সোম রায়, গান্ডিবাগ: শ্রীনগর থেকে গাড়ির চাকা ঘণ্টা দেড়েক গড়াল। পৌঁছাল কাকাপোরা বাজারে। তিনরাস্তার মোড়ে একজনকে গন্তব্যস্থল জানতে চাইলাম। নিমেষের মধ্যে সেই ভদ্রলোক পথ দেখিয়ে বললেন, “এক-দেড় কিলোমিটার যান। তাহলেই পেয়ে যাবেন।” অথচ মাস দুয়েক আগেও শ্রীনগর থেকে সামান্য দূরের এই জায়গার নাম কেউ জানতেন না। কিন্তু ১৪ ফেব্রুয়ারির পর ‘গান্ডিবাগ’ নাম শুনলেই হয়তো অনেকের গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়! এই অখ্যাত গ্রামেই বড় হয়ে উঠেছে আদিল আহমেদ দার। চিনতে পারলেন না? পুলওয়ামা কাণ্ডের চক্রী।
[ আরও পড়ুন: ‘বাবরি ধ্বংসের কোনও অনুশোচনা নেই’, আবারও বিস্ফোরক সাধ্বী প্রজ্ঞা ]
এবার আশা করি আর মাথা চুলকোতে হচ্ছে না। সময় ও সাহসের অভাবে গতমাসের কাশ্মীর সফরে আসা হয়নি এই গ্রামে। কিন্তু এবার শুরু থেকেই ইচ্ছা ছিল একবারের জন্য হলেও যেতে হবে সেই জঙ্গির বাড়ি, খাসতালুকে৷ যার আত্মঘাতী হানায় ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়কে অকালে ঝরে গিয়েছিল অতগুলো তরতাজা প্রাণ। একটু ভুল হল। এই শ্রীনগরে সে ‘জঙ্গি’ নয়- ‘শহিদ’! শ্রীনগরে দাঁড়িয়ে কোনও মিলিট্যান্টকে জঙ্গি বলা রীতিমতো অপরাধ। তারা যে ‘আজাদি’-র লড়াইয়ে শহিদ। কাকাপোরা বাজারে সেই অচেনা ব্যক্তির দিকনির্দেশে এগোতে গিয়ে দেখলাম বাঁদিকে চলছে ধান চাষের প্রস্তুতি। দোপাট্টায় টিফিন বক্স মুড়ে খাবার নিয়ে এলেন কারও এক স্ত্রী। কাকাপোরা রেল স্টেশনকে ডান হাতে রেখে কিছুটা এগোতেই চলে এল গান্ডিবাগ গ্রাম। উত্তরবঙ্গের কোনও প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামের সঙ্গে খুব একটা পার্থক্য নেই। ছোট্ট মুদির দোকানে জিজ্ঞেস করতে দেখিয়ে দিলেন ধূসর রংয়ের দোতলা বাড়িটা। পিছন পিছন এগিয়ে এলেন বৃদ্ধ দোকানিও। সদর দরজার সামনে থেকে স্থানীয় ভাষায় হাঁক দিলেন ড্রাইভার সাবির বেগ। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন তিন মহিলা। আদিলের মা, বৌদি ও এক প্রতিবেশী।
সংবাদমাধ্যম শুনেই কুঁচকে গেল আদিলের মায়ের কপাল। বললেন, “কী জন্য এসেছেন? আমার ছেলেটা তো চলেই গেল। বাড়িতে এখন কোনও পুরুষ নেই। থাকলেও কথা বলত না।” অনেক চেষ্টা করলাম তাঁকে ঠান্ডা করতে। কিন্তু কোনও লাভ হল না। উল্টে হাতজোড় করে আদিলের বউদি বললেন, “বসুন, চা খান। লেকিন খুদা কে ওয়াস্তে কুছ মত পুছিয়ে।” এরপর সেখানে রয়ে যাওয়ার কোনও মানে হয় না। বাড়ির পাশেই রাখা একটি ট্রাক। সেখান থেকে শ্রমিকরা কাঠ নিয়ে যাচ্ছেন আদিলের বাড়ির উলটোদিকের গুদামে। যার পাশের মাঠেই চিরনিদ্রায় শুয়ে আছে আদিল। গোটা রাস্তায় আমার অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী ছিল চাপা টেনশন। গাড়ির প্রেস স্টিকার খুলে রেখেছিলেন সাবির ভাই। হাজার হোক এক জেহাদির বাড়ি যাচ্ছি। তাঁর বাড়ির লোক হয়তো গ্রামের সাধারণ মানুষ। কিন্তু পথে কিছু না কিছু তো হতেই পারে! গ্রেনেড না হোক ক্ষুব্ধ কেউ পাথর তো ছুড়তেই পারে। সিআরপিএফ অফিস থেকেও এক উচ্চপদস্থ আধিকারিক বারণ করেছিলেন যেতে। বলেছিলেন, “কখন কী হয়ে যায়, বলা যায়?” তবু জেদ করেই গিয়েছিলাম। তখন কি জানতাম এরকম হতাশ হয়ে ফিরতে হবে?
