গৌতম ভট্টাচার্য: দিয়েগো আর্মান্দো মারাদোনা (Diego Maradona) এখন যেখানে যতদূরই পৌঁছে থাকুন, গ্যারি লিনেকারের শোকগাথা কানে গেলে দ্রুত চিড়বিড়িয়ে এই গ্রহে ফিরতেন! গোটা বিশ্বকে স্তম্ভিত করে মাত্র ৬০ বছর বয়সে এ দিন বুয়েনস আইরেসে মারাদোনা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করার পরও মনে হচ্ছে ইংরেজরা তাঁর সঙ্গে ‘ফকল্যান্ড যুদ্ধ’ চালিয়েই যাচ্ছে।
পৃথিবীর সর্বকালের শ্রেষ্ঠ তিনি কিনা সেই বিচার হয়তো আরও একশো-দু’শো বছর চলবে। কিন্তু ফুটবল সাম্রাজ্যের সর্বকালের সবচেয়ে আলোচিত নক্ষত্রের মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার এবং হপ্তাখানেক বাদে আজ কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মারা যাওয়ার পর গ্যারি লিনেকারের টুইট বিস্ময়কর। লিনেকার লিখছেন, “তর্কযোগ্যভাবে দিয়েগো পৃথিবীর সর্বকালের সেরা ফুটবলার। আমার প্রজন্মের সেরা তো বটেই। আশীর্বাদধন্য অথচ গোলমালে ভরা ব্যক্তিগত জীবন কাটিয়ে আশা করি এখন ও ঈশ্বরের হাতে শান্তিতে থাকবে।” ‘হ্যান্ডস অব গড’ শব্দটা লিখেছেন লিনেকার।অনেকের মনে হচ্ছে ফুটবল সমাজের তীব্র শোকযন্ত্রণার মধ্যেও এই ‘হ্যান্ড অব গড’ শব্দটা ব্যবহার করা ইচ্ছাকৃত এবং রুচিহীন ঠেস দেওয়া। মারাদোনা কলকাতা সফরে একান্ত ইন্টারভিউতে বলেছিলেন, “ইংরেজদের মজাটা কী জানেন? ওরা ইতিহাস যখন-তখন প্রয়োজন মতো ভুলে যেতে পারে। ছেষট্টির বিশ্বকাপ ফাইনালে চুরি করে দেওয়া গোলে জার্মানিকে ওরা হারিয়েছিল। আজও ভিডিওতে দেখবেন বলটা গোললাইন ক্রস করেনি। কিন্তু নিজের দেশে গোল নিয়ে নিয়েছিল। ওদের বিচিত্র ইতিহাস। যেখানে হ্যান্ড অব গড আছে, ছেষট্টির চুরিটা নেই।”
[আরও পড়ুন: প্রয়াত ফুটবলের রাজপুত্র দিয়েগো মারাদোনা, শোকস্তব্ধ বিশ্ব]
কোভিডে মারা যাননি দিয়েগো। অতিরিক্ত মাদক সেবনের জন্যও নয়। মস্তিষ্কে রক্ত জমাট বাঁধার সার্জারি হয়েছিল। হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ফেরার দু’সপ্তাহের মধ্যে অত্যন্ত ট্র্যাজিকভাবে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট এসে নিষ্ঠুরতম ট্যাকলে সরিয়ে দিল দিয়েগোকে। আর্জেন্টিনায় তিনদিন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষিত। বিশ্বব্যাপী ফুটবল ভক্তদের গ্রহে অবশ্য অনির্দিষ্টকালীন রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা হয়ে গেল। মারাদোনা তো শুধু ফুটবলার ছিলেন না। ছিলেন রক্তমাংসের ইতিহাস। তাঁর মৃত্যুর পর আর্জেন্টিনা (Argentina) প্রেসিডেন্ট আলবার্তো ফার্নান্ডেজ যেন সারা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের হয়ে বক্তব্য রেখেছেন। বলেছেন, “তুমিই সর্বকালের সেরা। আর এই পৃথিবীতে আমাদের সময় বাস করার জন্য তোমায় ধন্যবাদ।” বিশ্বের কোনও প্রান্তের কোনও ক্রীড়াবিদ তাঁর রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে এমন আবেগে রক্তমাখা শোকগাথা পেয়েছেন?
