রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়: ঘটনাটা ঘটল যিশুখ্রিস্ট জন্মাবার ৫৬৩ বছর আগে। তিনি এলেন পৃথিবীতে। তাঁর তো জন্মানোর কথা নেপালের কপিলাবস্তুর রাজপ্রাসাদে। কিন্তু তিনি জন্মালেন পথের ধারে শালবনের ঝরা পাতার মধ্যে। অথচ এই ছেলের বাবা শুদ্ধোদন শাক্যরাজ্যের রাজা। থাকেন রাজধানী কপিলাবস্তুর বিলাসবহুল প্রাসাদে। কেন প্রাসাদে না জন্মে শুদ্ধোদনের পুত্র জন্মালেন শাল-অরণ্যের ঝরাপাতার বিছানায়?
কারণ সদ্যোজাত পুত্রের মা মায়াদেবী, যিনি শাক্যরাজ শুদ্ধোদনের স্ত্রী এবং কোল রাজ্য দেবদহের রাজকুমারী – তিনি বাপের বাড়িতে যেতে চাইলেন সন্তানের জন্মের আগে। কিন্তু তা তিনি পারলেন না। পথের ধারে এক শালবনের ঝরা পাতার বিছানায় শুয়ে জন্ম দিলেন তাঁর পুত্রের। এবং মারা গেলেন এক সপ্তাহের মধ্যে। সেই শালবনের কোনও নাম আছে? আছে তো। কপিলাবস্তু থেকে কিছু দূরে লুম্বিনী-র শালবন, সেখানেই জন্ম সিদ্ধার্থর। মাতৃহারা শিশুকে বড় করলেন মাসি ও বিমাতা প্রজাপতি গৌতমী। ছেলেটির তাই নাম রাখা হল সিদ্ধার্থ গৌতম।
কপিলাবস্তু-রাজপ্রাসাদের বিলাস, আনন্দ, উৎসব, উপভোগের মধ্যে বড় হতে লাগলেন সিদ্ধার্থ গৌতম। এক মহাপণ্ডিত জ্ঞানী সাধক ইতিমধ্যে রাজা শুদ্ধোদনের মাথায় একটি ভয় ঢুকিয়ে দিয়ে বিদায় নিলেন। কী সেই ভয়? সিদ্ধার্থ গৌতম যত বড় হবেন, ততই তিনি হবেন জ্ঞানের সন্ধানী! জ্ঞান, প্রজ্ঞা এসব ভারি ভয়ের শব্দ শুদ্ধোদনের কাছে। প্রজ্ঞার অন্বেষ ছেলেকে সন্ন্যাসের পথে নিয়ে যাবে না তো? তাহলে কে করবে বংশরক্ষা? স্ত্রী মায়াদেবীর কথা মনে পড়ে শুদ্ধোদনের। আটদিনের শিশু তার মা মায়াকে হারিয়েছে। শুদ্ধোদন ভাবেন মায়ার এই মৃত্যু প্রতীকী।
সিদ্ধার্থর মায়ার বন্ধন সত্যিই কি কেটে গিয়েছে সে যখন দুধের শিশু? মায়ার বন্ধনে সিদ্ধার্থকে ফিরিয়ে আনার জন্য দু'টি সবথেকে সহজ পথ নিলেন রাজা শুদ্ধোদন। তিনি পরমাসুন্দরী যশোধরার সঙ্গে বিয়ে দিলেন সিদ্ধার্থর। আর রাজপ্রাসাদের মায়ারাজ্যে প্রায় বন্দি করে রাখলেন সিদ্ধার্থকে। গান-বাজনা, সুখ ঐশ্বর্য, ভোগ বিলাস, এরই নাম জীবন। এরই নাম বেঁচে থাকা। জীবনে শুধু নিরবচ্ছিন্ন উপভোগ। জীবনে নেই ব্যাধি, নেই দুঃখ-কষ্ট, নেই মৃত্যু ও বিচ্ছেদ– এই মায়াবাস্তবে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন সিদ্ধার্থ গৌতম। তাঁর একটি পুত্রও হল। রাহুল। নাতির মুখ দেখে বিপুল উৎসবের আয়োজন করলেন রাজা শুদ্ধোদন।
