সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: কথা ছিল শেষ বিশ্বকাপ তিনি ভরিয়ে দেবেন মহানায়কীয় গৌরবে। মাঠজুড়ে ফুল ফোটাবেন তাঁর আশ্চর্য ক্ষমতায়। তিনি বিতর্কিত। একটু বা দুর্বিনীত। খানিকটা বেপরোয়াও। আর হবেন নাই-বা কেন। এই বল্গাহীন ফুটবল-যাপন তো তাঁকেই মানায় যাঁর নাম ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো (Cristiano Ronaldo)। কথা ছিল, শেষবার সেই মশালের উজ্জ্বল আলোয় রেঙে উঠবে ফুটবলের দুনিয়া। অথচ ফুটবল-বিধাতা তাঁর জন্যই বোধহয় তুলে রেখেছিল অন্য কিছু। কোথায় সেই মহানায়কীয় ঐশ্বর্য! কোথায় বা সেই অবিশ্বাস্য স্কিলে মাঠ জুড়ে ফুল ফোটানোর বৈভব। বিশ্বকাপের উজ্জ্বল মঞ্চ থেকে বিষণ্ণ বিদায় হল ক্রিশ্চিয়ানোর।
অথচ তিনিই তো প্রমাণ করেছিলেন, ভাগ্যের দেখিয়ে দেওয়া পথ নয়। বরং ভাগ্যের দেবতা তাঁকেই বরমাল্য দেয়, যিনি পরিশ্রম করে নিজের ভাগ্য তৈরি করে নিতে জানেন। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো মানেই গোটা বিশ্বের কাছে সেই অদম্য জেদের মন্ত্র। হাল না-ছাড়ার ছড়িয়ে দেওয়া ইস্তেহার। বিপক্ষের প্রাচীর যত দুর্ভেদ্যই হোক না কেন, তাঁর অতিমানবিক স্কিলের নাগাল পাওয়া সম্ভব নয়। ম্যাজিক নয়, তিনি জানেন, শক্তির সাধনায় অটুট প্রাচীর ভাঙার মধ্যেই আছে জীবনের সফলতা। কতবার তো সেই শক্তির কাছেই পরাস্ত হয়েছে কত ডিফেন্সের সাজানো ঘর। ফুটবলবিশ্বকে কতবার তিনি দেখিয়েছেন, রেকর্ডের পিছনে নয়, রেকর্ডই তাঁর পিছনে ছোটে। এই রোনাল্ডোকেই ভালবেসেছে বিশ্ব। যে রোনাল্ডো জানে পরিশ্রম আর সুযোগ কাজে লাগানোর নামই জীবন। জীবনের জয়গান গাইতে হয় জীবনেরই প্রতিকূলতাকে অতিক্রম করে। অথচ একটা গোটা বিশ্বকাপ যেন দ্বাদশ ব্যক্তি হয়েই কাটিয়ে দিলেন তিনি।
[আরও পড়ুন: Abhishek Banerjee: ‘আগামী ২০ দিন রাজনীতি নয়, শুধু ফুটবল’, এমপি কাপ উদ্বোধনে বললেন অভিষেক]
২০১৬ সাল। সেদিনও তিনি ছিলেন দ্বাদশ ব্যক্তির ভূমিকায়। ইউরো কাপে (Euro Cup) দলকে টেনে তুলেছিলেন। কিন্তু মোক্ষম দিনে হানা দিল চোট। কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছেড়েছিলেন। আর সেই চোখের জলে লেখা হয়েছিল ফুটবল ইতিহাস। মাঠের বাইরে থেকেও একজন খেলোয়াড় যে খেলতে পারেন, আবেগে-অনুপ্রেরণায় দলের জয়ের পথ তৈরি করে দিতে পারেন, দেখিয়েছিলেন সিআর সেভেন। ২০২২ তার থেকে অনেকটাই আলাদা। ক্লাব ফুটবলে হাজার বিতর্ক। তাবড় কোচ বলছেন, রোনাল্ডো তাঁর সূক্ষ্মতা হারিয়েছেন। তবু তিনি মানতে নারাজ। সমর্থকরাও তো প্রাণভরে তাঁকেই একবার দেখে নিতে চান। তিনি কেন বসে থাকবেন বাইরে! কিন্তু সত্যিই যেন দলকে আর আগের মতো প্রাণবায়ু জোগাতে পারছিলেন না। সামান্য একটা গোল, তাঁর মাথা ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি তা নিয়ে বিতর্ক হল এক সমুদ্র। শেষমেশ জাতীয় দলের কোচও তাঁকে বসিয়ে রাখলেন। আর তিনি তাকিয়ে থাকলেন বিষণ্ন দৃষ্টিতে। এই কি পাওনা ছিল! আক্ষেপ করল গোটা বিশ্ব। অথবা এই-ই হয়তো পাওনা ছিল। যে জীবনকে তিনি পরিশ্রম আর দক্ষতায় করায়ত্ত করতে চেয়েছেন, সেই জীবনেরই এ এক অমোঘ খেলা। দলকে সেমিতে তোলার লড়াইয়েও তাই তাঁর ভূমিকা হল ওই দ্বাদশ ব্যক্তিরই। মাঠে নামলেন বটে। চেষ্টা করলেন সাধ্যমতো। কিন্তু ফুটবল বিধাতা সহায় ছিলেন না। তিনি হয়তো আগেই রোনাল্ডোর নামের পাশে 'দুয়োরানি'র তকমা বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন।
[আরও পড়ুন: বাগদানের দিন প্রায় ১০০ জন মিলে তরুণী চিকিৎসককে অপহরণ! বাড়ি ভাঙচুর, ভিডিও ভাইরাল]
ফুটবলবিশ্বে তাঁরই প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসি (Leo Messi) যেন একার কাঁধে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন দলকে। সে-দেশের অতীত কিংবদন্তির সঙ্গে একাসনে তাঁকে বসিয়ে দিয়েছে তাঁর দেশের জনতা। ঠিক তার উলটো ছবি বরাদ্দ রইল ক্রিশ্চিয়ানোর জন্য। দেশের জন্য, ফুটবলের জন্য তিনিও কম কিছু করেননি। মহানায়কের গৌরব নিয়েই এ যাত্রা শেষ হওয়ার কথা ছিল তাঁর। তবু জীবন যেমন মাধুর্যময় তেমন নিষ্ঠুরও। এমনকী যুধিষ্ঠিরের জন্যও তোলা থাকে নরকদর্শনের নিয়তি। তাই রুক্ষ মরুভূমির মধ্যে এবার আর মরুদ্যান খুঁজে পেলেন না ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। উৎসব থেকে দূরে থেকে গেল তাঁর গৌরবের ফুটবলজীবনের অন্তিম অধ্যায়টি। মহানায়কের বৈভবে নয়, কাঁটার মুকুট মাথায় নিয়েই বিষণ্ন পদক্ষেপে তিনি ছেড়ে গেলেন তাঁর সাধের রঙ্গমঞ্চ।
এই-কি পাওনা ছিল! হয়তো এখনও এ প্রশ্নই করে চলেছেন তাঁর অগণিত সমর্থকরা। উত্তর মেলে না। অথবা উত্তর এটাই যে, জীবন তো এমনই।