শম্পালী মৌলিক: এ হল বাংলার রিয়েল গ্যাংস্টারের গল্প। ফলে ছবিতে নেই কোনও অবিশ্বাস্য স্টান্ট বা ফাইট সিকোয়েন্স। যা আছে পুরোটাই হাড়হিম করা বাস্তব। এক কুখ্যাত সমাজবিরোধীকে ধরার জন্য পুলিশের ইঁদুর দৌড় দেখার মতো। যে কেবলই আইনের হাত ফসকে বেরিয়ে যায়। বাস্তবের হুব্বা শ্যামল স্থানীয় মস্তান থেকে হয়ে উঠেছিল ‘ডন’। তারই জীবনের আদলে তৈরি ছবি ব্রাত্য বসুর ‘হুব্বা’ মুক্তি পেয়েছে।
পুলিশকর্তা সুপ্রতিম সরকারের ‘আবার গোয়েন্দাপীঠ’-এর একটি কেসকে কেন্দ্র করে ছবির গল্প আবর্তিত হয়েছে। ছবিতে নয়ের দশকে হুগলির ঘুম উড়িয়ে দেওয়া অ্যান্টিসোশ্যালের কার্যকলাপ ধরা আছে। খুন, অপহরণ, ডাকাতি, তোলাবাজি, ড্রাগ পাচার-সহ বিভিন্ন মামলা ছিল তার বিরুদ্ধে। তার শুরুটা কেমন ছিল? কীভাবে সে এলাকার ত্রাস হয়ে উঠল তা সিনেমায় ধরতে গিয়ে ব্রাত্য বসু একেবারে শিকড়ে ফিরে গিয়েছেন। ছবিতে সে ‘হুব্বা বিমল’। তার কম বয়েস, যৌবন এবং পরিণত বয়েস ধরেছেন পরিচালক। হুব্বার মতো অনুতাপহীন খুনি কমই হয়। সে বলে– খুন করার সময় মুখে রক্ত চলকে এলে তার ভালো লাগে! কেন্দ্রচরিত্রাভিনেতার মুখে এমন বক্তব্য পর্দায় দেখতে দেখতে গায়ে কাঁটা দেয়। এ ছেলের বাবা শ্রীদুর্গা কটন মিলে কাজ করত। পাঁচ ভাই-বোন তারা। অভাবের সংসারে হুব্বা ক্লাস সিক্সের গণ্ডি পেরোয়নি। কিন্তু মিলের মজুরগিরি নয়, জটিল পথে দ্রুত উপার্জনের তাগিদ ছিল তার। জানত সাম্রাজ্য বিস্তার করলেই প্রতিষ্ঠা। আর পাঁচজনের মতো সেও কমবয়সে প্রেমে পড়ে, যৌনতায় বাঁধা পড়ে। সে তার সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে হুগলির ধর্মডাঙা, কানাইপুর, রেললাইনের ধার, অ্যালকালির মাঠ, কোন্নগর চত্বর কাঁপিয়ে দেয়। রক্তের নেশায়, ক্ষমতার আস্ফালনে হুব্বা তখন উন্মত্ত। আত্মীয়-পরিজনকে সরিয়ে দিতেও তার হাত কঁাপে না। আবার দানধ্যানও করে। জেল থেকে বেরিয়ে এসে সে অপেক্ষারত প্রেমিকাকেই বিয়ে করে। কিন্তু খুনের আসক্তি, ডনগিরির দুর্মর আকর্ষণ, প্রতিপক্ষ বাঘার সঙ্গে লড়াই, তাকে অবশ করে রাখে। একটি সাধারণ ছেলে কীভাবে অন্ধকার জগতে প্রবেশ করে এবং সেই সময়ের রাজনৈতিক ক্ষমতাধররা কীভাবে তাকে ব্যবহার করে, এবং এক সময় সে যখন ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করতে চায় তাকে ছুড়ে ফেলা হয়। খালে ভেসে ওঠে তার মৃতদেহ। পুলিশি জেরায় হুব্বা বিমলের সেই গল্প উঠে আসে।