[ আরও পড়ুন: ‘ন্যায়’-এর হোর্ডিংয়ে নিয়মভঙ্গ, রাহুলকে নোটিস কমিশনের ]
নিজের হতাশা চাপা দিয়ে, যাবতীয় অন্যমনস্কতা সরিয়ে কথা বলতে লাগলাম ৮০ ছুঁইছুঁই সেই মুদি দোকানি আমজাদের সঙ্গে। বললেন, “ছেলেটা যে কী ভাল ছিল, বলে বোঝানো যাবে না। গ্রামে এমন কেউ নেই, যে ওকে ভালবাসত না। যার-তার ঘরে ঢুকে বলত ‘খিদে পেয়েছে, খেতে দাও।’ সেই আদিলই যে এমন একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বসবে, কল্পনা করতে পারিনি।” একটু থেমে বৃদ্ধ বললেন, “ওকেও বা দোষ দিই কী করে বলুন তো? আদিলকে বন্দুক তুলে নিতে বাধ্য করেছে ইন্ডিয়া।” কিন্তু কীভাবে? আদিলের জেহাদি হওয়ার গল্প শোনাতে লাগলেন সেই বৃদ্ধ। বললেন, “আদিল খুব কর্মঠ। ছোট থেকেই মজুরি করত বাবার সঙ্গে। নিজের পড়াশোনার খরচও নিজে পরিশ্রম করে তুলত। ওর জ্যাঠা রশিদের বড় ছেলে মনজুর সবার প্রথম এই গ্রাম থেকে হাতে বন্দুক তুলেছিল। এরপর জওয়ানরা ওদের পরিবার, এমনকী, আমাদের উপরও খুব অত্যাচার করেছে। সেই সময় আদিল আর মনজুরের ভাই তৌসিফকে পুলিশ খুব অত্যাচার করেছে। মাঝেমধ্যেই তুলে নিয়ে যেত। ভয় দেখাত। বলত, তোদের দাদাকে বল আত্মসমর্পণ না করলে তোদের মেরে ফেলব। ওরা ভুলে যায়, যারা একবার বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে যায়, তাদের এভাবে ফেরানো যায় না। পরিবারের থেকে তখন জিহাদের গুরুত্ব অনেক বেশি। এভাবেই বুরহান ওয়ানি মারা যাওয়ার পর গোটা কাশ্মীর যখন জ্বলে উঠল, তখন আদিলের পায়ে গুলি লেগেছিল। ছ’মাসের উপর ও ভুগেছিল। হয়তো তখন থেকেই ওর মনটা বিষিয়ে গিয়েছে।”
এতদূর বলে আদিলের সমাধির দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা শ্বাস ফেললেন বৃদ্ধ আমজাদ। একটু থেমে বললেন, “জানেন সেই ভুল এখনও করে যাচ্ছে জওয়ানরা। একদিন স্কুলে যাচ্ছিল আদিলের ভাই ফারুক। ওর বন্ধুদের সামনে ওকে নাকে খত দেওয়ানো হয়েছে। কান ধরে ওঠবোস করিয়েছে। প্রতিজ্ঞা নেওয়ানো হয়েছে যে ও কখনও বন্দুক তুলবে না। ১২ বছরের বাচ্চাটা এসবের কী বোঝে বলুন তো! ওর মনেও কী এভাবেই বিষ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে না?” আদিলের বাড়ি থেকে স্টার্ট দিয়ে প্রায় মিনিট ১৫ পর গাড়ি উঠল ৪৪ নম্বর জাতীয় সড়কে। হাওয়াকে চুমু খেতে খেতে ডানদিকে ঘুরে শ্রীনগরের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলাম। গাড়িতে তখন পিন পড়লেও আওয়াজ হবে। সাবির ভাই বা আমি। কেউ কথা বলিনি এতটা পথ। উনি না হয় স্থানীয়– যন্ত্রণাটা ভালমতো টের পান। কিন্তু আমিও কেমন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। নিজেকেই প্রশ্ন করে বসলাম। সত্যিই নিজেদের অজান্তে এভাবে আমরা নিজেরাই জঙ্গি তৈরি করছি না তো? যে ভুলটা করেছিল প্যালেস্তাইন? ১২ বছরের শিশুর মুখ কীরকম দেখতে হয়? তাকে কি অনাগত দিনের জঙ্গি সন্দেহে অত্যাচার করা চলে? কিন্তু এ ঘটনা ঘটেছে, আমাদের দেশেই। কিছু কিছু প্রশ্নে প্রশ্নচিহ্ন বিস্ময়সূচকে পাল্টে যায়– এ পোড়া দেশে নিজেকে প্রশ্ন করলে হামেশাই এমনটা ঘটে, ঘটতে বাধ্য।
The post ‘চা খান, তবে প্রশ্ন নয়’, বললেন জঙ্গি আদিলের বৌদি appeared first on Sangbad Pratidin.