কৃশানু মজুমদার: ঘড়ির কাঁটা তখন দুটোর আশপাশে। রাত নেমেছে শহর কলকাতায়। কিন্তু ওদের দেখলে কে বলবে তখন গভীর রাত!
কলকাতার উপকণ্ঠের ‘এক টুকরো ব্রাজিল’ তখন উত্তেজনায় ফুটছে। চলছে উৎসব। দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে রিচার্লিসন (Richarlison) তখন সবেমাত্র ম্যাজিক গোলটি করেছেন। সেই গোলের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে নরেন্দ্রপুরের ওই ফ্ল্যাটে।
সেই গোলের ঘোর কাটেনি শুক্র-দুপুরেও। গৃহকর্তা এডি কারভালহো পরিষ্কার বাংলায় বলে উঠলেন, ”রিচার্লিসন যে গোলটা করেছে, সেটা বিশ্বকাপের সেরা গোল। সার্বিয়া খুবই শক্তিশালী দল। আমরা ২-০ গোলে জিতেছি। দারুণ খুশি আমরা।”
[আরও পড়ুন: শোয়েবের সঙ্গে বিচ্ছেদের গুঞ্জনের মাঝেই সোশ্যাল মিডিয়ায় বিশেষ বার্তা সানিয়ার]
পেলের দেশের একজন পরিচ্ছন্ন বাংলায় কথা বলছেন? এতটা পড়ে অনেকেই অবাক হতে পারেন। এমনটাও কি হয়! এডি ও তাঁর স্ত্রী ডেইসি ব্রাজিলীয় হলেও মননে ভারতীয়। একাধিক ভারতীয় ভাষায় কথা বলতে পারেন। বাংলা জানেন এডি, শিখেছেন হিন্দিও। এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃতও শিখছেন। তাঁর কথা শুনে এই প্রতিবেদক বিস্ময় প্রকাশ করলে এডি হাসতে হাসতে বলেন, ”আমি হিন্দি, বাংলা ভাল জানি। এখন সংস্কৃতে ডিপ্লোমা করছি। সংস্কৃত খুব কঠিন, সবচেয়ে প্রাচীন ভাষাও বটে। আর সংস্কৃত থেকে একাধিক ভারতীয় ভাষার উৎপত্তি।” এখানেও চমক এডির!
ব্রাজিলের পোর্তো ভেলহোর বাসিন্দা এডি। তাঁর স্ত্রী ডেইসি আবার রিওর মানুষ। ব্রাজিলেই দুই জনের দেখাশোনা, বিয়ে। ২০০৬ সালে ফুটবল-স্কুল খোলার স্বপ্ন নিয়ে ব্রাজিল থেকে কলকাতায় চলে আসেন এডি ও ডেইজি। কলকাতা ফুটবলের শহর। আর এডি ফুটবল-পাগল। কোচ হতে চান তিনি। সেই কারণেই ‘ফুটবলের মক্কা’য় তাঁরা। তার পর থেকে আসা যাওয়া চলছিল। ২০১৯ সালে ফের কলকাতায় এসে থাকতে শুরু করেন এডি ও তাঁর স্ত্রী।
প্রাক্তন ব্রাজিলীয় ফুটবলার ডগলাস দ্য সিলভা, হোসে রামিরেজ ব্যারেটো তাঁদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। এই শহরে পা রাখার আগে কলকাতার ফুটবল-প্রেমের কথা শুনেছেন তাঁরা। সেই প্রসঙ্গে এডি বলছিলেন, ”আমরা কলকাতার ফুটবলের কথা শুনেছি। ভরা স্টেডিয়ামে খেলা হয় শুনেছি। কলকাতায় থাকছি অথচ এখনও ডার্বির সময়ে স্টেডিয়ামে যেতে পারিনি। তবে ডার্বির উন্মাদনা আমি জানি। ডার্বির সময়ে কত লোক জড় হয়! সব দেখেশুনে তো আমার ব্রাজিলের কথাই মনে হয়।”
