সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: ফুটবল মাঠে দাপিয়ে তারপরই রাজনীতিতে। তারপরই তৃণমূলের ব্লক যুব সভাপতি। সেখান থেকেই বাড়াচ্ছিলেন কলকাতা কানেকশন। তরতর করে উঠে আসছিলেন জেলার রাজনীতিতে। আর এই রাজনৈতিক উত্তরণের জোরেই তিনি রেলশহর আদ্রা-র নিয়ন্ত্রক হতে চেয়েছিলেন। নিজের কন্ট্রোলে নিতে চেয়েছিলেন এই রেলশহরকে। শুধু কি রেলওয়ে সিন্ডিকেট? কোল সিন্ডিকেটও! তাই ঝাড়খণ্ডের ধানবাদের ফাহিম খানের 'গ্যাংস অফ ওয়াসেপুর'-র সাহায্য নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারমধ্যেই বাংলা-ঝাড়খণ্ডে রেলের সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা গোষ্ঠী যাদের যোগাযোগ ঝাড়খণ্ডের সিং ম্যানশন-র সঙ্গে। সেই গোষ্ঠীর হাতেই খুন হয়ে যান পুরুলিয়ার কাশিপুর ব্লকের যুব তৃণমূল সভাপতি তথা আদ্রার কাঁটারাঙ্গুনির বাসিন্দা হামিদ আনসারি। যদিও সেই সময় তথ্য-প্রমাণ না থাকায় ক্লোজ হয়ে গিয়েছিল কেস। ৭ বছর পর রি-ওপেন হল অন্য মামলার সূত্র ধরে।
ব্যস, তারপর এই ঘটনার তদন্তে এক এক করে গ্রেপ্তার হলেও মূল ষড়যন্ত্রী-সহ কয়েকজন আড়ালেই থেকে যায়। ফলে আদ্রা থানার ১০৩/১৮ ডেটেড ১৪.১২. ২০১৮-র কেস এফআরটি ( ফাইনাল রিপোর্ট ট্রু ) হয়ে যায়। অর্থাৎ প্রমাণের অভাবে সেই সময়কার মতো ক্লোজ! সাত বছর পর সেই কেসের রি-ওপেন করল পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। কারণ, এই ঘটনার মূল চক্রী পূর্ব ভারতের 'ডন' পিন্টু ঘোষ ওরফে দীপঙ্কর ঘোষ ওরফে ঘোষ দা এখন পুলিশি হেফাজতে। আদ্রা শহর তৃণমূল সভাপতি ধনঞ্জয় চৌবে খুনে ওই বেতাজ বাদশা-সহ ও তাঁর সঙ্গী জুগনু সিং ওরফে ধর্মেন্দ্র সিং পুরুলিয়া জেলা পুলিশের জালে জড়াতেই তৃণমূল নেতা হামিদ আনসারি-সহ মোট ৭ টি ঘটনার ৮ টি খুনের কিনারা হয়ে গেল। যা ২০০৪ সালের ২৬ শে জুন থেকে ২০১৮ সালের ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত রেলের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণের জন্য হয়। সেই সঙ্গে ধৃত পিন্টু ঘোষ, জুগনু সিং-কে জিজ্ঞাসাবাদ করে হামিদ আনসারি খুনে বড়সড় ব্রেক থ্রু পেয়েছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ। সূত্রের খবর, ওই খুনের উত্তরপ্রদেশের তিন শুটারকে চিনিয়ে দিয়েছিল ওই এলাকার এক রাজনৈতিক নেতার আত্মীয়! পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, "২০০৪ থেকে ২০১৮ পর্যন্ত রেলশহর আদ্রা এলাকায় যে সকল খুন হয়েছিল যেগুলোর কিনারা হয়নি। তার সবকটির কিনারা হলো। সেই সঙ্গে হামিদ আনসারি খুনে গুরুত্বপূর্ণ ব্রেক থ্রু মিলেছে। সেগুলি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।"
