shono
Advertisement

প্রতিরক্ষায় স্বনির্ভরতা কি অধরা, সেনা সর্বাধিনায়কের পরিণতিতে উঠছে প্রশ্ন

ধুঁকছে প্রতিরক্ষামন্ত্রকের আওতায় থাকা সংস্থাগুলি।
Posted: 12:03 PM Dec 11, 2021Updated: 12:03 PM Dec 11, 2021

বিপিন রাওয়াতের মৃত্যু প্রশ্ন তুলে দিল, রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা চপার আমাদের দেশের সংবিধানের সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের ব্যবহার করতে হচ্ছে কেন? ভারত তার নিজস্ব চপারে প্রধানমন্ত্রীকে সফর করাতে পারে না কেন? স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও সামরিক ক্ষেত্রে নিজেদের অস্ত্র নিজেরা তৈরি করব এবং অন্যদের উপর নির্ভরশীল থাকব না- তেমন পরিস্থিতিই আমরা তৈরি করতে পারিনি। লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল

Advertisement

 

প্রয়াত বিপিন রাওয়াত রীতিমতো ঠোঁটকাটা মানুষ ছিলেন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, সম্প্রতি ভারতে যখন চিনের সেনাবাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটেছিল, সেই সময় জেনারেল রাওয়াত নানা মন্তব্য করে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন। চিন যখন ভারতের সঙ্গে মৈত্রীর ব্যাপারে মিষ্টি-মিষ্টি কথা বলছিল, নরেন্দ্র মোদি এবং চিনের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক কথাবার্তা শুরু হয়ে গিয়েছিল, তখন জেনারেল রাওয়াত বলেছিলেন, চিনের মতলব ভাল নয়। বলেছিলেন, চিন ভারতের মধ্যে ঢুকে পড়ে এক ধরনের ‘সালামি অপারেশন’ করছে, আর তার বদলা নিতে আমাদের দ্বৈত যুদ্ধ করতে হবে। একদিকে আমাদের যেমন পাকিস্তান সীমান্তে প্রস্তুত থাকতে হবে, অন্যদিকে চিন সীমান্তেও প্রস্তুত থাকতে হবে। কেননা, এবার লড়াইটা শুধু পাকিস্তানের সঙ্গে নয়, শুধু চিনের সীমান্তেও নয়, এবার চিন এবং পাকিস্তান একত্র হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে লড়বে। এই মন্তব্য করে জেনারেল রাওয়াত রীতিমতো সরকারিভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।

হেলিকপ্টার ভেঙে পড়ে আরও এগারো জনের সঙ্গে দেশের প্রথম ‘সিডিএস’-এর সস্ত্রীক মৃত্যু হল। দুর্ঘটনা কেন ঘটল, কীভাবে ঘটল, এসব এখনও সাধারণ মানুষের সামনে আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকে শুধু এইটুকু জানানো হয়েছে যে, তদন্ত শুরু হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী নিরাপত্তা-বিষয়ক ক্যাবিনেট কমিটির বৈঠক ডেকে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছে।

[আরও পড়ুন: বিতর্ক ছাপিয়ে ‘এভারেস্টের চূড়া’য় পৌঁছেছিলেন রাওয়াত]

এই ঘটনায় দেশের মানুষ সাংঘাতিক সংশয়ের মধ্যে রয়েছেন। প্রথমত, এটা দুর্ঘটনা, না কি অন্য কোনও গভীরতর ষড়যন্ত্র: তা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গিয়েছে চারদিকে। সাংবাদিক হিসাবে আমার মনে হয়, সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা নিয়ে এইরকম জল্পনা, গুঞ্জন একেবারেই কাম্য নয়। আবার, সরকারের পক্ষ থেকেও দায়িত্ব নেওয়া উচিত, যাতে এই ঘটনার অস্পষ্টতা নিরসন যত দ্রুত সম্ভব হয়। কেননা, সাধারণ মানুষ জানতে চাইছে, আসলে ব্যাপারটা কী হয়েছে?

