সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: লোকসভা ভোটকে নজরে রেখে বেশ কিছু জেলার সভাপতি বদল করেছে তৃণমূল (TMC)। বদল হয়েছে চেয়ারম্যানও। মূলত দলের স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, গোষ্ঠীকোন্দল মেটানো এবং তৃণমূলস্তরের সংগঠনকে আরও মজবুত করতেই এই রদবদল করা হয়েছে বলে দলীয় সূত্রে খবর। কিন্তু গত তিন বছর ধরে জঙ্গলমহলের জেলা পুরুলিয়ার সভাপতি পদে কোনও বদল নেই। এনিয়ে তৃতীয়বার পুরুলিয়া জেলা তৃণমূলের সভাপতি বহাল রইলেন সৌমেন বেলথরিয়া। দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে দেওয়া রিপোর্টে দাবি করা হয়েছে, বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে এই জেলায় সৌমেনের মতো নবীন দক্ষ সংগঠক নেই। আর তাতেই ক্ষুব্ধ দলের বিধায়ক-সহ শীর্ষ নেতারা এমনই খবর তৃণমূল সূত্রে।
দলেরই একাংশের অভিযোগ, দলীয় নেতা-কর্মীদের মতামতকে কোনওরকম গুরুত্ব না দিয়ে একটি সংস্থার জোনাল স্তরের রিপোর্টের ভিত্তিতে সৌমেনকেই জেলা সভাপতি হিসেবে বহাল রাখা হয়। রিপোর্টে কার্যত প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া হয়েছে সৌমেন বেলথরিয়া জেলার অনন্য সংগঠক। তাঁর মতো দক্ষ সংগঠক আর নেই। কিন্তু এই রিপোর্টেই না কি ক্ষুব্ধ দলের বিধায়ক-সহ শীর্ষ নেতারা। সভাপতি পদে সৌমন বহাল থাকা নিয়ে বনমহলের এই জেলায় দল যেন আড়াআড়ি দু-ভাগ! একেবারে বুথ থেকে জেলাস্তর পর্যন্ত ক্ষোভের চোরাস্রোত বইছে। সৌমেনের অনুগামীরা সামাজিক মাধ্যম ও হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর স্বপক্ষে প্রচার তুঙ্গে তুললেও নিচুতলা এমনকী জেলার শীর্ষ নেতাদের স্তরে প্রকাশ্যেই ক্ষোভ আছড়ে পড়ছে। মুখ খুলেছেন একাধিক বিধায়কও। আবার কোনও-কোনও নেতা অত্যন্ত সাবধানী হয়ে একেবারে চুপ। সবে মিলিয়ে লোকসভা নির্বাচনের আগে একদা ‘গেরুয়া গড়’ পুরুলিয়ায় শাসকদলে যেন হঠাৎ করেই ছন্দপতন!
[আরও পড়ুন: ‘আবার কবে তলব করা হবে?’, জানতে আচমকা ইডি দপ্তরে টিটাগড় পুরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান]
আসলে সৌমেনকে নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্ক চলছিলই। যার সূত্রপাত, পুরসভা নির্বাচন থেকে। যদিও পুর নির্বাচন এবং তারপরে পঞ্চায়েত ভোটে জেলায় বিজেপিকে ধরাশায়ী করে উল্লেখযোগ্য ফল করে তৃণমূল। কিন্তু এই ফলের কৃতিত্ব সৌমেনকে দিতে নারাজ জেলার শীর্ষ নেতাদের ক্ষুব্ধ হয়ে থাকা একটা বড় অংশ। আসলে লবি ছিল-ই। বিধানসভা নির্বাচনের পর ২০২১ সালের ১৬ আগস্ট পুরুলিয়া জেলা তৃণমূলে আমূল বদল হওয়ার পর চারটে গ্রুপ তৈরি হয়ে যায়। এই ক্ষোভ-বিক্ষোভের মধ্যেই দল চলছিল। কিন্তু তৃতীয় বার (২০২১,২০২২,২০২৩) পুরুলিয়া জেলা তৃণমূলের সভাপতি সৌমেন বহাল থাকতেই চাপা আগুন যেমন হঠাৎই প্রকাশ্যে চলে এল।
