অজয় গুপ্ত (ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ): গলায় দড়ি দিয়ে আত্মঘাতী ও মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া দেহের মধ্যে ফারাক স্পষ্ট বোঝা যায় বিশেষজ্ঞদের সামান্য পর্যবেক্ষণে। এর জন্য ফরেনসিক (Forensic) জ্ঞান থাকার বিশেষ দরকার নেই। মূলত মৃতদেহের দু’টি দিক দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা (Suicide), নাকি মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
আমাদের গলা অনেকটাই লম্বাটে গড়নের। তাই আত্মহত্যার পর দেখা যায়, গলায় ফাঁসের দাগ (লিগেচার মার্ক) উলটো দিকে থাকে। অর্থাৎ ডান দিকে যদি ফাঁস পড়ে তবে মাথা বাঁ দিকে হেলে যাবে। আর যদি ফাঁস বাঁ দিকে থাকে তবে মাথা ডানদিকে হেলে থাকবে। এটা প্রথম চিহ্ন। দ্বিতীয়ত, আত্মঘাতী ব্যক্তির ঠোঁটের প্রান্ত থেকে লালা বের হয়। অনেক সময় সেই লালা বুক বেয়ে জামা বা গেঞ্জি পর্যন্ত ভিজিয়ে দেয়। আর দীর্ঘক্ষণ সেই লালা বা স্যালাইভার দাগ মৃতের ঠোঁটে লেগে থাকে। এইসমস্ত চিহ্ন দেখে প্রাথমিকভাবে বলা যায় মৃত ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছে কি না।
[আরও পড়ুন: ১৩ মে থেকে ১৪দিনের জন্য বাতিল হাওড়ার এই শাখা ৬৮টি ট্রেন, জেনে নিন খুঁটিনাটি]
কোনও ব্যক্তিকে মেরে ঝুলিয়ে দেওয়া হলে অথবা অর্ধমৃত বা অজ্ঞান অবস্থায় দড়িতে ঝুলিয়ে দিলে এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা নেই। আমার মনে হয়, কাশীপুরে যে যুবকের মৃত্যু হয়েছে তার ঠোঁটের কোণে স্যালাইভার (লালারস) দাগ শুকিয়ে ছিল। আর তা ছিল বলেই আত্মহত্যার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এখন প্রশ্ন আসতেই পারে যে, যদি মৃত ব্যক্তি শারীরিকভাবে দুর্বল হয় অথবা তাঁকে জোর করে দড়ি পরিয়ে ঝুলিয়ে দেওয়ার পরেই জ্ঞান হারায় সেক্ষেত্রে প্রথম চোটেই গলায় ফাঁস লেগে মারা যায় তবে স্যালাইভা নাও বেরোতে পারে। তেমন ক্ষেত্রে পোস্টমর্টেম করে বোঝা যাবে।
অনেক সময় দেখা যায়, মৃত ব্যক্তির পা মাটির সঙ্গে ঠেকে থাকে। অনেকেই প্রশ্ন করেন, পা মাটিতে ঠেকে থাকলে মৃত্যু হয় কী করে? আমার উত্তর, এমনিতেই গলায় দড়ি দিলে পা মাটির দিকে ঝুলে যায়। সেই সময় গলায় দড়ির ফাঁস উপরে উঠে যায়। আর দেহ নিচের দিকে নামতে থাকে। আর পায়ের বুড়ো আঙুল বা গোড়ালি মাটিতে লেগে থেকেও মৃতু্য হতে পারে। বাইরে থেকে কায়দা করে এমনটা করা সম্ভব নয়। এই ধরনের মৃতু্যর ক্ষেত্রে মাথার যে ওজন তাতেই শ্বাসরোধ হয়ে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে।
এই ধরনের ঘটনাকে ‘পার্শিয়াল হ্যাংগিং’ বলা হয়। অর্থাৎ মাথার ওজনেই ওই ব্যক্তির মৃত্যু হতে পারে। গোটা শরীরের ওজন দরকার পড়ে না। গ্রামের দিকে ম্যাজিক দেখাতে গিয়ে অনেক সময় এই ধরনের মৃত্যু দেখা যায়। তার শরীরে হয়তো আঘাতের চিহ্ন থাকতে পারে। কিন্তু ঘটনা হল মারধর খাওয়ার পরে সজ্ঞানে ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করেছেন। সেই জন্য বলা হয়, ‘লিগেচার মার্ক অ্যান্টিমর্টেম ইন নেচার।’ এই ধরনের চিহ্ন থাকলে আত্মহত্যা বলেই ধরে নেওয়া হয়।
[আরও পড়ুন: অশনির জেরে উত্তাল সমুদ্র, রাতভর বৃষ্টি অন্ধ্র-ওড়িশায়, সাতসকালে ভিজল বাংলাও]
দেখা যায়, মৃতের হাত মুঠো থাকে। এটা হল শরীরের অভিঘাত। ঘাড়ের যেদিকে চাপ পড়ে তার উল্টোদিকে হাত মুঠো করে ফেলে। অনেকটা সেরিব্রাল স্ট্রোকের মতো যেদিকে চাপ পড়ে তার উলটো দিকে হাত মুঠো করে। আসলে দুটো হাতই মুঠো করতে চায়। কিন্তু পারে না। দেখবেন মাদুলি বা তাবিজ হালকা হলে একটা দিক টান দিলে শক্ত হয়ে যায়। এটাকে বলে ‘রানিং নুজ না স্লিপ নট’। এইসব লক্ষণ থাকলে আত্মহত্যা বলে প্রথমেই সন্দেহ করা হয়। তারপরে তো পোস্টমর্টেম রয়েছেই।