কিন্তু জীবনের বাস্তবকে, পৃথিবীর প্রকৃত চেহারাটাকে পুত্রের কাছ থেকে বেশিদিন সরিয়ে রাখতে পারলেন না তিনি। বন্ধু ছন্দকের উসকানিতেই হয়তো প্রাসাদের বাইরে লুকিয়ে ভ্রমণে বেরলেন সিদ্ধার্থ। ছন্দক পথ চিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁকে। বাস্তব পৃথিবীর পথ চেনেন ছন্দক। সেই পথের শেষে কেমন ওই মানুষ, যার শরীর দুমড়ে-মুচড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়? এই প্রথম ব্যাধির ভয়ংকর চেহারাটা দেখলেন সিদ্ধার্থ। কী মিথ্যার মধ্যে বড় হয়েছেন তিনি! বুঝতে পারলেন এই প্রথম।
[আরও পড়ুন: কীভাবে আয়োজিত হবে পুরীর রথযাত্রা? জানাল প্রশাসন]
পরের দিন ছন্দক আবার ঠিক পথে নিয়ে গেলেন সিদ্ধার্থ গৌতমকে। দেখলেন একটি মৃত মানুষকে। জীবনের পরিণতি, সমস্ত আনন্দ-উৎসবের শেষ তাহলে মৃত্যুতে? যা কিছু জন্মায় তারই মরণ, বিনাশ, লুপ্তি অনিবার্য? পরিত্রাণের উপায় নেই? ছন্দকের কাছে কোনও উত্তর নেই। পরের দিন অন্য পথ ধরে ছন্দক সিদ্ধার্থকে নিয়ে গেলেন এক গভীর ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর কাছে। সিদ্ধার্থ বুঝলেন, এই সাধক বুঝি বা জীবনের দুঃখ-কষ্টের থেকে মুক্তি লাভ করেছেন। ভারি সুন্দর এক দ্যুতি ফুটে উঠেছে সাধকের নীরব ধ্যানমগ্ন চেহারায়!
সমস্ত মায়ার বন্ধন ত্যাগ করে, স্ত্রী যশোধরা, পুত্র রাহুলকে প্রাসাদেই রেখে দিয়ে, সব ভোগ বিলাস আনন্দ উৎসবকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দিয়ে রাতের অন্ধকারে পথে বেরিয়ে পড়লেন সিদ্ধার্থ গৌতম। না, পেতে চান না কোনও ভগবানকে। যে-পৃথিবীতে এত দুঃখ কষ্ট, এত রকমের অসুখ আর নির্যাতন, মানুষের এই বিস্তৃত অসহায়তা আর অনিশ্চয়তা, দুর্ভাগ্যের এসব বিপুল পীড়ন আর যে-পৃথিবীতে মৃত্যু অনিবার্য, কোথায় সেখানে ভগবান? ঈশ্বরের জন্য সংসার ও গৃহত্যাগ করেননি সিদ্ধার্থ গৌতম। তিনি গৃহত্যাগী হলেন নিজের মধ্যে ডুব দিয়ে নিজেকে জানার জন্য। আত্মজ্ঞানের তৃষ্ণা তাঁকে উপড়ে নিয়ে গেল মায়ার সমস্ত বন্ধন থেকে। যিশুখ্রিস্ট জন্মানোর ৫৩৪ বছর আগে ঘটল এই ঘটনা। সিদ্ধার্থ গৌতমের বয়স উনতিরিশ।
পরের ছ’বছর নিরন্তর তপস্যায় তিনি নিজেই হয়ে উঠলেন বোধের আলো। খ্রিস্টপূর্ব ৫২৮ অব্দে, পঁয়তিরিশ বছর বয়সে তিনি হলেন সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ। অর্থাৎ জ্ঞানপ্রাপ্ত। পেয়েছেন সেই পরম প্রজ্ঞা যা তিনি খুঁজছিলেন। কী সেই জ্ঞান? যে-জ্ঞানের প্রধান উদ্দেশ্য জীবনের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট