‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ মুক্তির সময় একান্ত আলাপচারিতায় শাশ্বত চট্টোপাধ্যায়। কথোপকথনে বিদিশা চট্টোপাধ্যায়।
কেমন আছেন?
-এই তো সবাই যেমন আছে...
আপনি সবার মতো থাকেন?
-না, আমি মাঝে মাঝে সুযোগ পেলেই বেরিয়ে যাই, বেড়াতে চলে যাই। আবার খানিকটা ভালো থাকার রসদ নিয়ে ফিরে আসি।
‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ আজ মুক্তি পাচ্ছে। এটা তো বেশ অনেকদিন আগেই তৈরি?
-হ্যাঁ, বেশ অনেকদিন আগেই। এবং মুক্তি পাওয়ার কথাও ছিল কয়েক মাস আগে। সেটা আমরা নিজেরাই পিছিয়ে দিই, কারণ সেই সময় শহরে একটা ঘটনা ঘটে। সেই সময়ে মুক্তি পাক আমরা চাইনি।
আপনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে অভিনয় করবেন– এই প্রস্তাবটা কীভাবে আসে আপনার কাছে?
- আমার এখন ঠিক মনে নেই, পরিচালক কৃষ্ণেন্দুই নিয়ে আসে। ওই আমাকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রে অভিনয় করার কথা বলে। এবং মনে পড়ছে, তারও আগে ভানু জেঠুর ছোট ছেলের সঙ্গে একবার আমেরিকায় দেখা হওয়ায় ও বলেছিল, ‘বাবার চরিত্রে তোমাকে মানাবে ভালো, কিছু কিছু অ্যাঙ্গেল থেকে মিল পাই’। পরে ওর বড় ছেলে গৌতমদা, মেয়ে বাসবীদি আমার ওপর আস্থা রাখলেন। তাতে চাপও বাড়ল। কিন্তু চিত্রনাট্য যখন হাতে পেলাম, দেখলাম বেশ মজার। অন্যরকম একটা গল্প। এর আগে দেখেছিলাম ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’। তো সেটা ধরেই গল্প এগোয়, ভানুবাবু এখনও এখানে রয়ে গিয়েছেন। ওই তিন অপ্সরাকে এখনও ওই সহজ নাচটা শিখিয়ে উঠতে পারেননি। এবং ঘটনাচক্রে একজন বৈজ্ঞানিক সেখানে গিয়ে পড়ে। এবং এখানেও দেখা যায়, বিধাতা ভুল করে একজন জ্যান্ত মানুষকে তুলে এনেছে।
এই যে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও জীবন্ত, সেটা অন্যভাবে দেখতে গেলে ভুল নয়, বাঙালির কাছে তিনি আজও বেঁচে আছেন!
- হ্যাঁ, রয়ে গিয়েছেন। সে তো বলাই হয়েছিল, ঈশ্বর বলেন, ‘ভুল করে তুলে এনেছি। আশীর্বাদ করছি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যেন বাঙালির মনে আজীবন বেঁচে থাকে’। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় যে বিরল প্রজাতির বাঙালিকে রিপ্রেজেন্ট করতেন সেই বাঙালি এখন আর নেই...
হ্যাঁ, এখন তো ধুতি আর বাংলা শার্ট পরা বাঙালি পাওয়া যায় না...
- কেবল বাহ্যিক দিকটার কথা বলছি না। সেই মন বা মূল্যবোধের কথা বলছি। এখন তো গ্লোবালাইজেশন হয়ে গিয়ে সকলে একরকম হয়ে যাচ্ছে। আগেকার মূল্যবোধ নেই, সেই কালচারও নেই। এই ছবি দেখলে সেই বাঙালিয়ানার ঝলক পাবে। একটা জিনিস মনে হয়, বাংলার চর্চা হারিয়ে যাচ্ছে তার একটা কারণ মনে হয়, বাংলা মিডিয়াম থেকে পাস করে চাকরি করার কথা কেউ ভাবছে না। হয়তো বাংলা পড়ে কেউ চাকরি পাবে সেই আশা কেউ দেখছে না। এটা একটা কারণ হতে পারে। এখন আর কেউ ছেলেমেয়েকে বাংলা মিডিয়ামে পড়াতে চায় না। আমরাও পড়াইনি। এদিকে আশা করে বসে আছি ‘বাঙালি আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসন লবে’।
‘ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়’ যদি একটা ইমোশন হয়, তাহলে সেটাকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার চ্যালেঞ্জটা কেমন ছিল?