২০১৮ সালের মাঝ ডিসেম্বর। পুরুলিয়ার রেলশহর আদ্রায় তখন ভরা শীত। তৃণমূলের ওই যুব সভাপতি খুনের আগের রাতে তাঁর এক পরিচিত জনের বাগানবাড়িতে কাটিয়ে গড় পঞ্চকোটের একটি রিসোর্টে যান। রাতেই ফিরে আসেন বাড়ি। সকাল দিকে ছেলেকে স্কুলে পৌঁছে কুকুর কেনার জন্য একটি ফোন আসে। বাইক নিয়ে সেখানে রওনা হন তিনি। তারপর আদ্রার মিশিরডি রেলগেটের কাছে ধৃত জুগনু সিং ও ওই রাজনৈতিক নেতার আত্মীয়কে দেখতে পান। ফলে সঙ্গে সঙ্গে তিনি বাইক ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় রেলগেট পড়ে যায়। তারপরই গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান ওই তৃণমূল নেতা। ধৃত পিন্টু ঘোষের ইশারাতেই খুন হন হামিদ। সুপারি দেওয়া হয় নুন্নু ঠাকুরকে। সিং ম্যানশনের নুন্নু ডনের ইশারাকে কার্যকর করতে বিহারের মজফফরফুর জেলার কাটরা থানার ধনউড়-র জুগনু সিং ওরফে ধর্মেন্দ্র সিং-র সঙ্গে যোগাযোগ করে। উত্তরপ্রদেশ থেকে তিন শুটারকে নিয়ে আসে ওই জুগনু।
এভাবেই রেলের সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণ রাখতে গত দেড় দশকে এই রেলশহর আদ্রায় আটটি খুন হয়। ২০০৪ সালের ২৬শে জুন আদ্রার বেনিয়াশোলে তৎকালীন রঘুনাথপুর থানা এলাকায় জোড়া খুন আদ্রার আশিষ রায় ও আসলাম খান। এরপর ২০০৯ সালের ৯ই জুলাই কাশিপুর থানার অন্তর্গত দক্ষিণ আদ্রায় ওই রেল শহরেরই বাসিন্দা মহম্মদ ইকবাল। ওই বছরের শেষের দিকে ২২ শে ডিসেম্বর কাশিপুর থানার অন্তর্গত আদ্রা ডিআরএম অফিসের সামনে খুন হন ঝাড়খণ্ডের হেমসাগর নায়েক। তারপরই পালটা খুন হন ২০১২ সালের ২ এপ্রিল কাশিপুর থানা এলাকায় ডিআরএম অফিসের সামনে আদ্রার লক্ষ্মণ প্রসাদ। ওই বছরই ২০১২ সালের ২৫শে জুলাই আদ্রার ফাঁড়ির অদূরে খুন হয়ে যান রেল শহরেরই বাসিন্দা শ্যামসুন্দর ধর্মশিখা। তারপর ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই আদ্রা গার্লস স্কুলের পেছনে খুন হয়ে যান ওই রেল শহরের পিন্টু বার্মা। আর তার আড়াই বছর পর হামিদ। এরা সকলেই রেলের সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিহত লক্ষ্মণ প্রসাদ ও পিন্টু বর্মা মামলা ছাড়া সবকটি কেসেরই এফআরটি হয়ে যায়। লক্ষ্মণ প্রসাদ ছাড়া সবকটি মামলাতেই ধৃত পিন্টু জড়িত। তার সঙ্গী জুগনু লক্ষ্মণ ও হামিদ খুনে জড়িত বলে পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। নিহত তৃণমূল নেতা হামিদ আনসারি মামলার যেমন রি-ওপেন হয়েছে তেমন আরও চারটি খুনের মামলারও রি-ওপেন হবে। যেগুলি এফআরটি হয়ে যায় বলে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে। একইসঙ্গে ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর আদ্রার রেলের সিনিয়র ডিএমএফএস অনুপ সরকারকে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। সেই মামলারও রি- ওপেন হবে বলে পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।