নরেন্দ্র মোদি সরকার যে এই ঘটনার তদন্তে বিলম্ব বা গাফিলতি করবে, এমন আশঙ্কা কখনওই প্রকাশ করব না। কিন্তু দেশজুড়ে নাগরিক সমাজের দাবি, যতটা সম্ভব সতর্কতা এবং সক্রিয়তার সঙ্গে সব তথ্য মানুষের কাছে তুলে ধরা হোক। গণতন্ত্রে সেটাও কিন্তু অত্যন্ত আবশ্যিক এবং প্রয়োজনীয় একটি শর্ত। মানছি, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সেনা-সংক্রান্ত তথ্য সবসময় প্রকাশ করা যায় না, যা সরকার বারবার বলে থাকে। কিন্তু জেনারেল রাওয়াতের প্রাণহানি তো খুব সাধারণ ঘটনা নয়, রীতিমতো ব্যতিক্রমী ঘটনা। কাজেই দেশের সাধারণ মানুষের কাছে এই ঘটনার সমস্ত তথ্য তুলে ধরা প্রয়োজন।

এমন একতরফা একটা অভিযোগ করা হয় যে, সাধারণ মানুষ সবসময় ষড়যন্ত্রের তত্ত্বে বিশ্বাস করে। আমরা সমস্ত তথ্য না জেনেই নানারকমের ধারণার বশবর্তী হই, এগুলো হল এক ধরনের কু-সংস্কার, কখনও কখনও যাকে বলা হয় ‘মিথ’। কিন্তু এটাও তো সত্য যে, সমস্ত তথ্য যদি রাজার কাছে থাকে এবং সেই তথ্য যদি প্রজাদের জানানো না হয়- তাহলে নেতাজির অন্তর্ধান রহস্য নিয়েও তো জল্পনা থেকে যাবে! ৭০ বছর পরেও কেন নেতাজির আর্কাইভ থেকে সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হচ্ছে না বা হল না, তা নিয়ে প্রশ্ন সাধারণ মানুষ তা-ই তুলতেই পারেন।

জেনারেল রাওয়াতের এই মর্মান্তিক মৃত্যু প্রতিরক্ষামন্ত্রকের ক্ষেত্রেও কতকগুলো প্রশ্ন উত্থাপন করছে, যে-প্রশ্নগুলোর জবাব সরকার বাহাদুরকে দিতে হবে। যদিও আমি এক্ষেত্রে কংগ্রেস বা বিজেপি, অর্থাৎ কোনও রাজনৈতিক দলের প্রিজমে বিষয়টা দেখতে চাই না। তার কারণ, গত পাঁচ বছরে এই ধরনের দুর্ঘটনা একাধিকবার হয়েছে। রাশিয়া থেকে কেনা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক ট্রান্সপোর্ট কেরিয়ার MI-17V-5 চপার, অথচ একের পর এক ক্রাশ হয় কেন? আর ভারতের ‘চিফ অফ ডিফেন্স স্টাফ’ যখন এই চপারে সওয়ার হয়ে নিহত হন, তখন প্রশ্ন ওঠে যে, এটা কি নিছক দুর্ঘটনা, না কি কোনও যান্ত্রিক ত্রুটি? এটা কি আবহাওয়ার সমস্যা, কমিউনিকেশন ফেলিওর, না কি নেভিগেশন এরর? সবুজে-ঢাকা নীলগিরি পার্বত্য জোনে ঠিক কী হয়েছিল, তা নিয়ে তদন্ত শুরু হলেও, সেই তদন্তের রিপোর্ট যতদিন না আসবে- ততদিন চূড়ান্ত কোনও মন্তব্য করা যাবে না। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, এই চপারেই কিন্তু পাহাড়ি এলাকা সফর করেন দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই চপারেই কিন্তু সফর করেন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দও। সুতরাং, নিরাপত্তার জন্য এখনই অনেক বেশি সতর্ক হওয়া এবং যথোচিত ব্যবস্থা গ্রহণ আমাদের কর্তব্য।