- প্রথমটা হচ্ছে চিত্রনাট্য, সেটা যদি ভালো হয় তাহলে অভিনেতার কাজ অনেকটা সহজ হয়ে যায়। আর যেহেতু আমি সামনাসামনি দেখেছি সেটা অ্যাডভান্টেজ। কিন্তু সিনেমার পর্দায় দর্শক যেভাবে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখেছেন আমি সেভাবেই পোর্ট্রে করার চেষ্টা করেছি। রিয়্যাল লাইফের ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আর রুপোলি পর্দার ভানু তো এক নয়। আর ব্যক্তিগত জীবনে ক’জন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতেন? হাতে গোনা কিছু লোক ছাড়া তো কেউ চিনত না।
আপনি তো পর্দার অভিনেতা এবং বাস্তবের মানুষটা দু’জনকেই চিনতেন। ফারাকটা কেমন জানতে চাই?
- যাঁকে দর্শক অনস্ক্রিন দেখেছেন তাঁকে আমজনতা কমেডিয়ান হিসাবেই চিনেছেন। সিনেমায় তিনি লোককে হাসাচ্ছেন, অদ্ভুতভাবে হাত-পা নেড়ে বাঙাল ভাষায় কথা বলছেন। এবং ব্যক্তিগত জীবনে ভানু জেঠু অত্যন্ত সিরিয়াস ধরনের মানুষ ছিলেন। তিনি সক্রিয় বিপ্লবের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ওঁর অগাধ পড়াশোনা। অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। সিনেমায় যেভাবে ডায়লগ বলতেন, বা কথা বলতেন, বাড়িতে সম্পূর্ণ অন্যভাবে কথা বলতেন।
বিপ্লবের কথা কী বলছিলেন?
- তিনি নাকি থলেতে করে বোমা নিয়ে সাপ্লাই দিয়েছেন।
আপনি কখনও ওঁকে রাগতে দেখেছেন?
-আমার বাবা দেখেছে। একটা সময় ভানু জেঠুকে ডাক্তার মদ্যপান করতে বারণ করে দিয়েছিলেন। এবং ভানু জেঠু খাবেনই। বাবার মুখে শোনা– ‘অমৃতকুম্ভের সন্ধানে’, ট্রেনে শুটিং করতে করতে গিয়েছিল। একটা সময়ের পর বাবা দেখছে যে ভানু জেঠুর কথাগুলো কেমন জড়িয়ে যাচ্ছে। খুঁজে দেখল হেয়ার ড্রেসারের কাছে লুকিয়ে বোতল রাখা। বাবা বোতল সরিয়ে নেয়। ভানু জেঠু রেগে কাঁই। মদ না পেয়ে স্টেশনে নেমে চেয়ারে বসে পড়ে। ‘ওই শুয়ারটা যাইলে আমি যামু না’। হয় বোতল ফেরত দিতে হবে নয় বাবাকে নেমে যেতে হবে। তখনকার মানুষদের মধ্যে এই ভালোবাসার সম্পর্কটাও ছিল। এই যে অন্যকে আমি পর বলে মনে করছি না। আর করছি না বলেই, এইসব কথা বা আবদার করতে পারছি।
এইটা বোধহয় আমরা হারিয়ে ফেলছি ক্রমশ।
- হ্যাঁ, এখন তো পাশাপাশি বসে থাকলেও আমরা গল্প করি না, ফোন দেখি। আড্ডাই দিই না। খালি ক্যালকুলেশন চলছে, নো ইমোশন।
আপনার সঙ্গে কোনও অভিনেতার এমন বন্ধুত্বপূর্ণ স্নেহের সম্পর্ক আছে?
