ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের চাষবাস থেকে কম আয়ের পিছনেও মূল কারণ কিন্তু তাঁদের ঋণগ্রস্ততা। একদিকে নগদ অর্থের অভাবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক উৎপাদন ক্ষমতা রাতারাতি বৃদ্ধি করার জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। বন্যা, খরা, জমির লবণাক্ততা ইত্যাদি লেগেই রয়েছে। রাসায়নিক সারের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ কৃষকই তা জোগাড় করতে পারেন না। লিখছেন সুতীর্থ চক্রবর্তী।
২০১০-’১১-র কৃষিশুমারি অনুযায়ী, বাংলায় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক জোতের এলাকা ৮০.৭১ শতাংশ। প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র জোতের সংখ্যা মোট জোতের ৯৫.৯২ শতাংশ। অর্থাৎ প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Mamata Banerjee) ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের ভাতা দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্তের তাৎপর্য কোথায়, তা সহজেই বোধগম্য। মুখ্যমন্ত্রী যখন তাঁর ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের সূচনা করেছিলেন, তখন প্রান্তিক কৃষক বছরে পাঁচ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছিলেন। বিধানসভা ভোটের সময় মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এই ভাতা দ্বিগুণ করা হবে। ভোটের পর তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতিপূরণে পঞ্চাশ দিনও সময় নেননি। ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পে ভাতা বেড়ে বছরে দশ হাজার টাকা হয়ে গিয়েছে।
[আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গে কি ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করবে কেন্দ্রীয় সরকার?]
প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকদের ঘরে ঘরে দ্বিগুণ ভাতার প্রথম কিস্তির টাকা পৌঁছেও গিয়েছে।
অর্থনীতির প্রথাগত আলোচনায় যখনই আমরা এই রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রের সংকটের প্রসঙ্গ দেখি, তখনই মূল সমস্যা হিসাবে যেটি চিহ্নিত হয়, তা হল নগদ অর্থের অভাব। ‘ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে’-র ৭০তম রাউন্ডে দেশের কৃষকের মাসিক আয়ের যে তথ্য মিলেছিল, তাতে দেখা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গের কৃষকের চাষ থেকে আয় খুবই সামান্য। এ রাজ্যের কৃষক পরিবারগুলি যদি গড়ে মাসে চার হাজার টাকা আয় করে, তাহলে সেই পরিবারের সরাসরি চাষবাস থেকে আয় মাত্র হাজার টাকার কাছাকাছি। অন্যত্র শ্রম বেচে পরিবারগুলি দু’হাজার টাকার উপর আয় করে। এর মধ্যে ১০০ দিনের কাজের প্রকল্প থাকে। একেকটি পরিবারের পশুপালন থেকে আয় হয় প্রায় ২২৫ টাকার মতো। এটা-সেটা বাজারে বেচে বা ছোটখাট ব্যবসা করে পরিবারটির আয় হয় মাসে ৬০০ টাকা। কিন্তু পরিবার পিছু গড় ব্যয় ছ’হাজার টাকা। অর্থাৎ মাসে দু’হাজার টাকার এই ঘাটতি কৃষক পরিবারগুলিকে পূরণ করতে হয় ঋণ থেকে। প্রায় প্রতিটি ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের পরিবারই ঋণগ্রস্ত। ফলে সরকারি এই নগদ সাহায্যের তাৎপর্য কোথায়, তা-ও বোধগম্য।
ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের চাষবাস থেকে কম আয়ের পিছনেও মূল কারণ কিন্তু তাঁদের ঋণগ্রস্ততা। একদিকে নগদ অর্থের অভাবে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক উৎপাদন ক্ষমতা রাতারাতি বৃদ্ধি করার জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। বন্যা, খরা, জমির লবণাক্ততা ইত্যাদি লেগেই রয়েছে। রাসায়নিক সারের সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে গেলে বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। অধিকাংশ কৃষকই তা জোগাড় করতে পারেন না। বীজের ক্ষেত্রে নানারকম যে নতুন জাতগুলি দেখা যায়, সেগুলি সবসময় বাস্তবে ফল দেয় না। টাকার অভাবে একদিকে যেমন রাজ্যের এই সমস্ত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক তাঁদের উৎপাদন ক্ষমতা চট করে বৃদ্ধি করতে পারছেন না, তেমনই ফসল ওঠার পর ঋণগ্রস্ততার কারণে তাঁদের দ্রুত সেই ফসল বাজারে বিক্রি করতে হয়। ফলে তাঁদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার-দামও তাঁরা নির্ধারিত করতে পারেন না। ফসল ওঠার পর তাড়াতাড়ি ঋণ শোধের তাড়নায় এঁদের বাজারে গিয়ে চলতি দামেই ফসল বেচে দিতে হয়। ফসল ওঠার সময়, বাজারে অতিরিক্ত জোগানের কারণেই দাম কম থাকে। ওই দামই কৃষককে গ্রহণ করতে হয়।