মাত্র পঁচিশ দিন আগে ল্যান্ডিংয়ের সময় অরুণাচলে দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিল এমনই একটা MI-17। নেপথ্য কারণ জানতে গঠিত ‘কোর্ট অফ এনকোয়ারি’ সবেমাত্র তদন্ত শুরু করেছে। তার মধ্যেই আবার আর-একটা ঘটনা। একবার MI-17V-5 রহস্যজনকভাবে ভেঙে পড়েছিল জম্মু-কাশ্মীরের বদগঁাওয়ে। সেই ঘটনা এমন একটা সময় ঘটেছিল, যখন সীমান্তে চলছিল ভারত-পাক বায়ুসেনার তুমুল লড়াই। শত্রুপক্ষের ড্রোন ভেবে কি ভুল হয়েছিল? কিন্তু বিশেষ কপ্টার এয়ারফোর্সের অন্যতম আইকন MI-17 চিনতে তো ভুল হওয়ার কথা নয়! তাহলে? কাশ্মীরের পুলওয়ামায় আধা-সামরিক বাহিনীর কনভয়ে হামলা চালিয়ে ৪০ জন জওয়ানকে হত্যা করা হয়েছিল। ভারতীয় সেনা এবং বিমানবাহিনীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রত্যাঘাতের। সেই প্রত্যাঘাতই ছিল নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে পাক-অধিকৃত কাশ্মীরে গিয়ে সার্জিক্যাল স্ট্রাইক। সেদিনই, বেস থেকে টেক অফের কিছুক্ষণের মধ্যেই ভেঙে পড়েছিল MI-17V-5।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা এই চপার আমাদের দেশের সংবিধানের সর্বোচ্চ পদাধিকারীদের ব্যবহার করতে হচ্ছে কেন? ভারত তার নিজস্ব চপারে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে সফর করাতে পারে না কেন? আমরা যে স্বয়ংসম্পূর্ণ ভারতের কথা বলি, আমরা যে স্বাধীন ভারতের স্বদেশি দ্রব্যের কথা বলছি, তাহলে এখনও কেন প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে আমরা বিদেশি রাষ্ট্রের উপর এতটা নির্ভরশীল?

অরুণ জেটলি যখন প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন এবং নরেন্দ্র মোদি যখন সবে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, তখন অরুণ জেটলি একবার বলেছিলেন- আমাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রকের যে প্রায় আট-দশটা রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা আছে, সেগুলো এমনভাবে ধুঁকছে এবং তার অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এত খারাপ যে, অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার মতো সেগুলোকেও বিলগ্নীকরণ করে দিয়ে বেচে দেওয়াই ভাল। তার জন্য বেসরকারীকরণ করা প্রয়োজন। তখন সেই প্রস্তাবে নানা পক্ষ থেকে সমালোচনার ঝড় উঠেছিল। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে- সেই রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোকে প্রতিরক্ষামন্ত্রক গা থেকে ঝেড়ে ফেলতেও পারেনি, আবার বহু ক্ষেত্রে বেসরকারীকরণও হয়েছে। এখনও পর্যন্ত একটা বন্দুকও আমরা ঠিকমতো করে তৈরি করতে পারি না। সেজন্য রাশিয়া, ইজরায়েল, ফ্রান্স, আমেরিকা- এদের থেকে যুদ্ধাস্ত্র কিনেই চলেছি। নিন্দুকরা বলে যে, কেনা-বেচার ক্ষেত্রে অনেক রকমের প্রতিরক্ষা-দুর্নীতি আছে, ডিল হয়। অবশ্য কোনও প্রমাণ ছাড়া সেসব কথা আমাদের পক্ষে বলা সাজে না। কিন্তু এইটুকু তো বলতে পারি যে, স্বাধীনতার ৭০ বছর পরেও আমরা এখনও পর্যন্ত সামরিক ক্ষেত্রে নিজেদের অস্ত্র নিজেরা তৈরি করব এবং অন্যদের উপর নির্ভরশীল থাকব না- তেমন পরিস্থিতিই তৈরি করতে পারিনি।

কাজেই এইটুকু বলা যায়, এইরকম একজন শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তির ক্ষেত্রে যখন এই ধরনের ঘটনা ঘটে, তখন সেই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে আমাদের প্রতিরক্ষামন্ত্রককে আশু ভিত্তিতে আরও সাজিয়ে তোলা প্রয়োজন। রিপোর্ট সম্পূর্ণ প্রকাশ যদি না-ও হয়, অন্তত অনেকটা প্রকাশিত হবে- এমনটা আমরা আশা করব। আর আশা করব, আগামী দিনে যাতে এইরকম মৃত্যুসংবাদ আমাদের আর শুনতে না হয়।

[আরও পড়ুন: আম নাগরিকের নজরে আদালত সমস্যার সমাধান, নাকি খোদ সমস্যা?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement