড়ির বিজেপি সাংসদ জয়ন্ত রায় এবারও টিকিট পেতে পারেন।

কে এগিয়ে, কে পিছিয়ে? এলাকার দাগী নেতা কারা?

প্রতিশ্রুতিমতো ধূপগুড়িকে মহকুমা ঘোষণা করেছে রাজ্য সরকার। আর ২০২৪ লোকসভা ভোটে জলপাইগুড়ি লোকসভা কেন্দ্রে তা বড়সড় অস্ত্র হতে পারে। দীর্ঘদিনের ওই দাবি পূরণের ফলে ইতিমধ্যে বিধানসভা উপনির্বাচনে ধূপগুড়ি আসনে তৃণমূলের পাশে দাঁড়িয়েছেন এলাকার বাসিন্দারা। যদিও রামমন্দির উদ্বোধনের আগে এবং পরে গেরুয়া শিবির এখানে যেভাবে ঘরে ঘরে প্রচার চালিয়েছে সেই প্রভাব চা বলয় এবং গ্রামীণ এলাকায় কতটা গভীরতা পেয়েছে, সেটাও এবার দেখার বিষয় বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement
toolbarHome ই পেপার toolbarup রাজধানী এক্সপ্রেস toolbarvideo ISL10 toolbarshorts রোববার