[আরও পড়ুন: মুম্বইতে গ্র্যান্ড রিসেপশন আমিরকন্যা ইরা খানের, আমন্ত্রিত নেতামন্ত্রীরা, ২৫০০ অতিথি! ৯ রাজ্যের পদ]
ইংরেজিতে নাম পর্যন্ত সই করতে পারত না হুব্বা, কিন্তু স্ট্রিট স্মার্ট, ম্যানেজ মাস্টার ছিল সে। আর ছিল তার সিনেমা প্রেম। সেই প্রেমের কারণেই সে পুলিশের হাতে ধরা পড়েছিল। তবে পুলিশের চোখে কী করে ধুলো দিতে হয় তা ছিল তার নখদর্পণে। কোন মোবাইল কখন বন্ধ রাখলে পুলিশ তার গতিবিধি টের পাবে না জানা ছিল। শুধু জানা ছিল না বিশ্বাসঘাতক কখন দান ফেলবে।
হুব্বাকো পাকড়না মুশকিলই নেহি, নামুমকিন হ্যায়–মোশাররফ করিমের মুখে এই সংলাপ একেবারে খাপে খাপ। তুখড় পুলিশ অফিসার দিবাকর (ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত) আর হুব্বার দ্বৈরথ ছবির চুম্বকটান। এলাকার ডন আর পুলিশের লড়াই কেমন চাবুক টানটান হতে পারে ইন্দ্রনীল আর মোশাররফের দৃশ্যগুলো দেখিয়ে দিয়েছে। এই পুলিশেরই দাম্পত্য জীবনে কত জটিল বঁাক থাকতে পারে তাও দেখার। হুব্বার গ্যাংয়ের দুই স্তম্ভ বোকারো বাপি (লোকনাথ দে) আর উমেশকে (অনুজয় চট্টোপাধ্যায়) মনে থেকে যাবে। ঠিক যেমন কমবয়সের হুব্বা বিমলের চরিত্রে শিহরন জাগানো অভিনয় করেছেন গম্ভীরা ভট্টাচার্য। পুলিশ দিবাকরের স্ত্রীর চরিত্রে পৌলমী বসু যতটুকু আছেন, অভিনয়ে যথাযথ। হুব্বার প্রথম স্ত্রী তাপসীর চরিত্রে জিনিয়া রায় সপ্রতিভ। দ্বিতীয় স্ত্রী মিতালির ভূমিকায় অস্মিতা মুখোপাধ্যায় ঠিকঠাক। মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় ক্যামিও চরিত্রে সৌমিত্র মিত্র চমক। মলাট চরিত্রে ওপার বাংলার মোশাররফ করিমের মস্তানি এতটাই বিশ্বাসযোগ্য, অবাক হতে হয়। তবু বলতেই হয়, ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত তাঁর সঙ্গে তেজিয়ান টক্কর দিয়েছেন। সৌমিক হালদারের ক্যামেরা চমৎকার। প্রবুদ্ধ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মিউজিক ছবির মেজাজ শুধু ঠিকমতো ধরেইনি, অন্য মাত্রায় উত্তীর্ণ করেছে। শিলাজিৎ চমৎকার কণ্ঠ দিয়েছেন তাঁর তিনটে গানেই। পরিচালক হিসাবে ব্রাত্য বসুর কৃতিত্ব এখানেই যে, তথাকথিত অশিক্ষিত সমাজ থেকে গল্প নিয়ে সেই অন্ধকার জগৎ দেখাতে এতটুকু কৃত্রিমতা আনেননি। হুব্বাদের উত্থান-পতনে সিস্টেমের অবদান এবং তাদের সিস্টেমের পুতুল হয়ে থাকা ধরতেও তিনি দ্বিধা বোধ করেননি নির্দেশক হিসাবে।