শেখ মুজিবুর রহমানের বায়োপিক নিয়ে যেন ফের বঙ্গভঙ্গ! ওপার বাংলার তীব্র ক্ষোভ, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক কেন বানাবেন শ্যাম বেনেগল, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় ও গৌতম ঘোষ? দু’দেশের মতামত শুনলেন ঋজুলা ঘোষ মুখোপাধ্যায়।
২০২০ সালের ১৭ মার্চ তারিখটার দিকে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে ঘরের পাশের বাংলাদেশ। সে দেশে জাতির জনকের মর্যাদায় ভূষিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ ওই দিনটিতেই। আর ঠিক তার আগেই প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা তাঁর জীবন-নির্ভর একটি কাহিনিচিত্রের। উপমহাদেশের গগনচুম্বী ব্যক্তিত্বদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য, বিবিসির সমীক্ষায় রবীন্দ্রনাথ-নেতাজিকেও পেছনে ফেলে ‘সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি’র সম্মান পেয়েছেন। অথচ শেখ মুজিবের জীবন নিয়ে আজ পর্যন্ত সেলুলয়েডে তৈরি হয়নি কোনও মাস্টারপিস! না দুই বাংলায়, না বিশ্বের অন্য কোথাও।
অবশেষে গত বছরই স্থির হয়েছে, ভারত ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ প্রযোজনায় তৈরি হবে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক– আর এই এপিক মেগা-প্রোজেক্টে কোটি কোটি টাকা ঢালতে কোনও দেশই যে কার্পণ্য করবে না, তা বলাই বাহুল্য।
সিনেমা রিলিজ করার ডেট ঠিক হয়ে আছে, অথচ তার পরিচালকের নামই এখনও চূড়ান্ত হয়নি। এবং এই বায়োপিক কে বানাবেন, তা নিয়েও দুই দেশের মধ্যে যে পরিমাণ মান-অভিমান আর নাটকীয়তা চলছে তা নিয়ে একটা সিনেমা না হোক, একটা ছোটখাটো টেলিভিশন সিরিয়াল দিব্যি হয়ে যেতে পারে!
বিতর্কের কারণ, ছবির সম্ভাব্য পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশের কাছে তিনজনের নাম প্রস্তাব করেছে ভারত সরকার– শ্যাম বেনেগাল, গৌতম ঘোষ ও কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। এঁদের প্রত্যেকের দক্ষতা বা যোগ্যতা নিয়ে হয়তো বিশেষ সংশয় নেই। বাংলাদেশ সরকারও নামগুলো নিয়ে সানন্দেই পর্যালোচনা করছেন। কিন্তু বুড়িগঙ্গার ধারে এই প্রশ্নও উঠতে শুরু করেছে, বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবি সেটা কেন ভারতীয়রা বানাবেন?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামটার সঙ্গে বাংলাদেশের যে শ্রদ্ধা আর আবেগ জড়িয়ে, ভারতীয়রা কী ভাবে তার থই পাবেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় বা খবরের কাগজে মুখ খুলে সরাসরি সে প্রশ্ন তুলছেন বাংলাদেশী নির্মাতাদের অনেকেই।
[‘ইন্ডাস্ট্রি বদলাচ্ছে বলেই আমি এখনও টিকে আছি’]
‘মনপুরা’র মতো মন-কেমন-করা ছবি বানিয়ে বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিলেন গিয়াসউদ্দিন সেলিম। তিনি যেমন স্পষ্ট বলছেন, “পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা কীভাবে বুঝবেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমাদের আবেগটা ঠিক কোথায়? সেখানে শ্যাম বেনেগাল তো অনেক দূরের কথা!”
এমনকী, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিকে গৌতম ঘোষও ঠিকঠাক জাস্টিস করতে পারবেন না বলে তাঁর বিশ্বাস। “উনি হয়তো একটা ‘পদ্মানদীর মাঝি’ বানাতে পারেন, কিন্তু এই বায়োপিক পারবেন না। আমি বিশ্বাস করি, এই সিনেমা বানানোর আগে বঙ্গবন্ধুকে হৃদয়ে ধারণ করতে হবে। যেটা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিদের পক্ষে সে ভাবে কখনওই সম্ভব নয়!”
মাহমুদ দিদার নামে তরুণ এক বাংলাদেশি নির্মাতা আবার ফেসবুকে লিখেছেন, “ছিঃ! লজ্জা! এই দীনতা ক্ষমা করো প্রভু। বাংলাদেশ সরকারের টাকায় ভারতের প্রাচীনপন্থী আধা-বিকশিত নির্মাতারা এই সিনেমা বানানোর সাহস করে ক্যামনে?”
প্রতিভাবান পরিচালক হিসেবে মাহমুদ দিদার ইদানীং নাম করেছেন একটু-আধটু, তবে শ্যাম বেনেগাল-গৌতম ঘোষদের ‘আধা-বিকশিত’ বলতে তাঁর এতটুকু হাত কাঁপেনি। এবং তাঁর আরও বিশ্বাস, বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক পরিচালনার ভার ভারতীয়দের হাতে তুলে দেওয়ার অর্থ, “আমাদের চিন্তার সামর্থকে রাষ্ট্রীয়ভাবে তলানিতে নিয়ে যাওয়া!”
