স্টাফ রিপোর্টার: দুর্নীতি করে স্কুল সার্ভিস কমিশন (SSC) মারফত স্কুলে যাঁরা চাকরি পেয়েছেন, তাদের চাকরি যাবেই। সোমবার সাফ এ কথা সাফ জানিয়ে দিলেন কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় (Abhijit Gangopadhyay)। তাঁর কথায়, ‘‘দুর্নীতি প্রমাণ হলে চাকরি যাবেই। যাদের নিয়োগ এখন প্রশ্নের মুখে, তারা যেন কোনওভাবেই নিশ্চিন্তে না থাকেন।’’ এসএসসি মারফত শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে দুর্নীতির একাধিক মামলা অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসেই বিচারাধীন। এই সংক্রান্ত অন্তত ১০টি মামলায় তাঁর নির্দেশেই তদন্তে নেমেছে সিবিআই। গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় (Partha Chatterjee) থেকে শুরু করে আরও একাধিক শিক্ষাকর্তা। কর্মরত বিচারপতি হিসাবে সোমবার দেশে এই প্রথম সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের প্রেক্ষিতে তাঁর ভদ্রতায় আপ্লুত হওয়ার স্বীকারোক্তির পাশাপাশি বিচারপতির প্রতিক্রিয়া, ‘‘তবে শুনেছি উনি খুব রেগে যান।’’ আবার বিচারব্যবস্থার পক্ষপাতের অভিযোগে আঙুল তোলায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে কার্যত হুঁশিয়ারি দিতেও এদিন ছাড়েননি বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। তবে কি রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন? এই প্রশ্নের জবাব এখনই দিতে নারাজ বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘যোগ দিলেও তা দলীয় রাজনীতি নাও হতে পারে। আমার অ্যাজেন্ডা দুর্নীতি। তা নিয়ে টুল পেতে দাঁড়িয়ে নিজের বক্তব্য তো তুলে ধরতেই পারি।’’ এবিপি আনন্দ চ্যানেলে এদিন প্রায় দেড় ঘণ্টার আলাপচারিতায় নিজের অবস্থান স্পষ্ট করে অভিজিৎবাবু জানিয়ে দেন, ‘‘আমি নির্ভীক। আমাকে বিচারব্যবস্থা থেকে বহিষ্কার করলেও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাব। স্কুলে নিয়োগে মুড়ি-মুড়কির মতো দুর্নীতি হয়েছে বলেই মুড়ি-মুড়কির মতো সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিতে হয়েছে। কারণ, একজন করনিকের সেই দায় নেই, কিন্তু একজন শিক্ষকের ছাত্রদের মূল্যবোধ গড়ে তোলার দায় আছে। সেই শিক্ষকই যদি এভাবে নিযুক্ত হন, তো সমাজকে কী দেবেন তাঁরা!’’
[আরও পড়ুন: সাপের কামড়ে মৃত যুবকের দেহ হাসপাতাল থেকে ‘ছিনতাই’ করে ঝাড়ফুঁক, মালদহ মেডিক্যালে উত্তেজনা]
একের পর এক রায়ে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট মহলে সাড়া ফেলে দেওয়া বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় এদিন বলেন, ‘‘টেরর অনেক সময় ইতিবাচক ফল দেয়। অন্তত আমি তো তাই দেখছি। পরপর নির্দেশে ভয় পেয়ে শিক্ষাবিভাগ সংশ্লিষ্ট আধিকারিকরা এখন ঠিকমতো কাজ তো করছেন। বিচারবিভাগ হঠাৎ কড়া হলে, যাঁরা নিয়মে কাজ করছে না, তাঁদের বিপদ। এই বার্তাই দিতে চাইছি।’’ তবে কি পরপর এমন রায় দানের মাধ্যমে নিজের প্রচার এবং ভাবমূর্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যেই এগোচ্ছেন তিনি? সাংবাদিক সুমন দে-র এমন চাঁচাছোলা প্রশ্নের জবাবে বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “আমি আদৌ প্রজেক্টেড হতে চাইছি না। কিন্তু হয়ে যাচ্ছি। যিনিই চেপে ধরবেন, তিনিই এমন হবেন। দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ করেছি। বদলাব না। আরও অভাবনীয় পদক্ষেপও করতে হতে পারে। দুর্নীতি ভারতকে শেষ করে দিয়েছে। তাই সেই দুর্নীতির সঙ্গে কোনও আপস নয়।” আপাত অপ্রাসঙ্গিক অনেক কথা এজলাশে টেনে আনার অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তবে বিচারপতির বক্তব্য, “যাঁর কলার ধরে টেনে আনার কথা বলেছিলাম, পরে তাঁর ঘনিষ্ঠের বাড়ি থেকে টাকা উদ্ধার হয়েছে। পার্থবাবুর কুকুরের জন্য ফ্ল্যাটের কথা প্রোমোটারই আমাকে বলেছিলেন। পরে মিলেও ছিল। এ ধরনের মামলা আমার কাছে থাকলে এমন ঘটনা আরও ঘটবে। আরও টাকা উদ্ধার হবে। আমি বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া এমন সব তথ্যের নিরিখে বিষয়ের আরও গভীর গিয়ে সোশ্যাল জাস্টিস কনসেপ্টে কাজ করি।”
