গৌতম ব্রহ্ম: কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে এই থেরাপি দেওয়া হয়েছিল। সম্প্রতি বিসিসিআই সভাপতি তথা প্রাক্তন ভারত অধিনায়ককেও এই মনোক্লনাল অ্যান্টিবডি ককটেল থেরাপি দেওয়া হয়েছে। সৌরভ এফেক্ট কিনা জানা নেই, তবে হঠাৎই এই থেরাপির চাহিদা তুঙ্গে। বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে এই থেরাপি চেয়ে ভিড় বাড়ছে। একটি কর্পোরেট হাসপাতাল তো বিজ্ঞাপনই করে ফেলেছে, ককটেল থেরাপি নিয়ে ৬ ঘণ্টায় নেগেটিভ হন। চাহিদা যতই বাড়ুক, চিকিৎসক, গবেষকরা কিন্তু এই থেরাপি নিয়ে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত। ডাক্তারবাবুরা দ্বিখণ্ডিত।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হল, কোভিড চিকিৎসার প্রোটোকল নির্ধারণকারী সংস্থা আইসিএমআর (ICMR) এখনও এই থেরাপিকে তালিকাভুক্ত করেনি। শুধু DGCI জরুরি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়ায় এই ওষুধ ভারতে ছাড়পত্র পেয়েছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা নিয়ে বিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে ডাক্তারদের মনেই। পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নিয়েও রয়েছে আশঙ্কা। ককটেল পাওয়া না পাওয়া নিয়ে একটা সামাজিক বিভেদ সাধারণ মানুষের প্যানিক এক লহমায় বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা অসহায়বোধ তৈরি হয়েছে। এটা কাম্য নয়। চিকিৎসকদের মতে, ককটেল না পেয়েও অধিকাংশ মানুষ সুস্থ হচ্ছেন। সেই তালিকায় অনেক অশীতিপর রোগীও আছেন। সেটাও একটু সামনে আসা প্রয়োজন।
[আরও পড়ুন: Coronavirus Update: প্রায় ৫০% বাড়ল করোনা সংক্রমণ, বাংলায় একদিনে আক্রান্ত ৯ হাজারেরও বেশি]
একদল ডাক্তারের মত, কো-মর্বিড ব্যক্তিরা যদি মৃদু উপসর্গযুক্ত হন তবে এই থেরাপি কাজে লাগবে। রোগী দ্রুত নেগেটিভ হবে। হাসপাতালে ভরতি হওয়ার সম্ভাবনাও এক তৃতীয়াংশ কমায় এই থেরাপি। প্রাণনাশের ঝুঁকি কমায়। অন্য দলের মত, এই থেরাপি নিয়ে যাঁরা সুস্থ হচ্ছেন, তাঁরা এমনিতেও সুস্থ হতেন। অর্থাৎ এই থেরাপি তাঁদের কথায় ‘প্লাসেবো’। আরেক দল চিকিৎসক আবার এক ধাপ এগিয়ে। এই থেরাপির বিপজ্জনক দিকটি তুলে ধরেছেন। জানিয়েছেন, সময়মতো এই অ্যান্টিবডি দেওয়া হলে ভাল। না হলে লাভের থেকে ক্ষতিই বেশি। এই থেরাপি করোনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে দিতে পারে। উৎসাহ দিতে পারে সাইটোকাইন ঝড়কে। তবে একটা বিষয়ে চিকিৎসক মহল একমত। এই থেরাপি সর্বসাধারণের জন্য নয়। কারণ, এর দাম। এই মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির একটি ভায়ালে ২টি ডোজ থাকে। যার দাম ১ লক্ষ ২০ হাজার। কোনও বিমার অন্তর্ভুক্ত নয়। ব্যক্তিগতভাবে টাকা খরচ করে কিনতে হবে।
সোমবার স্বাস্থ্যদপ্তরে কোভিড চিকিৎসার প্রোটোকল নিয়ে ভারচুয়াল বৈঠক হয়। ককটেল থেরাপি নিয়ে আলোচনা হয়। দু’দল চিকিৎসকদের মধ্যে বাদানুবাদ হয়। পরিস্থিতি এতটাই উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যে স্বাস্থ্য অধিকর্তা অজয় চক্রবর্তীকেও হস্তক্ষেপ করতে হয়। তিনি বলেন, “ককটেল থেরাপি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে করতে হয়। না হলে তেমন কাজ হয় না। তাই আইসিএমআর এই পদ্ধতিতে কোভিড রোগীর চিকিৎসায় সায় দেয়নি। রাজ্য স্বাস্থ্যদপ্তর কোভিড রোগীর চিকিৎসায় গত ৩১ ডিসেম্বর ক্লিনিক্যাল প্রোটোকল প্রকাশ করে।সেখানে মলিউনিপিরিভার, মোলনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ককটেল অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু মঙ্গলবার যে নতুন প্রোটোকল প্রকাশ হয়েছে সেখানে বাদ দেওয়া হয়েছে।”