এমন উদাহরণ আরও রয়েছে। খিজির হায়াত খান যেমন, ‘জাগো’ নামে একটি ছবি বানিয়েছেন। বলা হয় সেটি ফুটবল নিয়ে বাংলাদেশে বানানো প্রথম ছবি। সেই খিজির হায়াতও ফেসবুকের ওয়ালে লিখতে ছাড়েননি, “একবার আমাদেরকেও জিজ্ঞাসা করতেন। আমাদের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে দাদারা কেন সিনেমা বানাবে দয়া করে একবার বলবেন? আমরা কি সিনেমা বানাতে পারি না?”
সচরাচর ভারতীয় হিন্দুদের ব্যঙ্গ করেই বাংলাদেশে ‘দাদাবাবু’ বা ‘দাদা’ বলে উল্লেখ করা হয়। এবং এই ধরনের পোস্ট থেকে স্পষ্ট, বঙ্গবন্ধু বায়োপিক নিয়ে তরজায় সব সময় শালীনতার বেড়াও রক্ষিত হচ্ছে না।
পাশাপাশি অবশ্য এটাও বলতে হয়, তৌকির আহমেদ বা আবুল হায়াতের মতো বাংলাদেশ চলচ্চিত্র জগতের অনেক বরেণ্য দিকপালই আবার এর মধ্যে অসুবিধার কিছু দেখছেন না। “ভারতীয়রাই করুক বা বাংলাদেশীরা, কাজটা ভাল হওয়া নিয়ে কথা,” সাফ কথা তাঁদের দু’জনেরই।
কিন্তু দিল্লি-ঢাকা কূটনীতির মাখামাখি আর ভাব-ভালবাসার মধ্যেও যেমন তিস্তার কাঁটা মিশে আছে, তেমনই বঙ্গবন্ধু বায়োপিক ভারতীয়দের হাতে বানানোকে কেন্দ্র করেও যে একটা অস্বস্তি তৈরি হচ্ছে, সেটা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। এবং যে তিনজনের নাম এই ছবি বানানোর জন্য ভারত প্রস্তাব করেছে তাঁরাও প্রত্যেকেই তা নিয়ে পুরোদস্তুর ওয়াকিবহাল!
[সিসিডি-বারিস্তার যুগেও ইতিহাসের আভিজাত্যে গর্বিত ‘ফেভারিট কেবিন’]
শ্যাম বেনেগাল: “আসলে কী, এটা বাংলাদেশের ওপরেই নির্ভর করে। আমাদের উপমহাদেশে এ সব জিনিস নিয়ে সব সময়ই সমস্যা হয়। খুব বোকার মতো শোনাবে যদি আমি বলি বঙ্গবন্ধুর ওপর ছবি বানানোর জন্য আমিই সেরা লোক। বরং ঘটনা হল, প্রস্তাবটাই আমার কাছে এসেছে। তবে আমি নিশ্চিত এই ছবি বানানোর মতো দক্ষ লোকজন নিশ্চয়ই ওখানেও আছেন!”
গৌতম ঘোষ: “হ্যাঁ, আমি একমত যে এটা বাংলাদেশের একটা তীব্র আবেগের জায়গা। সে ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের একজন পরিচালকও এই প্রোজেক্টে থাকলে আমার মতে সবচেয়ে ভাল। তবে আমি এটাও মনে করিয়ে দিতে চাই, গান্ধীকে নিয়ে সেরা ছবিটা কিন্তু একজন বিদেশিই বানিয়েছেন, অ্যাটেনবরো।”
কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়: “এগুলো আসলে ভাগাভাগির জিনিস নয়। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে তো আমরা ভাগ করিনি, গান-বাজনা-শিল্পী-গুণীজন-মহান ব্যক্তিত্বদের ভাগাভাগি হয় না, তাঁরা কখনও একটা দেশেরও হন না। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতও তো রবীন্দ্রনাথেরই লেখা, তার বেলা? বাংলাদেশের বরং আনন্দিত হওয়া উচিত তাদের জাতীয় নায়ককে নিয়ে ছবি একজন ভারতীয় বানাচ্ছেন।”
সিনেমাটা পরিচালনার ভার তাঁদের হাতে আসতে পারে, এটা জেনে বাংলাদেশে যে ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার জবাব এ ভাবেই ‘সংবাদ প্রতিদিন’কে দিলেন ভারতের তিন পরিচালক। সেই সঙ্গে এটাও তাঁরা পরিষ্কার করে দিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত এই কাজটা করার সুযোগ পেলে তাঁরা নিজেদের গর্বিত মনে করবেন।
তিরাশি বছরের শ্যাম বেনেগাল যেমন। সোমবার দুপুরে তাঁর সঙ্গে যখন কথা হল, মুম্বই শহরতলিতে নিজের অফিসঘরে বসে তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়েই পড়াশুনো করছেন।
“এই তো গত সপ্তাহেই ইংরেজি অনুবাদে শেখ মুজিবের অসমাপ্ত আত্মজীবনী (আনফিনিশড মেমোয়ার্স) আরও একবার শেষ করলাম। মুজিব ইজ আ ফ্যাসিনেটিং সাবজেক্ট ফর আ ফিল্ম, কোনও সন্দেহ নেই।” বলছিলেন ‘মন্থন’, ‘অঙ্কুর’ থেকে শুরু করে ‘যাত্রা’ কিংবা ‘ভারত এক খোঁজ’-এর বর্ষীয়ান পরিচালক।