বাজারে ফসলের কাঙ্ক্ষিত দাম মেলে না বলে কৃষকদের একাংশ চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে।
ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভের নমুনা সমীক্ষা থেকেই আমরা দেখতে পেলাম, পশ্চিমবঙ্গে একটি কৃষক পরিবারের মাসিক আয়ের ক্ষেত্রে সরাসরি চাষ থেকে আয়ের পরিমাণ কতটা কম। ওই তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, বেশ কিছু রাজ্যে এই পরিমাণ যথেষ্ট বেশি। পশ্চিমবঙ্গের একটি কৃষি পরিবার তার মাসিক আয়ের এক-চতুর্থাংশ চাষ থেকে সংগ্রহ করতে না পারলেও রাজস্থানের মতো রাজ্যে কৃষক পরিবারের মাসিক আয়ের অর্ধেক চাষবাস থেকেই আসে। এখন, কৃষকভাতার অতিরিক্ত টাকা কৃষকদের ঋণের বোঝা কমানোর কাজে আসবে। সম্প্রতি কেন্দ্রের পিএম কিষান নিধি প্রকল্পও রাজ্যে লাগু হয়েছে। কেন্দ্রের প্রকল্পের মূল লক্ষ্য অবশ্য মধ্য ও বড় চাষিরা। তবে বাংলার কৃষকের একাংশ টাকা পেতে শুরু করেছে। বাংলার যেসব কৃষক পরিবার দু’টি প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছে, তাদের বছরে সরাসরি এই ভাতার পরিমাণ হচ্ছে বছরে ১৬ হাজার টাকা। অর্থাৎ ওই পরিবারগুলির ঋণের বোঝা অনেকটাই কমবে।
বাম আমল থেকেই রাজ্যের অর্থনীতিতে সংগঠিত ক্ষেত্রের অবদান তলানিতে পৌঁছেছে। একদা বামপন্থী শ্রমিক আন্দোলনের জেরে রাজ্য থেকে শিল্পপুঁজি চলে যাওয়ার যে-ধারা তৈরি হয়েছিল, তা রাতারাতি বদলানো যায়নি। দেশজুড়ে শিল্পক্ষেত্রে যে মন্দা বর্তমানে রয়েছে, তাতে খুব দ্রুত রাজ্যের অর্থনীতিতে সংগঠিত ক্ষেত্রের অবদান বাড়িয়ে ফেলাও সম্ভব নয়। বিপুল কর্মপ্রার্থীকে অসংগঠিত ক্ষেত্রে জায়গা তৈরি করে দিয়েই আপাতত আমাদের এগতে হবে। সেক্ষেত্রে কৃষি ও গ্রামীণ ক্ষেত্রের ভূমিকাই সবচেয়ে বড়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের ভাতা দ্বিগুণ করা তাই এইদিকে একটি অত্যন্ত ইতিবাচক পদক্ষেপ। আমরা দেখলাম, নবান্নে বসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যেদিন তাঁর কৃষকভাতা প্রকল্প দ্বিগুণ করার কথা ঘোষণা করলেন, তার কয়েক মিনিটের মধ্যেই রাজ্যের প্রায় ১০ লক্ষ কৃষকের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে মোট ২৯০ কোটি টাকা পৌঁছে গেল। কোনও কাটমানি বা কমিশনের ব্যাপার নেই। সরাসরি এই টাকা কৃষিক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছল। এখন ‘মাল্টিপ্লায়ার এফেক্ট’-এ এর পরিণতি কতটা, তা বিচার্য।
অর্থনীতিবিদদের একটি দল অতিমারীর গোড়া থেকেই গরিব মানুষের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে সরাসরি টাকা ফেলার কথা বলছে। এক্ষেত্রে কৃষকভাতা সেই উদ্দেশ্যও সাধিত করেছে।
‘কৃষকবন্ধু’ প্রকল্পের একটা সার্বিক প্রভাব রাজ্যের কৃষিক্ষেত্রে পড়ার উজ্জ্বল সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রের চেহারা যদি কিছুটা বদলায়, তাহলে তার সামগ্রিক ছাপ রাজ্যের অর্থনীতিতেও দেখা যাবে। কৃষিক্ষেত্রে আয় বাড়লে সংগঠিত ক্ষেত্রে তার ধাক্কা গিয়ে লাগবে। কারণ, ভোগ্যপণ্যের চাহিদা বাড়বে। সংগঠিত ক্ষেত্রের প্রসার লাভ করলে এবং সেখানে আয় বাড়লে রাজ্যে কর আদায় বাড়বে। রাজ্য তার নিজস্ব রাজস্ব আয় বাড়াতে পারলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে আরও দ্রুত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। ভোটে ধাক্কা খেয়ে বিজেপি যখন রাজ্যকে তিন টুকরো করার পরিকল্পনা কায়দা করে বাজারে ছেড়ে পরিচিতি-সত্তার রাজনীতিকে উসকে দিতে চাইছে, তখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তাঁর জনকল্যাণমূলক প্রকল্পগুলিকে রূপায়ণ করে জনপ্রিয়তার এমন এক শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যাচ্ছেন, যা তাঁর সরকারকে আরও সুস্থিতি দেবে ও নিরাপদ করবে।