shono
Advertisement
Satyajit Ray Birth Anniversary

কেন আজও সত্যজিৎ রায়ের কোনও যোগ্য উত্তরসূরি নেই বাংলা সিনেমায়?

২ মে বাংলা সিনেমার নবজন্মদাতার জন্মদিন।
Published By: Sandipta BhanjaPosted: 01:40 PM May 02, 2025Updated: 01:40 PM May 02, 2025

নির্মল ধর: ১৯৫৫ সালের ২৬ আগস্ট যদি বাংলা সিনেমার নবজন্মের দিন হয়, তাহলে ১৯২১ সালের ২ মে তারিখটা হচ্ছে সেই নবজন্মদাতার জন্মদিন। বাংলা সিনেমা যাঁর হাত ধরে এখনও পর্যন্ত এগিয়ে চলেছে। সত্যজিৎ রায়ের (Satyajit Ray) চিত্রভাবনাকে ডিঙিয়ে যাওয়ার কোনও দীর্ঘ চেহারার মানুষ এখনও চোখে পড়ছে না। শুধু চিত্র ভাবনা বলছি কেন, তাঁর মতো গভীর সমাজ সচেতনতা, দলীয় রাজনীতির বাইরে দাঁড়িয়ে সোচ্চার এত স্পষ্ট ভাবে রাজনীতির উচ্চারণ, জীবনকে নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার অনুকরণীয় ভঙ্গি, এখন আর দেখছি কোথায়!

Advertisement

আজকের অনেকেই হয়তো বলবেন, পুরনো কাসুন্দি ঘেঁটেই আপনারা প্রবীণরা আনন্দ পান। নতুনদের মধ্যে কোনও প্রতিভা দেখতে পান না! ছবির কারিগরি কৌশল বদলে যাচ্ছে, সমাজের কাঠামো ভেতর থেকে ঘুন ধরে গেছে, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা এখন জীবনকে বিষময় করে তুলছে, এই কঠিন সময়ে আবার একজন সত্যজিৎকে কি সত্যিই দরকার? হ্যাঁ, দরকার, শিরদাঁড়া সোজা রেখে বজ্রগম্ভীর স্বরে যিনি সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলার হিম্মত রাখবেন। কই, এখন এমন একজনও কি কলকাতার ফিল্ম মহলে আছেন, যিনি আজকের অসহনীয় সত্যটাকে সেলুলয়েডে তুলে আনতে পারেন? নেই, দুর্ভাগ্য আমাদের। তাই সত্যজিৎ রায়ের জন্মদিনে দাঁড়িয়ে গভীর হতাশার স্বরে বলতে হচ্ছে – সত্যজিৎ তাঁর কোনও যোগ্য উত্তরাধিকার রেখে যেতে পারলেন না।দায়টা তাঁর নয়, আমাদের। শুরু হয়েছিল বাংলা সাহিত্যের এক ক্লাসিক রচনা বিভূতিভূষণের ‘পথের পাঁচালী’ (Pather Panchali) দিয়ে। ছবিটি শুধু বাংলা সিনেমার প্রকৃতি, চরিত্র, চেহারাই বদলে দেয়নি, বিশ্ব সিনেমার চিরকালীন ক্লাসিক হয়ে আছে এখনও। তাঁর নাতি দীর্ঘ ফিল্মজীবন ছিল সাফল্যের ফলেফুলে ভরা। জীবনের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’ (Agantuk) তিনি বানিয়েছিলেন শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে। কিন্তু তাঁর সেই শেষ সৃষ্টিও ছিল অন্যতম সেরা কাজ। জীবন সায়াহ্নে তিনি তাঁর সারা জীবনের অভিজ্ঞতালব্ধ চেতনা, বোধ ও শিক্ষা দিয়ে আজকের তথাকথিত শিক্ষিত বাঙালির অহংবোধে চপেটাঘাত করে গিয়েছেন। মানুষের নিম্ন মানসিকতা, ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্বার্থপরতার মুখে এক প্রকার ঝামা ঘষে দিয়েছিলেন।