পুরুলিয়া জেলা তৃণমূলের অন্যতম সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা পুরুলিয়া জেলা পরিষদের সহ-সভাধিপতি সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “সর্বভারতীয় তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নবজোয়ার কর্মসূচির জন্যই পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভালো ফল হয়। তাছাড়া জেলার বিভিন্ন জোনে থাকা জেলার নেতাদের সাংগঠনিক দক্ষতাতেই এই ভালো ফল হয়েছে। লোকসভা ভোটের মতো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে এই জেলার সংগঠনে রদবদল ভীষণ প্রয়োজন ছিল। সংগঠন বদল না হওয়ার পিছনে যাঁরা রিপোর্ট দিয়েছেন সেই রিপোর্ট সঠিক নয়। দলের নিচুতলা অন্য কথা বলছে।” শুধু তাই নয় এই রিপোর্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে একটি আঁতাত কাজ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সবমিলিয়ে জেলার শীর্ষ নেতা ও বিধায়কদের মধ্যে অসন্তোষ ক্রমেই বাড়ছে। বাঘমুন্ডির বিধায়ক তথা রাজ্য যুব তৃণমূলের সহ-সভাপতি সুশান্ত মাহাতো বলেন, “প্রায় বছর দু’য়েক ধরে সাংগঠনিক কাজে আমাদের কোনও মতামত নেওয়া হয় না। সেই কাজে আমাদের যুক্ত পর্যন্ত করা হয় না। কোনওরকম আলোচনা পর্যন্ত করেন না। তবে আমরা বিধায়ক হয়ে নিজের এলাকায় কাজ করে যাচ্ছি। কিন্তু সামনে বড় নির্বাচন। এই নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে সাংগঠনিক রদবদল ভীষণই প্রয়োজন ছিল। তবে দলের সিদ্ধান্ত তো মানতেই হবে।” জেলা সভাপতিকে নিয়ে যখন তীব্র অসন্তোষ সেই সময় এই বিষয়ে কোনও প্রতিক্রিয়া দিতে চাইলেন না রাজ্য তৃণমূলের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক তথা দলের তরফে রাজ্যের মুখপাত্র, প্রাক্তন মন্ত্রী শান্তিরাম মাহাতো। খানিকটা বিরক্তির সুরেই তিনি বলেন, “এই বিষয়ে আবার প্রতিক্রিয়া কী?”
[আরও পড়ুন: ৬ সংস্থার মাধ্যমে সাড়ে ৫০ কোটি পাচার বাকিবুরের, মালিক কারা? খুঁজছে ইডি]
উল্লেখ্য, আগে এই জেলা তৃণমূলে লবি ছিল দুটো। শান্তিরাম মাহাতো ও সুজয় বন্দ্যোপাধ্যায়। সৌমেন জেলা সভাপতি হওয়ার পর যুক্ত হয়েছিল প্রাক্তন জেলা সভাপতি অর্থাৎ তার আগের দায়িত্ব পালন করা বর্তমানে দলের অন্যতম সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট গুরুপদ টুডু। তিনি রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন বিভাগের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত রাষ্ট্রমন্ত্রী সন্ধ্যারানী টুডুর স্বামী। তিনি অবশ্য বলেন, “সৌমেন আবার সভাপতি হওয়ায় দলের সংগঠন আরও মজবুত হবে। লোকসভা ভোটে ফল আমাদের ভালো হবে।” এদিকে সৌমেন বলেন,”আমি তো সবসময়ই নবীন-প্রবীণদের সঙ্গে আলোচনা করে কাজ করে আসছি। আমার মূল লক্ষ্য দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাই যে নেতৃত্ব-র সঙ্গে আমার বসা দরকার আমি তাঁর সঙ্গে আলোচনায় বসব।”
কিন্তু তাতে অনৈক্যর ছবিটা কি বদলাবে? সংগঠনকে কি আক্ষরিক অর্থেই চাঙ্গা করা যাবে? এই প্রশ্ন তুলছে দলের নিচুতলা। পঞ্চায়েত নির্বাচনে ভালো ফল হলেও বেশ কয়েকটি আসনে শাসকদল প্রার্থী পর্যন্ত দিতে পারেনি। এর থেকেই সাংগঠনিক দুর্বলতা পরিষ্কার হয়ে যায়। যা এখনও রয়ে গিয়েছে। সদ্য শেষ হওয়া বিজয়া সম্মিলনী থেকে যার আঁচও মিলেছে। ফলে রদবদল না হওয়ায় অখুশি জেলা যুব, ছাত্রের মত গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনও।