ধীমান রায়, কাটোয়া: জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি অবস্থানে ঝুলে থাকতে হয়েছে একটানা ৪২ ঘন্টা। অবশেষে দেওঘরের ত্রিকূট পাহাড়ের সেই ‘মৃত্যু উপত্যকা’ থেকে প্রাণ হাতে করে বাড়ি ফিরেছেন কাটোয়ার অভিষেক নন্দন। বৃহস্পতিবার রাতে অভিষেক বাড়িতে ফেরার পর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন তাঁর বাবা এবং মা। ত্রিকূট পাহাড়ের রোপওয়ের ট্রলিতে ৪২ ঘন্টা কাটানোর ভয়ংকর স্মৃতি এখনও ঘুমোতে দিচ্ছে না অভিষেককে। ট্রলিতে বসেই অসহায়ভাবে তাঁকে দেখতে হয়েছে কীভাবে সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারের গেট থেকেই হাত ফস্কে পড়ে মৃত্যু হল একই ট্রলিতে থাকা চল্লিশোর্ধ্ব পর্যটকের।
কাটোয়ার ৫ নম্বর ওয়ার্ড এলাকার টাউন হল পাড়ার বাসিন্দা অভিষেক। কাটোয়ার কাছারিরোডে পারিবারিক ওষুধের দোকান রয়েছে তাঁদের। বাবা,মা ও এক ভাই নিয়ে চারজনের সংসার। ভাই অনুরাগ ভিনরাজ্যে বি ফার্ম পাঠরত। কার্শিয়াংয়ে পড়াশোনা করতেন অভিষেক। একসঙ্গে পড়াশোনার সুবাদে দেওঘরের বাসিন্দা নমন নীরজের সঙ্গে অভিষেকের পরিচয়। নমনের বাবা আয়কর দপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক। গত ৪ এপ্রিল অভিষেক ওই বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলেন ছুটি কাটাতে।
অভিষেক জানান, গত রবিবার রামনবমীর দিন বিকেল চারটের সময় ত্রিকূট পাহাড়ের রোপওয়েতে ওঠেন দুই বন্ধু। অপর প্রান্ত থেকে ফেরার সময় বিকেল পাঁচটা নাগাদ মাঝপথে থেমে গিয়েছিল তাঁদের ১৯ নম্বর ট্রলিটি। ট্রলিতে তখন চারজন। অভিষেক, নমন, এক মহিলা ও পুরুষ পর্যটক। অভিষেক বলেন,”আমাদের ট্রলি থেমে যাওয়ার পর প্রথম জেনেছিলাম যান্ত্রিক বিভ্রাট। তারপর রাত এগারোটা নাগাদ জানতে পারি দুর্ঘটনা ঘটেছে। রবিবার বিকেল থেকে একটানা আটকে ছিলাম। সকালের আলো ফোটার পর দেখতে পাই শুধু আমাদের ট্রলি নয়, রোপওয়েতে আরও বেশ কয়েকটি ট্রলি ঝুলে রয়েছে। সোমবার দুপুর থেকে উদ্ধারকাজ শুরু হয়।
[আরও পড়ুন: প্রেমিকের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে আদিবাসী নাবালিকাকে ‘গণধর্ষণ’, অভিযু্ক্ত ৫]
ত্রিকূট পাহাড়ে রোপওয়ে দুর্ঘটনায় ৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর মধ্যে একজন সেনাবাহিনীর উদ্ধার কাজ চলাকালীন প্রাণহানি হয়। ওই ব্যক্তিও ছিলেন অভিষেকদের ট্রলিতেই। সোমবার বিকেল নাগাদ ট্রলি থেকে বসে বসে ওই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখেছেন অভিষেক ও তাঁর বন্ধু। অভিষেক বলেন,”উদ্ধারকারীদের মধ্যে একজন এসে নিজেকে ট্রলির সঙ্গে হারনেসে বেঁধে আমাদের সঙ্গে বসে থাকেন। প্রথমে আমাদের ট্রলিতে থাকা মহিলাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়। দ্বিতীয়বার নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ওই ব্যক্তিকে। আমার চোখের সামনে ওই ব্যক্তি পড়ে গিয়ে মারা যান। তারপর আমরা ওই উদ্ধারকারী দলকে বলি আপনাদের সঙ্গে আমরা যাব না। প্রয়োজনে আরও একটা রাত কাটিয়ে দেব।” অভিষেক জানান, ওই কথা শোনার পর উদ্ধারকারী ওই দলটি ফিরে যায়। তারপর মঙ্গলবার অন্য একটি দল আসে। দুপুর নাগাদ তাঁদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হয়।
রবিবার বিকেলে রোপওয়েতে ওঠার সময় অভিষেক ও তাঁর বন্ধুর কাছে ছিল না খাবার ও পানীয় জল। সারা রাত আতঙ্ক নিয়ে ট্রলিতে সিঁটিয়ে বসে ছিলেন তাঁরা। অভিষেক বলেন,” তখন কেবল মনে হচ্ছিল এই বুঝি কি হয়। ঈশ্বরকে স্মরণ করা ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না।” তবে বৃহস্পতিবার রাতে বাড়ি ফেরেন অভিষেক। ছেলেকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পেয়ে আনন্দে কেঁদে ফেলেন বাবা-মা। শুক্রবার বছরের প্রথমদিনে নন্দন পরিবারে যেন খুশির হাওয়া। শিপ্রাদেবী বলেন,”ছেলে প্রথমে কিছু জানায়নি। তারপর টিভি এবং খবরের কাগজ পড়ে জানতে পারি। শুধু ভগবানকে স্মরণ করেছি যাতে ছেলে আমার সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে আসে।”