হ্যাঁ, ‘আগন্তুক’ তাঁর সিনেম্যাটিক ভাবনায় নতুন কোনও দিগন্ত খুলে দেয়নি ঠিকই, কিন্তু একজন প্রাজ্ঞ দার্শনিকের ভূমিকা নিয়ে তিনি প্রধান চরিত্রের মাধ্যমে যে আন্তর্জাতিক দর্শন এবং শিক্ষার গর্বে গর্বিত বাঙালির ‘কুপমণ্ডুকতা’র মুখোশটি ছিঁড়ে দিলেন – সেটাও নব্য বাঙালির কাছে এক নবজাগরণের চাইতে কোনও অংশে কম নয়। সত্যজিৎ তাঁর একার চওড়া কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন বাংলা সিনেমাকে প্রাপ্তমনস্ক করে তোলার একক দায়িত্ব। অবশ্যই তিনি সতীর্থ হিসেবে পেয়েছিলেন ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন নামের দু’জন বলিষ্ঠ শিল্পীকে, মাঝে মধ্যে রাজেন তরফদার, হরিসাধন দাশগুপ্ত, পূর্ণেন্দু পত্রীর মত আরও জনকয় মানুষ এসেছিলেন পাশে। কিন্তু বাংলা ছবির ‘ভগীরথ’ ছিলেন তিনিই, একমেবাদ্বিতীয়ম।

গ্রাম্য জীবনের ‘পাঁচালী’ দিয়ে যাত্রা শুরু করে তিনি নাগরিক জীবনেও প্রবেশ করেছেন। কলকাতা শহরকে নিয়ে তাঁর তিনটি ছবি – প্রথম ‘মহানগর’, এক মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্ন ও আশাভঙ্গের কথা বলে ঠিকই, কিন্তু স্বামী-স্ত্রী দুজনে চাকরি হারিয়েও বলে ওঠে “এত বড় শহরে আমাদের একজনেরও একটি কিছু জুটবেনা!”। সেই আশা ও স্বপ্নের ভাঙচুর দেখি কয়েক বছর পর তাঁর কলকাতা ট্রিলজি – ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘সীমাবদ্ধ’ ছবি গুলোয়। কলকাতা শহর তখন নকশালকবারি আন্দোলন মুখরিত, অন্যদিকে বেকারত্বের মিছিল। শিক্ষিত যুবসমাজের কাছে কোনও নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নেই, দিশেহারা সব্বাই। যাঁরা ভাগ্যবান, তাঁদেরও টিকে থাকতে হচ্ছে নানান অমানবিক কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে। প্রাত্যহিক জীবনে দুর্নীতির ঘুন বাসা বাঁধতে শুরু করেছে। সুস্থ জীবন মানুষকে বেঁচে থাকার গ্যারান্টি দিতে পারছে না। এর মধ্যেও সত্যজিৎ দেখিয়েছেন স্বাভাবিক জীবনে উত্তরণের পথ (প্রতিদ্বন্দ্বীর নায়ক শহরের বিষময় পরিবেশ থেকে পালিয়ে বালুরঘাটের নিস্তরঙ্গ জীবনে হারানো পাখির ডাক আবার শুনতে পেয়েছে। আর ‘সীমাবদ্ধ’র নায়ক একটা অনৈতিক কাজের জন্য অনুশোচনায় বিদীর্ণ হয়েছে। কিন্তু ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র তরুণের দল কোনওরকম অপরাধবোধ বা অনুশোচনার তোয়াক্কাই করেনি। সাত ও আটের দশকের এটাই ছিল শহুরে জীবনচিত্র। আবার তিনি যখন নারী-পুরুষের বা স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভাঙার কথা বলেছেন, সেখানে রবীন্দ্রনাথের কাছে হাত পেতে ও একান্ত নিজস্ব ফিল্মি ভাষায় ও ভাবনায় ‘চারুলতা’কে নিজের সেরা সৃষ্টি করে তুলেছেন। ছবি থেকে ছবিতে তিনি বিষয়ে যেমন নতুনত্বের খুঁজেছেন, তেমনি সিনেমার ভাষা, সিনেমার আঙ্গিক ও পরীক্ষার ক্ষেত্রে দুঃসাহিকতার পরিচয় রেখে গিয়েছেন। আজকের দিনেও তা দুর্লভ। বরং বলতে পারি তাঁর দেখানো ও শেখানো পথেই এখনও চলছেন সব্বাই।