কথায় কথায় আলোচনায় উঠে আসে ক্যানসার আক্রান্ত সোমা দাসের চাকরি, বৃদ্ধা শিক্ষিকা শ্যামলী দেবীর অভিযোগের প্রতিকার থেকে পুজোর আগেই ১৮৭ জনের চাকরির সুপারিশের মতো প্রসঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) সঙ্গে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সাক্ষাৎ হয় তাঁর। কী কথা হল সেদিন? অভিজিৎবাবুর প্রতিক্রিয়া, পরিচয় দেওয়ার পর কথা বলতে চেয়েছিলাম। তবে সেদিন সময় ছিল না। উনি শুধু বললেন, ‘‘আপনিই বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়! আপনি আপনার কাজ করুন। তাঁকে খুব ভদ্র বলে মনে হল। ওঁর কথায় কোনও ক্রুরতা ছিল না।’’ নিয়োগ আন্দোলনে শামিল সোমা দাসকে চাকরি দেওয়া নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর তৎপরতার প্রশংসার পাশাপাশি অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘তবে অনেকের কাছে শুনেছি, উনি খুব রেগে যান।’’ সম্প্রতি বিচারবিভাগের পক্ষপাত নিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে অভিজিৎবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আগেও একবার রুল ইস্যু করে ওঁকে ডেকে পাঠানোর কথা ভেবেছিলাম, করিনি। আমাকে জড়িয়ে এমন মন্তব্য করলেই পদক্ষেপ করব। ডেকে পাঠালে উনি পক্ষপাত প্রমাণ করতে পারবেন না। তিন মাসের জেল হবে। কিছু করতে পারবেন না। বিচারব্যবস্থা কী করতে পারে, এঁদের অনেকেরই সেই ধারণা নেই।’’
[আরও পড়ুন: স্ত্রীর ফোনে মিসড কলের শাস্তি! দলবল নিয়ে যুবককে বেধড়ক মার স্বামীর, অপমানে ‘আত্মঘাতী’ নির্যাতিত]
মিত্র ইনস্টিটিউশন (মেন)-এর ছাত্র অভিজিৎ ডব্লুবিসিএস অফিসার হিসেবে ভূমি রাজস্ব দপ্তরের চাকুরে ছিলেন। কিন্তু, ‘অন্যায় আবদারের সঙ্গে আপস না করে’ সেই চাকরি ছেড়ে তারপর থেকেই আইনি-পেশায়। তবে কফি হাউসের আবহে কলেজবেলার জীবনে জ্ঞানী-গুণী বহু মানুষের সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠাই তাঁর জীবনপথের পাথেয় বলে জানিয়ে অভিজিৎবাবু বলেন, ‘‘পুলিশের উপর বিশ্বাস থাকলেও নিয়ন্ত্রণ তো হয়ই, তাই সিবিআইকে তদন্তের ভার দিয়েছি। আবার তাদের কাজে ধৈর্যশীল থাকতে না পেরে চাপ বাড়ানোর জন্য বলেছি অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলো দেখতে পাচ্ছি না। নড়েচড়ে বসেছে সিবিআই। এখন তাদের পরবর্তী রিপোর্টের অপেক্ষায় আছি।’’ তবে কি রায়দানের ক্ষেত্রে কোনও মাইলফলক রেখে যেতে চান তিনি? বিচারপতির পালটা প্রতিক্রিয়া, “আসলে এমন একটা-দুটো রায়ের নজির রেখে যেতে চাই যা আমার মৃত্যুর পরেও গবেষকদের কাজের জন্য প্রয়োজন হবে, যা নিয়ে আলোচনা হবে।” তাঁর মত, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ঘোড়া কেনাবেচা রুখতে দলত্যাগ আইন বদলের প্রয়োজন নেই। তাঁর কথায়, ‘‘সংশ্লিষ্ট স্পিকাররা দায়িত্বপরায়ণ হলেই এই ফাঁক ভরাট করা যায়।’’ আর বিচারপতির পর্যবেক্ষণ, জুডিশিয়াল ইনফ্রাস্টাকচার কমিশন গড়ার যে কথা চলছে, তার মাধ্যমে বিচারব্যবস্থার পরিকাঠামোগত উন্নতি প্রয়োজন। বাড়াতে হবে বিচারপতির সংখ্যাও। তবেই জমে থাকা মামলার দ্রুত সুরাহা মিলবে।