তন্ময় মুখোপাধ্যায়: তেরো পার্বণে কি আনন্দের ষোলো কলা পূর্ণ হয়? বাঙালির হাব-ভাব বুঝিয়ে দেয় পার্বণের সংখ্যা স্রেফ কথার কথা। উৎসব আসলে অন্তহীন। এই যেমন রাসযাত্রা। যার ঐতিহ্য, অহঙ্কার দুর্গা বা কালীপুজোর থেকে কোনও অংশে কম নয়। উত্তরে কোচবিহার থেকে ভাগীরথীর দু’পার নবদ্বীপ বা শান্তিপুর। কিংবা দক্ষিণের তমলুক বা ঘাটাল। বৃন্দাবন থেকে শ্রীকৃষ্ণের যে লীলা শুরু হয়েছিল তা এখন সর্বজনের।
[আলতাফ মিঞার হাতে গড়া রাসচক্রেই উৎসবের বোধন কোচবিহারে]
কার্তিক পূর্ণিমা। বছরের এই রাতটি বৈষ্ণবদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র, প্রিয়। এরাতেই তাদের প্রাণের উৎসব রাস পালিত হয়। তবে কীভাবে শুরু হল রাসযাত্রা। রাস কথার অর্থই কী। বলা হয় ‘রস’ থেকেই রাসের উদ্ভব। রস অর্থে সার, নির্যাস, আনন্দ, আহ্লাদ, অমৃত ও ব্রহ্ম বোঝায়। ‘তৈত্তিরীয়’ উপনিষদে রস সম্পর্কে বলা হয়েছে “রসো বৈ সঃ’’। অর্থাৎ ব্রহ্ম রস ছাড়া আর কিছুই নন। বৈষ্ণব দর্শনে এই রস বলতে মধুর রসকেই বোঝানো হয়েছে। আর শ্রীকৃষ্ণ হলেন সেই মধুর রসের ঘনীভূত আধার। তাঁকে ঘিরেই রাস। রাস কথাটির আভিধানিক অর্থ হল নারী-পুরুষের হাত ধরাধরি করে মণ্ডলাকারে নৃত্য।
তবে বৈষ্ণবদের কাছে রাস কথাটির অর্থ একটু আলাদা। পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনে শ্রীকৃষ্ণ গোপিনীদের আহ্বান করেন এবং তাদের অহংবর্জিত বিশ্বাসভক্তি ভাবে তুষ্ট হয়ে সঙ্গদান করেন। তাই বৈষ্ণবদের কাছে রাস আসলে ভক্ত এবং ভগবানের মিলন উৎসব। এই উৎসব নিয়ে শ্রীমদভাগবত বলছে রাসে বৃন্দাবনে গোপিনীদের সঙ্গে লীলা করতেন শ্রীকৃষ্ণ। যেখানে পুরুষদের প্রবেশাধিকার ছিল না। দেবাদিদেব মহাদেবের কৌতূহল হয়েছিল কৃষ্ণের কী এমন আকর্ষণ যে সেখানে মহিলারা যান। সেই রসের টানে মহাদেব ছদ্মবেশে গোপিনীদের সঙ্গে রাসঅঙ্গনে প্রবেশ করেন। শ্রীকৃষ্ণ অন্তর্যামী। বুঝতে পারেন অন্য কোনও পুরুষ এসেছেন। মাঝপথে চলে যান শ্রীকৃষ্ণ। ভেঙে যায় রাস।
[নবদ্বীপ, শান্তিপুরের থেকে কেন আলাদা দাঁইহাটের রাসযাত্রা?]
এভাবে রাসের ছন্দ নষ্ট হওয়ায় গোপিনীরা ক্ষুব্ধ হন। তাঁরা রাসঅঙ্গণের পাশে একজন মহিলাকে ঘোমটা দিয়ে অবস্থায় দেখেন। ঘোমটা তুলে মহাদেবকে দেখে তারা অবাক হয়ে যান। এরপর গোপিনীদের রীতিমতো ভর্ৎসনার মুখে পড়েন শিব। গোপিনীরা মহাদেবকে বলেন তোমার জন্য রাস ভেঙে গেল। অপমানিত হয়ে বেরিয়ে যান মহাদেব। বলে যান রস আমি পৃথিবীতে নিয়ে যাচ্ছি। ওখানে সাধারণ মানুষকে রাসদর্শন করাব। সেই থেকে ধরাধামে রাসের প্রসার হয়। রাস নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ সত্যনারায়ণ গোস্বামী। তাঁর কথায়, মহাদেবের অবতার ছিলেন অদ্বৈতাচার্য। যিনি আদতে শান্তিপুরের বাসিন্দা। তাঁর হাত ধরে ভাগীরথীর তীরে এই জনপদে প্রথম রাসের সূচনা হয়েছিল। সেই সময় গুটিকয়েক বাড়িতে কৃষ্ণের বিগ্রহ ছিল। রাস আসলে রাত্রিকালীন উৎসব। অদ্বৈতাচার্যর হাত ধরে রাসের সূচনার তাঁর পৌত্র মথুরেশ গোস্বামীর সৌজন্যে রাস আরও অনেকের কাছে পৌঁছয়। ধীরে ধীরে নবদ্বীপ এবং কাটোয়ার দাঁইহাটে রাসের প্রসার ঘটে। রাজা কৃ্ষ্ণচন্দ্রের উদ্যোগে নবদ্বীপে রাস শুরু হয়।
The post শ্রীকৃষ্ণের রাসলীলা কীভাবে সর্বজনের হল? উৎসবের মাহাত্ম্য কী? appeared first on Sangbad Pratidin.