সত্যজিৎকে ডিঙিয়ে যাবার সাহস কেউ দেখাতে পারছে না। বরং বলে থাকেন – “উনি আমাদের মাথায় থাকুন, ওঁকে শ্রদ্ধা করি, প্রণাম জানাই, কিন্তু ওঁর মত ছবি করার ক্ষমতা আমাদের নেই!” এটা যাঁরা স্বীকার করছেন, তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি সিনেমা বানানো তো এখন সকলের কাছে নিছক ব্যবসা, বাড়ি গাড়ি বিলাসিতা উপার্জনের পথ। অন্য পাঁচটা ব্যবসার মতো। কোনো শিল্প সৃজন বা সামাজিক দায়িত্ব নয়। সত্যজিতের সব ছবিই যে বাণিজ্য সফল হয়েছে তেমন দাবি তিনি নিজেও কখনো করেননি, প্রযোজকরা তো ননই। মৃণাল সেন এবং ঋত্বিক ঘটকের ক্ষেত্রেও একই মন্তব্য। কিন্তু তাঁরা কখনও পিছিয়ে আসেননি। প্রান্তিক-দলিত মানুষের ওপর উচ্চবর্ণের অবিচার, অত্যাচার নিয়ে সত্যজিত করেছিলেন ‘সদগতি’র মত বিস্ফোরক ছবি, তাও আবার সরকারি দূরদর্শনের টাকায়। আজ কারও অমন সাহস দেখাবার মুরোদ আছে কি? সকলেই তটস্থ চাটুকারিতা আর পদলেহন করায়।

ইতিহাসের পাতায় হাত দিয়েছেন যখন তিনি, তৈরি হয়েছে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’র মতো এক দলিল। অযোধ্যা হাতছাড়া হওয়ার কাহিনির সঙ্গে তিনি কেমন মসৃণভাবে জুড়ে দিয়েছেন দুই দাবাপ্রিয় সরকারি শাসনযন্ত্রের ঘুটিকে। বাদশাহী বিলাসিতায় মগ্ন তাঁরা, এদিকে দেশে রাজদণ্ড হাতে ঢুকে পড়ছে বণিকের দল। ব্যঙ্গের বাণটি তিনি সোজাসুজি লক্ষ্যে চালিয়েছেন। সিনেমার গ্ল্যামার ধোয়া ‘নায়ক’ অরিন্দমকে নিয়ে তাঁর এক মানবিক মুখকেই অনাবৃত করেছেন। ‘মহাপুরুষ কাপুরুষ’ ছবিতে বাজারি ভণ্ড সাধু-সন্তদেরও একহাত নিতে ছাড়েননি। আবার প্রথমদিককার ছবি ‘দেবী’তে প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি আশ্রয় করে ধর্মীয় গোঁড়ামির মূলে কুঠারাঘাত করতেও পিছু হঠেননি।

