স্টাফ রিপোর্টার : হিন্দিতে (Hindi) সরকারি কাজের সুপারিশের প্রতিবাদে গর্জে উঠল বাংলা। পথে নেমে জোটবদ্ধ প্রতিরোধের ডাক দিলেন বাংলার শিক্ষাবিদ ও বিদ্বজ্জনরা। তাঁদের দাবি, বিজেপি (BJP) শাসিত কেন্দ্রের এই হিন্দি আগ্রাসন নীতি শুধু বাংলা নয়, সমস্ত ‘অহিন্দি’ রাজ্যগুলির উপর আক্রমণ। যা সংবিধানবিরোধী। আগামী বুধবার বিকেল পাঁচটায় হাজরা মোড়ে কেন্দ্রীয় সুপারিশপত্রের প্রতিলিপি পুড়িয়ে প্রতিবাদসভা করবে ‘বাংলাপক্ষ’। তিনদিন পর রবিবার রাজ্যজুড়ে হবে প্রতিবাদ।
হিন্দি বনাম আঞ্চলিক ভাষা (Regional Language) বিতর্ক নতুন নয়। কংগ্রেস আমলেও এই বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়েছে। কিন্তু এবার হিন্দিকে সরকারি কাজে ব্যবহারের ফরমান সংসদীয় কমিটির সুপারিশ হয়ে পৌঁছে গিয়েছে রাষ্ট্রপতির কাছে। সুপারিশে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রসংঘ থেকে কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, আইআইটিতে শিক্ষাদান, এমনকী হিন্দিভাষী রাজ্যের হাইকোর্ট-সর্বত্র হিন্দি ব্যবহৃত হোক ইংরাজির পরিবর্তে। উল্লেখ্য, সুপারিশের জন্ম দেওয়া সংসদীয় কমিটির নেতৃত্বে খোদ অমিত শাহ (Amit Shah)। যিনি কিছুদিন আগেই দেশের প্রধান ভাষা হিসাবে হিন্দির পক্ষে জোরদার সওয়াল তুলে বিতর্কের মুখে পড়েছিলেন। সম্প্রতি এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যম সুপারিশপত্রের বিষয়টি প্রকাশ্যে এনেছে। তাদের দাবি, গত মাসেই রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর (Droupadi Murmu) কাছে এই সুপারিশপত্র জমা করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। সুপারিশপত্রে বলা হয়েছে: এক, রাষ্ট্রসংঘে ভারতের সরকারি ভাষা হোক হিন্দি। দুই, কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়, আইআইটি, কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের ভাষা হোক হিন্দি। তিন, হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে হাই কোর্টের কাজের ভাষাও করা হোক হিন্দিকে। চার, সরকারি চাকরির পরীক্ষায় বাধ্যতামূলক ইংরেজির জায়গায় এবার থেকে হিন্দি রাখা হোক। পাঁচ, সরকারি বিজ্ঞাপনের ৫০ শতাংশেরও বেশি হোক হিন্দি বিজ্ঞাপন।
[আরও পড়ুন: উৎসবের মরশুম কাটতেই স্বস্তি, গত ২৪ ঘণ্টায় নিম্নমুখী দেশের কোভিড গ্রাফ]
এছাড়াও সুপারিশপত্রে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, কোনও সরকারি কর্মী ও আধিকারিক ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দিতে কাজকর্ম এড়িয়ে গেলে তাঁদের থেকে ব্যাখ্যা চাইতে হবে। উত্তর সন্তোষজনক না হলে বার্ষিক পারফরম্যান্স রিপোর্টে তার উল্লেখ রাখতে হবে। হিন্দি ভাষায় বিশেষ পারদর্শিতা প্রয়োজন এমন কোনও সরকারি পদ তিন বছরের বেশি সময় শূন্য হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট সংস্থার প্রধানকে দায়ী করা হবে। এবং সেটাও তাঁর বার্ষিক পারফরম্যান্স রিপোর্টে উল্লেখ করতে হবে।