- হ্যাঁ, দু-তিনজনের সঙ্গে আছে বলে মনে করি। যাদের সঙ্গে কাজ করা শুরু করেছিলাম। আমার ওই টেলিভিশনের পর্বটায়। আমাদের এখনও দেখা হলে, আন্তরিকভাবে আড্ডা মারা হয়।
ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগে আপনি উত্তমকুমারের চরিত্রেও অভিনয় করেছেন। অভিনেতা হিসাবে নিজের কোন সত্তাকে উসকে দিতে হয়েছে অভিনয় করতে গিয়ে।
- আমি প্রথমেই ঠিক করে নিয়েছিলাম, এই মানুষটাকে হুবহু নকল করা যাবে না। ঠিক করে নিয়েছিলাম অ্যাটিটিউডটা ধরতে হবে। সেটা করা আমার পক্ষে সহজ ছিল, যেহেতু আমি এদের দেখে বড় হয়েছি। বারংবার একই সিনেমা দেখেছি। বরং ‘মেঘে ঢাকা তারা’ করতে গিয়ে আমাকে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। কারণ আমি ঋত্বিক ঘটককে কোনওদিন দেখিনি। তখন আমি ‘যুক্তি তক্ক গপ্পো’ বারবার দেখেছি। আর ওঁর তৈরি করা ছবি দেখে বোঝার চেষ্টা করেছি ওঁর মনটাকে।
‘উত্তম কুমার’, বা ‘সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়’ বা অন্য কোনও নায়ক-নায়িকার বায়োপিক করলে যেমন হইচই হয় একজন কমেডিয়ানকে নিয়ে ছবি হলে সেই শোরগোলটা হয় না। চিরকালই কমেডি অভিনেতা যেন পিছনের সারিতে...। এই জনারটাই যেন আন্ডারডগ।
- আমাদের এই ছবিতে স্বয়ং ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের চরিত্রের মুখ দিয়ে এটা বলানো হয়েছে (বেশ খানিকক্ষণ চুপ)। কমেডি হল সব থেকে কঠিন অ্যাক্টিং, কারণ বাড়াবাড়ি করলে ওটা ভাঁড়ামোয় চলে যায়। কিন্তু সেটা অত সেলিব্রেটেড হয় না। কমেডি অভিনয় করা বা লেখা শক্ত। কারণ এটা লেখার জন্য যে সহজ, সরল মনটা দরকার হয় সেটা এখনকার মানুষের মধ্যে আর নেই। সমাজ সেটা আর থাকতে দিচ্ছে না। কোনও মানুষ আজকাল সহজ-সরল নয়। আমি কোনও একটা কথা শুনে ভাবি, এটা কেন বলল, কারণ খুঁজতে থাকি। যে কারণে মানুষ ডিটেক্টিভ গল্প এত দ্যাখে। আর এখন তো সবাই ডিটেক্টিভ। আমরা থ্রিলার সিনেমা দেখতে দেখতে, সত্যিকার জীবনে অপরাধীকে ধরে ফেলার চেষ্টা করি। অন্যের জীবন নিয়েও গোয়েন্দাগিরি করার প্রবণতা আমাদের কম নয়। এমনি এমনি কিছু হতে পারে সেটা আর ভাবতেই পারি না।
আপনার মধ্যে এই ‘এমনি-এমনি’ ব্যাপারটা আছে?
- হ্যাঁ, আছে। আমি নিজে খুব হাসিঠাট্টার মধ্যে থাকতে ভালোবাসি। সারাক্ষণ মজা করি। নিজে আনন্দে থাকলে, চারপাশটাও ঠিক লাগে।
আপনার কেরিয়ার জীবনে সবচেয়ে আনন্দ করে কোন কাজটা করেছেন?
- আমি কোন সময়টা সবচেয়ে বেশি এনজয় করেছি জানো? যখন বাবুদার (সন্দীপ রায়) ‘ফেলুদা’ সিরিজটা শুরু করি।
তাই! আচ্ছা...