কোন ছবি ছেড়ে কোন ছবির কথা আর বলব! ‘গণশত্রু’ তাঁর ফিল্ম জীবনের দুর্বলতম ছবি হয়েও বক্তব্যের ভারে নিশ্চিত বেশ ওজনদার। এখানেও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি জিতিয়ে দিয়েছেন যুক্তি, বুদ্ধি ও বিজ্ঞানকে। তাঁর ‘শাখা প্রশাখা’ এখনও যে কতটা সমসাময়িক ভাবলে অবাক হতে হয়। সাংসারিক বৃত্তের মধ্যে দাঁড়িয়েও তিনি পেশাদারি জীবনে সমঝোতা, সাদা-কালো টাকার খেলা নিয়ে কী তীক্ষ্ণ কষাঘাতই না করেছিলেন উচ্চ-মধ্যবিত্ত সমাজকে। আর ঠিক তার বিপরীতে মেজ ছেলে হিসেবে রেখেছিলেন সৌমিত্র (Soumitra Chatterjee) চরিত্রটি। সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে বটে, কিন্তু সাদা-কালো, ভালো-মন্দের ফারাকটা উপলব্ধি করে। যেটা বাড়ির স্বাভাবিক মানুষগুলো করে না। একজন সামাজিক দায়বদ্ধ পরিচালকের কাজই তো এমন ভাবে দর্শকদের সচেতন করা। তিনি ফিল্ম নিয়ে বিপ্লব বা ‘সমাজ কো বদল ডালো’র কাজে তো আর নামেননি। তাছাড়া সত্যি বলতে কী সিনেমা কবে কোন দেশে সমাজকে বদলে দিতে পেরেছে, বিপ্লব এনে দিয়েছে? ছবি যেটা পারে তা হল জনসাধারণকে সচেতন করে তোলা, পরিবর্তনে উদ্বুদ্ধ করা। সত্যজিৎ আমৃত্যু সেই কাজটি নিজের বিশ্বাস, নিজের সাধ্যমতো করেছেন। শুধু সিনেমা নয়, তাঁর লেখা কিশোর সাহিত্য ‘ফেলুদা’ সিরিজ বা প্রফেসর শঙ্কুর কাহিনি আজও বেস্ট সেলার। তাঁরই তৈরি দু’টি মিউজিক্যাল ছবি ‘গুগা বাবা’, ‘হীরক রাজার দেশে’ এখনও বাংলা সিনেমায় দু’টি হীরক খন্ড বিশেষ।

বাংলা সংস্কৃতি জগতে রবীন্দ্রনাথের পর এমন বহুমুখী প্রতিভার দেখা আমরা এখনও পাইনি। ফিল্ম বানানো তো বটেই, কলমে, তুলিতেও তিনি অনবদ্য শিল্পের সম্ভার রেখে গিয়েছেন। খুদে পাঠকদের কাছে তিনি এখনও প্রিয়তম লেখক। ক্যালিগ্রাফি নিয়েও তাঁর অন্বেষণের অন্ত ছিল না। তিনি ‘রে ফন্ট’ তৈরিও করেছিলেন। কিন্তু ফিনিশিং টাচটুকু আর দেবার সময় পাননি। অকালেই চলে গেলেন। আজ জন্মশত বর্ষের সামনে দাঁড়িয়ে তাঁকে বিনম্র প্রণাম জানানো ছাড়া আর কীই বা করতে পারি আমরা! কারণ, আমরা এখন মেরুদণ্ড হারিয়েছি। বিশ্বাস, বোধ জলাঞ্জলি দিয়েছি। জীবনকে এখন ভুবনায়নের নিক্তিতে ওজন করি। পার্থিব লাভ-ক্ষতি ছাড়া অন্য কোনও উদ্দেশ্যই নেই আমাদের। শিল্প, সৃজন? আগে নিজের ব্যাংক ব্যালান্স ঠিকঠাক করাটাই যে কোনও পেশার প্রাথমিক উদ্দেশ্য। শিল্প কি আমাকে গাড়ি-বাড়ি ও আরামের-বিশ্রামের গ্যারান্টি দেবে? যদি সেটা না হয়, তাহলে 'আমি কীইবা করলাম রে!'

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • বাংলা সংস্কৃতি জগতে রবীন্দ্রনাথের পর এমন বহুমুখী প্রতিভার দেখা আমরা এখনও পাইনি।
  • ফিল্ম বানানো তো বটেই, কলমে, তুলিতেও তিনি অনবদ্য শিল্পের সম্ভার রেখে গিয়েছেন।
  • ক্যালিগ্রাফি নিয়েও তাঁর অন্বেষণের অন্ত ছিল না। তিনি ‘রে ফন্ট’ তৈরিও করেছিলেন।
Advertisement