এই সুপারিশের আকারে জমা পড়া ফতোয়ার প্রতিবাদেই সরব হয়েছেন বাংলার বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের বক্তব্য, ‘হিন্দু, হিন্দি এবং হিন্দুস্থান’ এই অ্যাজেন্ডাকেই প্রতিষ্ঠা করার প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজেপি শাসিত কেন্দ্রীয় সরকার। যা সফল হওয়া কার্যত অসম্ভব বলেই মনে করছেন ভাষাতত্ত্ববিদ অধ্যাপক পবিত্র সরকার। তাঁর পর্যবেক্ষণ, ‘‘এমন চেষ্টা বিজেপি নিয়ন্ত্রিত কেন্দ্রীয় সরকার বারবার করেছে। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে এটা ফেডারেলিজমের বিরুদ্ধে। আমার মনে হয় না, অহিন্দি রাজ্য, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলি এই সুপারিশ কোনও দিন মানবে। অষ্টম তফসিলে থাকা বাইশটি ভাষাই সমান মর্যাদাসম্পন্ন। রাজ্যকে বাদ দিয়ে এই সুপারিশপত্র কার্যকর করা অসম্ভব।’’ পবিত্রবাবুর বক্তব্য, ‘‘হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে হিন্দিতে কাজ হতেই পারে। কিন্তু অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলি হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত কখনও মেনে নেবে না।’’ পুরাণবিদ নৃসিংহপ্রসাদ ভাদুড়ী একধাপ এগিয়ে বলেছেন, ‘হিন্দু, হিন্দি এবং হিন্দুস্থান’ অ্যাজেন্ডাধারীরা মনে করেন, এই দেশে হিন্দু ছাড়া অন্য কোনও জাতি থাকবে না। ভারতের মতো বহু ভাষাভাষীর বহুত্ববাদী দেশে এই ধরনের ‘ভাষা-সন্ত্রাস’-এর চেষ্টা একনায়কতন্ত্র ছাড়া আর কিছু নয়। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, দেশে ক্রমশ রাজতন্ত্র নেমে আসছে।
[আরও পড়ুন: লড়াই শেষ, প্রয়াত উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মুলায়ম সিং যাদব]
বাংলাভাষার আধিপত্য কায়েমে দীঘদিন ধরেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে ‘বাংলাপক্ষ’। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক গর্গ চট্টোপাধ্যায় এই ‘কালা’ সুপারিশপত্র জ্বালিয়ে দেওয়ার ডাক দিয়েছেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘এই সুপারিশ প্রস্তাব হিন্দি সাম্রাজ্যবাদী দীর্ঘমেয়াদী চক্রান্ত ছাড়া আর কিছু নয়। সুপারিশপত্র পুড়িয়ে বাংলাপক্ষ আগামী বুধবার পথে নামছে। আগামী রবিবার রাজ্যজুড়ে হবে প্রতিবাদ। পাঞ্জাব, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্রের মতো অহিন্দি রাজ্যগুলির সঙ্গে জোট বেঁধে সর্বভারতীয় স্তরে আন্দোলন গড়ে তোলার হুমকি দিয়েছেন গর্গ। মনে করিয়ে দিয়েছেন, ‘‘বাংলা, তামিল, পাঞ্জাবির মতো হিন্দিও একটি আঞ্চলিক ভাষা। এই সুপারিশ শুধুই হিন্দিভাষীদের বাড়তি সুবিধা দেবে। সেটা মেনে নেওয়া যায় না।’’ ভাষা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অভীক মজুমদারও এই কেন্দ্রীয় সুপারিশের বিরুদ্ধে পথে নামার ডাক দিয়েছেন। তাঁর দাবি, ভাষার ভিত্তিতে ভারতের প্রদেশগুলি তৈরি হয়েছে। হিন্দিকে ভারতের সংবিধানে কোনওদিনও রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়নি। সুতরাং এই সুপারিশ সংবিধান বিরোধী।’’ অভীকবাবুর পর্যবেক্ষণ, ‘‘আইআইটির মতো সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে ইংরেজির বদলে হিন্দি বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা সংবিধানের পরিপন্থী। এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই সুপারিশের পিছনে আরএসএস এবং বিজেপির যে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি রয়েছে তা প্রকাশ্যে আনতে হবে।’’