- হ্যাঁ, কেরিয়ারে সবচেয়ে বেশি এনজয় করেছি ওই শুরুর দিকের পর্বটা মানে যতদিন টেলিভিশন করেছি। যবে থেকে ফিল্ম করা শুরু করলাম তবে থেকে এত রকমের পলিটিক্স ট্যাকল করা শুরু হল যে, সেটা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গিয়েছি। কাজটা ভালো লাগে বলে করে যাই। কিন্তু যতদিন টেলিভিশন করেছি ততদিন আমরা কেউ কারও প্রতিযোগী ছিলাম না। আমরা পরস্পরের সহযোদ্ধা ছিলাম। যে মুহূর্তে তুমি ফিল্মে আসবে– বড় পর্দা, নাম বেশি, সেই মুহূর্ত থেকে কিছু জিনিস কমপ্রোমাইজ করতে হবে। প্রথমেই বন্ধুত্ব কমপ্রোমাইজ করতে হবে। ফিল্মে আসা মানেই তোমার প্রতিযোগী বেড়ে গেল।
তবে সেই সময়ের টেলিভিশনের যুগের সঙ্গে এখনকার মিল নেই।
- এখনকার টিভি ইন্ডাস্ট্রির পরিস্থিতি দেখলে সত্যিই খুব খারাপ লাগে। আমি মনে করি, এখনকার যাঁরা অভিনয় করেন টেলিভিশন সিরিয়ালে তাঁরা আমাদের থেকে অনেক বেশি তৈরি অ্যাক্টর। কারণ আমাদের সময় দেওয়া হত, আমরা কাজ করতে গিয়ে শিখতে পেরেছি, সেই অবকাশ ছিল। এখন শেখার কোনও চান্স নেই। এখন সব রেডিমেড। যার মধ্যে আছে সে করে খাবে। যার মধ্যে নেই, তার একটা সিরিয়াল শেষ হলে, হোর্ডিং শেষ, কেরিয়ার শেষ! সেটা খুবই বিপদের।
প্রায় আঠাশ বছর ধরে অভিনয় করছেন। এখন কি সব চরিত্র জলভাতের মতো হয়ে গিয়েছে! নাকি কেউ চ্যালেঞ্জ করতে পারে?
- না, এখনও মনে করি যে গতকাল ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকেছি।
সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং চরিত্র কোনটা?
- তেমনভাবে অভিনেতা হিসাবে চ্যালেঞ্জ করেছে ‘মেঘে ঢাকা তারা’-য় ঋত্বিক ঘটক-এর চরিত্র। এটাই এখনও পর্যন্ত টাফেস্ট।
বলিউডে অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে কাজ করার পরেও বলছেন?
- হিন্দিতে কাজ করার পরেও বলছি।
আপনি সবসময়ই বলেন যে, পিছনের দিকে তাকান না। প্রায় তিন দশক কাজ করার পর সামনে দিকে তাকালে কী দেখতে পান? বা কী দেখতে চান?
- ভালো স্ক্রিপ্ট। যাতে পাকামো থাকবে না। সহজ সরলভাবে মানুষকে এন্টারটেন করবে। আর পারছি না, ফ্র্যাঙ্কলি বলছি, পাকামি নিতে। আমি মনে করি, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিটা প্রাথমিকভাবে এন্টারটেনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রি। আমার জ্ঞান দিতে যদি হয়, আমি সিনেমা বানাব না। তাহলে সত্যজিৎ রায়ের মতো জ্ঞান দাও। ‘গুপি গাইন...’ যখন ছোটবেলায় দেখছি অন্যরকম লাগছে। বড় বয়সে দেখে মনে হচ্ছে, বাবাহ, এতগুলো কথা বলে গিয়েছে।
আপনার কী মনে হয়, বাংলা সিনেমায় ‘পাকামি’ বেশি...?
- দেখো যেগুলো মন ছুঁয়ে যাচ্ছে সেগুলো চলছে। কিচ্ছু ছিল না মানসী সিনহার ছবিতে, আমি তো বলছি। ‘এটা আমাদের গল্প’-য় ইমোশন ছাড়া আর কিছু ছিল না। একটা ভালো লোকেশন নেই। তাতেই বয়স নির্বিশেষে সবার মন ছুঁয়ে গিয়েছে। ইমোশনালি টাচ না করতে পারলে চলবে না। আমার মনে হয়, ‘যমালয়ে জীবন্ত ভানু’ দর্শকের মন ছুঁয়ে যাবে। হাসাবে তো বটেই...
কাঁদাবেও বলছেন?
- হাল্কা। কারণ ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের তো নিজের কিছু দুঃখ থাকতে পারে। (চুপ করে গিয়ে) একজন অভিনেতার দুঃখ। কেন যমালয় থেকে আর ফিরতে চাইলেন না। কেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়রা আর ফিরতে চান না...
আপনার এমন কোনও দুঃখ আছে?
- না না না.. আমি কোনওরকম দুঃখ পুষি না। ভুলে যাই। মনে রাখি না।
হিন্দিতে কী করছেন?
- অনুরাগ বসুর ‘মেট্রো ইন ডিনো’ শেষ করলাম। আর এবার বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘দিল্লি ফাইলস’ জানুয়ারিতে শুটিং।
এখানেও নেগেটিভ চরিত্র!
ভালো অভিনেতাদের বেছে বেছে খারাপ চরিত্র দেয় তো! (হাসি)