পলাশ পাত্র, তেহট্ট: প্রদীপের নিচেই অন্ধকার৷ ব্রিটিশ আমলে নদিয়ার কর আন্দোলনে প্রথম শহিদ হন সতীশ সর্দার। বুধবার ৮৮তম মৃত্যু দিবসে তাঁকে স্মরণ করা হল। অথচ শহিদ পরিবারের সদস্যদের আজও জনমজুরের কাজ করে দিন গুজরান করতে হয়। এমনকী, বিভিন্ন জায়গায় জানিয়েও তফশিলি শংসাপত্র জোটেনি। আর তাই ক্ষুব্ধ শহিদের উত্তরসূরীরা ঘটা করে মৃত্যুদিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন না৷
[আরও পড়ুন: আলো দেখাচ্ছেন আলোরানি, তাঁর উদ্যোগে বারাসতে বিজেপি থেকে তৃণমূলে ১৩০০ কর্মী]
১৯০২ সালে অবিভক্ত বাংলার তেহট্ট এলাকার চাঁদেরঘাটে জন্মগ্রহণ করেন সতীশ সর্দার৷ সংসারে প্রবল অভাব, অন্যের জমির কাজ দেখাশোনা করতেন। তবে স্বদেশী আন্দোলনে মনপ্রাণ নিমজ্জিত ছিল। ১৯৩২ সালে আইন অমান্যের সময় কর বন্ধের আন্দোলনও চলতে থাকে। নদিয়ার চাঁদেরঘাটে প্রথম ট্যাক্স বন্ধ হয়। ১৯৩২ এর ১৩ এপ্রিল আন্দোলন শুরু হলে প্রথম থেকেই তা দমন করার প্রবল চেষ্টা শুরু করে ব্রিটিশ সরকার৷ গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ বসে। কংগ্রেস ঘাঁটিগুলিতে দিনে দু’বার পুলিশ হানা দিত। স্বেচ্ছাসেবকদের বিভিন্ন ভাবে অত্যাচার করা হত।
এর মধ্যেই ঘোষণা হয়, বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে ১৯ জুন তেহট্টে বড় সভা হবে। সেদিন ১৪৪ ধারা জারি হয়। পুলিশ খেয়া ঘাট, বাস পরিষেবা বন্ধ করে দেয়। কিছুটা দূরে পলাশি বা অন্যান্য রেল স্টেশনে পুলিশ গাড়ি থামা বন্ধ করে দিয়েছিল। তাতেও লোক আসা থামেনি। তেহট্টর সম্মেলনকে সরকার বেআইনি ঘোষণা করে দেয়। সভায় লোক সমাগম দেখে পুলিশ প্রথমে লাঠি ও পরে গুলি চালায়। গুলিতে ওই সভায় থাকা তিরিশ বছরের তরতাজা যুবক সতীশ মারা যান। অনেকেই আহত ও গ্রেপ্তার হন। পুলিশের গুলিতে সতীশ সর্দার মারা যাওয়ার পর কেটে গিয়েছে অনেক বছর। তাঁর নামে একটা প্রাথমিক স্কুল,শহিদ বেদি হয়েছে।
[আরও পড়ুন: কাটমানি ফেরত চাওয়ায় গ্রামবাসীদের লক্ষ্য করে গুলি! জখম মহিলা-সহ ৫]
দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিন্তু সতীশ সর্দারের মতো শহিদকে কেউ মনে রাখেনি। চার মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে সংসার ছিল সতীশের। তাঁর ছেলের নাম শ্যাম সর্দার। তিনিও মারা গিয়েছে। বছর সাতেক আগে সতীশ সর্দারের নাতি নকুল সর্দারেরও মৃত্যু হয়েছে৷ নকুলবাবুর স্ত্রী ভারতী দেবীর বয়স সত্তর ছুঁই।কৃষ্ণনগর থেকে ছ-সাত কিলোমিটার পেরিয়ে পানিনালা নামক গ্রামে এই অগ্নিযুগের বিপ্লবীর পরিবারের বসবাস৷ বাড়িতে বসে ভারতী দেবী বলেন, ‘আগের বছরও সতীশ সর্দারের মৃত্যু দিবসের অনুষ্ঠানে গিয়েছি। আর যাব না। কী হবে গিয়ে?’ ক্ষুব্ধ ভারতী দেবী আরও বলেন, ‘গেলেই ওরা মঞ্চে তোলে। ভাল ভাল কথা বলে, আর পরে কেউ চিনতে পারে না। আমাদের পরিবারে এতদিনে কেউ এসসি সার্টিফিকেট পাইনি। কতবার জানিয়েও কিছু হয়নি।’ অভিমানের সুরে তিনি আরও বলেন, ‘কত বড় মানুষ ছিলেন উনি। দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। কিন্তু কেউ স্বীকার করে না। আমার স্বামী তাই চাঁদেরঘাট গ্রাম ছেড়ে চলে আসেন পানিনালায়। এমনকী, আমরা সর্দার বাদ দিয়ে বাগ পদবিও গ্রহণ করেছি। আমার স্বামীর পর তিন ছেলেও আজ দিনমজুরের কাজ করে। আমরা কোনওরকম সাহায্য পাইনি। এই পরিবারের পড়াশোনাও সে অর্থে কারও হয়নি। সকলেই পঞ্চম, সপ্তম বড়জোড় নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ে পড়াশোনা ছেড়ে দিয়েছে।’ অভাবই যে শিক্ষাগ্রহণের পথে বাধা, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন পরিবারে আপাতত সবচেয়ে বেশি পড়াশোনা করা দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রী জোৎস্না। জোৎস্না বলেন, ‘আমরা দাদুর নাম শুনেছি, তাঁর অবদানও জানি। কিন্তু আমাদের অবহেলা শিকারই হতে হয়েছে।’
সদর মহকুমা শাসকের দায়িত্বে থাকা সৌমেন দত্ত দুঃখ প্রকাশ করেছেন। ওই পরিবারের পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। পলাশিপাড়ার বিধায়ক তাপস সাহার বক্তব্য, ‘ওই পরিবারটির প্রতি আমার সম্মান, শ্রদ্ধা রয়েছে। ওদের পাশেও আছি।’ গত কয়েকবছর ধরে অগ্নিযুগের বিপ্লবী মৃত্যুদিনটি শ্রদ্ধার সঙ্গে পালন করে চাঁদেরঘাট শহিদ সতীশ সর্দার স্মৃতি রক্ষা কমিটি।
The post শ্রদ্ধাজ্ঞাপনই সার, ব্রিটিশ আমলে শহিদের পরিবার সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিতই appeared first on Sangbad Pratidin.