নেহরু-গান্ধী-সুভাষ বসু সবাইকে নিয়েই ছবি বা তথ্যচিত্র বানানোর অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। সেই তালিকায় বঙ্গবন্ধুর নামটা যোগ হলে যে এতটুকু অখুশি হবেন না, সেটাও বুঝিয়ে দিলেন পরিষ্কার।
গৌতম ঘোষও বিশ্বাস করেন দারুণ ‘ইন্টারেস্টিং প্রোজেক্ট’ হবে এটা। প্রায় সিকি শতাব্দী হয়ে গেল ‘পদ্মানদীর মাঝি’ বানিয়েছিলেন বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায়। মাঝে ‘শঙ্খচিল’-এর মতো এ রকম আরও বহু কাজ করেছেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক বানানোর সুযোগ এলে মিস করতে রাজি নন তিনিও।
“বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যখন হয়, তখন আমার বয়স একুশ কী বাইশ। টগবগে তরুণ, যুদ্ধের উত্তেজনায় আমিও ফুটছিলাম। আজ এত দিন বাদে সেই বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ছবি করার সময় আমার কথা ভাবা হচ্ছে, এটাই তো দারুণ ব্যাপার।” আবেগ লুকনোর কোনও চেষ্টাই করেন না গৌতম।
গত বছর যে ‘বিসর্জন’ ছবির জন্য জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়। সেটাও ছিল ভারত-বাংলা সীমান্তেরই গল্প। জয়া আহসান আর আবির চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে যে বর্ডার-ভাঙা ভালবাসার গল্প বুনেছিলেন তিনি, বোঝা গেল সেই নেশাটা তাঁর মধ্যে ভালই জাঁকিয়ে বসেছে।
“দেখুন, আমরা এমন একটা জায়গায় থাকি যেখান থেকে মাত্র দু’আড়াই ঘণ্টার পথ পেরোলেই আর একটা আলাদা দেশ শুরু হয়ে যায়। আমার শৈশবেই সে দেশটা ভাগ হয়েছিল। আর আজ সেই দেশের জন্ম যাঁর হাতে, তাঁকে নিয়ে ছবি বানাতে পারলে আমি যে অসম্ভব সম্মানিত বোধ করব, সেটা কি বলার অপেক্ষা রাখে?” বলছিলেন কৌশিক।
[নওয়াজকে ডিরেক্ট করাটা খুব চ্যালেঞ্জিং, কেন একথা তন্নিষ্ঠার মুখে?]
সুতরাং রাজি তিনজনেই। ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রক আলাদাভাবে তাঁদের সবার অনুমতি নিয়েই তাঁদের নাম বাংলাদেশ সরকারের কাছে প্রস্তাব করেছে। জুলাইয়ের মাঝামাঝি নয়াদিল্লিতে দু’দেশের আধিকারিকদের বৈঠকে আনুষ্ঠানিক ভাবে এই তিনটে নাম পেশ করা হয়েছে। বল এখন ঢাকার কোর্টে। বাংলাদেশের হাই প্রোফাইল তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু ইতিমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, ভারতীয় পরিচালক নিয়ে তিনি কোনও আপত্তির কারণ দেখছেন না। “বরং ছবিটা যেহেতু ভারতের সঙ্গে যৌথ প্রযোজনায় হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বহু তথ্য-প্রমাণাদি যেগুলো ভারতেও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, সেগুলো ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। ফলে ছবিটাও অনেক সমৃদ্ধ হবে।” বলছেন তিনি।
এই আগস্টের মধ্যেই সম্ভবত ঠিক হয়ে যাবে শেষ পর্যন্ত শ্যাম বেনেগাল, গৌতম ঘোষ না কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়- কার কপালে শিকে ছিঁড়ছে। তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন, তর্কাতর্কি ওখানেই শেষ হয়ে যাবে না। পরের নাটকটা অবধারিত ভাবে শুরু হবে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকায় কে অভিনয় করবেন, তা নিয়ে। তিনি ভারতীয় না বাংলাদেশি, বাঙালি না অবাঙালি, তাঁর গলা মুজিবের মতো জলদগম্ভীর হবে কি না– এগুলো নিয়েই নির্ঘাত চলবে পরের পর্ব। বঙ্গবন্ধু বায়োপিক ড্রামা, পার্ট টু!
[নওয়াজের সঙ্গে যৌন দৃশ্য ভাইরাল, কী বলছেন হাওড়ার ইশিকা?]
The post কেন ভারতীয় পরিচালক তৈরি করবে বঙ্গবন্ধুর বায়োপিক? ক্ষুব্ধ ওপার বাংলা appeared first on Sangbad Pratidin.