ককটেল অ্যান্টিবডি থেরাপির প্রশংসায় পঞ্চমুখ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অনির্বাণ দলুই। তাঁর মতে, ডেল্টায় আক্রান্ত হলেও ঝুঁকি অনেকটাই কমাতে পারে। তবে দাম বেশি হওয়ায় তা চিকিৎসায় ব্যবহার করা কখনও কখনও কার্যত অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে। তবে এই মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি গবেষণা এখনও সেভাবে করা সম্ভব হয়নি। ভারত-সহ একাধিক দেশে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ট্রায়াল চলছে। তাই এখনই এই ওষুধ ‘অটোমেটিক চয়েস’ বা ‘ড্রাগ অফ চয়েস’ নয়। সাইটোকাইন ঝড় রুখতে এর কোনও কার্যকারিতা নেই বলেই দাবি চিকিৎসক দীপ্তেন্দ্র সরকারের। তাঁর মতে, ককটেল থেরাপি আক্রান্ত হওয়ার পাঁচদিনের মধ্যে কার্যকর। করোনা রোগী যদি ওমিক্রন স্ট্রেনে আক্রান্ত না হন, সেক্ষেত্রে ককটেল থেরাপির আবার কোনও কার্যকারিতাই নেই। ১৮ বছর বয়সের চেয়ে কম রোগীদের এই থেরাপি দেওয়া সম্ভব নয়। ষাটোর্ধ্ব বয়সের কোমর্বিডিটিযুক্ত রোগীদেরই একমাত্র ককটেল থেরাপির মাধ্যমে চিকিৎসা করা ভাল।
[আরও পড়ুন: ওমিক্রনের থেকেও সংক্রামক! উদ্বেগ বাড়িয়ে ফ্রান্সে মিলল করোনার নয়া স্ট্রেন]
তবে ডাঃ দীপ্যমান গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “রোগী তাঁর নিজের ধারণা থেকে কোন থেরাপি চাইলে তা অগ্রাহ্য করা প্রায় অসম্ভব। তবু বলব, এই থেরাপি দেওয়ার আগে রোগী বা তাঁর পরিবারকে ভালভাবে কাউন্সেলিং করা উচিত। যে তথ্যের উপর ভিত্তি করে ক্যাসিরিভিম্যাব/ইমডেভিম্যাব ককটেল এমারজেন্সি ইউজ অ্যাপ্রুভাল পেয়েছে সেটা হল, পজিটিভ টেস্টের ৩দিনের মধ্যে ককটেল দিলে রোগীকে হাসপাতালে ভরতি করতে হবে। এখন প্রশ্ন হল, যাঁদের ককটেল দেওয়া হচ্ছে তাঁরা কি সবাই তিনদিনের মধ্যে এটা পাচ্ছেন? এমন কখনই নয় যে তিনদিনের জায়গায় ৫-৬দিনে দিলে এর সুফল নেই। কিন্তু যেটা খুব প্রয়োজন সেটা হল যাঁদের এটা দেওয়া হল তাঁদের রোগের গতিপ্রকৃতির খতিয়ান রেখে রিয়াল লাইফ সিচুয়েশনে এই থেরাপির ফলাফল হিসেব করা এবং প্রকাশ করা। সেটা ডাক্তারদের করতে হবে।”
এখানেই শেষ নয়। গবেষকদের আশঙ্কাও রয়েছে। ভাইরোলজিস্ট সিদ্ধার্থ জোয়ারদারের মতে, শরীরের বাইরে থেকে দেওয়া যে কোনও ওষুধ বা বায়ো অ্যাকটিভ মলিকিউল আমাদের শরীরে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডির মতো বায়ো-মলিকিয়ুল এই নিয়মের ব্যতিক্রমী নয়। মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি প্রয়োগে আক্রান্ত মানুষের শরীরে ভাইরাস সংক্রমণের পরিমাণ বেড়ে যেতে পারে ‘অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহান্সমেন্ট’ পদ্ধতির কুফলে। মনোসাইট, ম্যাক্রোফাজ, ন্যাচারাল কিলার সেলের মতো কোষে অ্যান্টিবডি রিসেপ্টর থাকায়, তারা সহজেই অ্যান্টিবডির লেজ অংশটিকে জড়িয়ে ফেলে। এর ফলে ভাইরাস নিউট্রালাইজ করতে উদ্যত মনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি ভাইরাস সমেত কোষে প্রবেশ করে। তার জেরে এই সমস্ত কোষে তৈরি হয় অনভিপ্রেত সংক্রমণ। এছাড়া কোষগুলি অধিক সক্রিয় হয়ে তৈরি করে অধিক প্রদাহ অর্থাৎ ইনফ্লেমেশন ও টিস্যু ইনজুরি।