কাতার বিশ্বকাপে (Qatar World Cup 2022) সেই ব্রাজিল প্রথম ম্যাচেই লেটার মার্কস পেয়ে পাশ করেছে। রিচার্লিসনের গোল নিয়ে চর্চা চলছে। সার্বিয়া-ম্যাচের নায়ক প্রসঙ্গে এডি বলছেন, ”রিসার্লিসন (রিচার্লিসনের উচ্চারণ এভাবেই করেন ব্রাজিলীয়রা) বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা গোল করেছে। বিশ্বকাপ শুরুর এক মাস আগে চোট পেয়েছিল। সেই চোট সারিয়ে ফিরে এসে বিশ্বকাপে দুরন্ত গোল, ভাবাই যায় না।”
ব্রাজিলের ফোর্টালিজা থেকে চলে এসেছেন এডির বন্ধু ইয়াগো, স্ত্রী আন্দ্রেজা ও দুই কন্যা-জোয়াও ও এসতিভেন। এডি ও ডেইজির এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলের নাম মার্কাস ভিনিসিয়াস। এডির পছন্দের ফুটবলার ভিনিসিয়াস জুনিয়র। এডির স্ত্রী ডেইজি বলছিলেন, ”মার্কাস নামটা ওর বাবা এডি বেছেছে। আর আমার ভাল লাগে ভিনিসিয়াস। দুটো মিলিয়ে ছেলের নাম মার্কাস ভিনিসিয়াস।”
ভিনিসিয়াস উইংয়ে ঝড় তুলেছেন, রিচার্লিসন জোড়া গোল করলেন। ব্রাজিল ডিফেন্সকে বেশি পরীক্ষা দিতে হয়নি। তিতের দলের সার্বিক পারফরম্যান্সে দারুণ খুশি এডিরা। বৃহস্পতিবার রাত থেকেই তাঁদের বাড়িতে জনসমাগম। বন্ধুরা একসঙ্গে রাত জেগে খেলা দেখেছেন। এদিন এডি বলছিলেন, ”দিনটা আমার জন্য দারুণ বলতে পারেন। কাল ব্রাজিল জিতল। আমার জন্মদিন আজ ২৫ তারিখ। আমার স্ত্রীর জন্মদিন ছিল ২৩ তারিখ আর ইয়াগোর স্ত্রী আন্দ্রেজার জন্মদিন গেল ২১ তারিখ।” এডির স্ত্রী ডেইজি বহুগুণের অধিকারী। হস্তশিল্পে নিপুণা, পার্টি ডেকরেশনেও দক্ষ। আগামী ম্যাচগুলোর জন্য তিতের দলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ডেইজি সুর ধরছেন, ”ব্রাজিল-ব্রাজিল।”
এডির জন্য জন্মদিনের শুভেচ্ছা বর্ষিত হচ্ছে বৃহস্পতিবার রাত থেকেই। সেই সঙ্গে ব্রাজিলের জয়। ‘ডাবল বোনানজা’ বলতে যা বোঝায় আর কী! ভিনিসিয়াস জুনিয়রের ভক্ত এডি বলছেন, ”বৃহস্পতিবার রাত বারোটা দশ নাগাদ বন্ধুরা আমার ফ্ল্যাটে চলে এসেছিল। কেক কাটলাম। খেলা দেখলাম। বন্ধু ইয়াগোর স্ত্রী আন্দ্রেজা ব্রাজিলের রুটি তৈরি করেছিল। কফিতে রুটি ডুবিয়ে খেলাম। সেই সঙ্গে দারুণ একটা ম্যাচ উপভোগ করলাম।”
সংস্কৃতে ডিপ্লোমা পরীক্ষা দিতে এডি বসবেন জানুয়ারিতে। পরীক্ষা দিয়ে উড়ে যাবেন ব্রাজিলে। সেখানে ফুটবল কোচিং কোর্স করছেন। সেই সঙ্গে ফিজিক্যাল ট্রেনিংয়ে গ্র্যাজুয়েশনও চলছে। পুরোদস্তুর ফুটবল কোচ হওয়াই তাঁর স্বপ্ন। এডি বলছেন, ”পাকাপাকিভাবে আমি ফুটবল কোচিংয়ে চলে আসব। ফুটবলই তো ব্রাজিলীয়দের জীবন।”
একটা জাতির শৈশব থেকে বার্ধক্যে জড়িয়ে রয়েছে শুধুই ফুটবল।
হিজাব বিরোধীদের উপর হামলা রক্ষণশীলদের! বিশ্বকাপে ফের বিতর্কে ইরান ম্যাচ