যন্ত্রণা থেকে নিষ্ক্রান্তি! কোন ঈশ্বর বাঁচাবেন আমাদের জীবনের কষ্ট থেকে? জন্ম মানেই তো নির্যাতন। গৌতম বুদ্ধ উত্তর দিলেন, কোথাও কোনও ভগবান নেই। মানুষ বড় একা। মানুষ কাঁদছে। কোনও ভগবান হাত বাড়িয়ে তাঁকে বাঁচাবেন না। মানুষ নিজেই নিজেকে বাঁচাতে পারে। তার সেই ক্ষমতা আছে। মানুষকে শুধু সেই ক্ষমতাকে নিজের মধ্যে জাগ্রত করতে হবে। বুদ্ধপূর্ণিমার (Buddha Purnima) আলোর মতো মানুষের মধ্যে ক্রমশ ফুটে উঠবে সত্যের আলো, নিজেকে জানার আলো, জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তির আলো।
বোধিপ্রাপ্ত হওয়ার পর আরও পঁয়তাল্লিশ বছর বেঁচে ছিলেন গৌতম বুদ্ধ (Gautama Buddha)। এই পঁয়তাল্লিশ বছর ধরে বুদ্ধ প্রচার করে বেড়ালেন তাঁর ধর্ম ও দর্শন, যা পরিচিত হল বৌদ্ধধর্ম নামে। যে ধর্মের কেন্দ্রে নেই কোনও ভগবান। শুধু আছে জীবন-যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার কয়েকটি সম্যক সংকল্প। জীবনের গোড়া থেকেই যেন আমরা চর্চা করি সম্যক দৃষ্টির। অর্থাৎ ভাল-মন্দ কাজকে যেন সঠিকভাবে চিনতে শিখি। যেন কোনও কাজের সঙ্গে জড়িয়ে না থাকে ক্রোধ, হিংসা, স্বার্থ, সংকীর্ণতা, ভ্রান্ত সংস্কার। সব কাজ যেন হয় সমাজ-সংসারের পক্ষে মাঙ্গলিক। আমরা যেন চর্চা করি সম্যক বাক্যের।
অর্থাৎ নিন্দা নয়, কটুকথা নয়, মিথ্যা নয়, কাউকে বাক্যের দ্বারা কষ্ট দেওয়া নয়। আমরা যেন জীবনচর্চার মধ্যে সম্যক কর্মকে স্থান দিই। অর্থাৎ প্রাণীহত্যা নয়, নিষ্ঠুরতা নয়, যুদ্ধ নয়, বিনাশ নয়। আর যেন সম্যক জীবিকার বাইরে না পা ফেলি। অর্থাৎ চুরিজোচ্চুরি করে, প্রতারণা করে, মিথ্যাচরণ করে উপার্জন নয়। সম্যক জীবিকায় শঠতার কোনও স্থান নেই। বুদ্ধদেবের উপদেশ অনুসারে, এই হল জীবনযন্ত্রণা থেকে মুক্তির মার্গ। এক কথায়, জীবনে প্রলোভনের কোনও স্থান নেই। লোভ বা বাসনাই সর্ব দুঃখের কারণ। ত্যাগের মধ্যেই জ্বলে ওঠে ক্রমিক শান্তায়নের আলো।
কোনও ভগবানের আলো নয়। নিজের উপলব্ধি, ধ্যান ও বোধিপ্রাপ্তির আলো। গৌতম বুদ্ধ ৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আশি বছর বয়সে সম্ভবত কোনও বিষাক্ত খাবার খেয়ে গোরক্ষপুরের কুশীনগরে ‘নির্বাণ’ লাভ করেন। আপাতভাবে এই মৃত্যু ছিল যন্ত্রণাময়। তবু হাসিমুখে তাঁর শেষ উচ্চারণ, যা কিছু এই ভুবনে জন্মায়, তাকেই মরতে হয়। সুতরাং মৃত্যুশোক বলে কিছু নেই।
এই ‘তথা’ বা পরম অবস্থার মধ্যে বুদ্ধ ‘গত’ হয়েছিলেন বলে তাঁর নাম হল ‘তথাগত’!