কিন্তু দিয়েগোর পৃথিবী তো বরাবর তাই। একবার লিনেকার পরমুহূর্তেই আলবার্তো। এই কেলেঙ্কারি। পরমুহূর্তেই গৌরব। আর্জেন্টিনার ভিলা ফ্লোরিতোর বসতি থেকে উঠে আসা এক কিশোর গত চল্লিশ বছরে বিশ্বকে ঘুরপাক খাইয়ে দিয়েছে তাঁর শিল্পের আগুনে। কিন্তু এমনই আগুন যা অসামান্য আতশবাজির মতো জ্বলেও আকস্মিক আত্মবিস্ফোরণে নিজেকেই ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। যেমন নৈপুণ্যের সিংহাসনে ছিনিয়েছে। তেমনই নিজের ভুলে রিক্ত হয়ে চলে গিয়েছে।
ফুটবল ভক্তদের অবশ্য তাতে কিছু আসে যায়নি। তাদের মনে হয়েছে এই লোকটা তো কমিউনিজমের জীবন্ত দৃশ্যায়ন। এর জীবনের নায়ক যে ফিদেল কাস্ত্রো হবেন তাতে আর আশ্চর্য কী। বিশ্বব্যাপী ক্রীড়া মনোবিদরাও বহুবার মনে করেছেন মারাদোনা হলেন তাঁদের আদর্শ সাবজেক্ট। এই সাদা এই কালো। এখনই ফুর্তির ফানুসে সবার চোখমুখ উজ্জ্বল করে দিচ্ছেন। পরমুহূর্তেই এমন একটা কাণ্ড করে বসছেন যেটার জন্য সবচেয়ে বড় সমর্থকেরও লজ্জায় মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। একা মারাদোনা বাংলা-সহ পৃথিবীর বিভিন্ন শহরে ব্রাজিলের ভোটব্যাঙ্ক কেড়ে নিয়েছেন। হলুদ জার্সির পাশে ডগমগিয়ে বসিয়ে দিয়েছেন নীল-সাদা আর্জেন্টিনীয় জার্সিকে। অথচ পরমুহূর্তে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনের মতো আচরণ করছেন যে, তাঁর কোনও আইনজীবী পাওয়া যাচ্ছে না।
[আরও পড়ুন: চিরতরে বিদায় নিল ‘হ্যান্ড অফ গড’, টুইটে শেষ শ্রদ্ধা সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, রাহুল গান্ধীদের]
তিনি তিন বছর আগে শেষ কলকাতায় এলেন। ইমিগ্রেশন কাউন্টার থেকে বিনা প্ররোচনায় ঝামেলা শুরু করে দেন। ম্যানেজারের মুখে জানা গেল যে দুবাই-কলকাতা ফ্লাইটে বেশি ওয়াইন খেয়ে আউট হয়ে গিয়েছেন। তখনই মনে হল ২০০৭ থেকে অ্যালকোহল রিহ্যাবে এত বছর কাটালেন, তার ফল কী হল? দিয়েগো প্রচণ্ড জোরে কথা বলতে শুরু করলেন। ইমিগ্রেশন কাউন্টারে আঙুলের ছাপ দিতে রাজি হচ্ছেন না। বলছেন, “ছবি তোলার জন্য টুপি খুলতে পারব না।” মারাদোনার সফরসঙ্গী বান্ধবী পিঠে তীব্র চাপড় মারলেন, “চলো এখান থেকে।” ততক্ষণে সিন ক্রিয়েট হয়ে গিয়েছে। লোক গিয়েছে জমে। দিয়েগো এ বার চিৎকার শুরু করলেন, “ইন্ডিয়া নো গুড। দুবাই দুবাই।” কোনওরকমে বুঝিয়েসুজিয়ে তাঁকে ভিতরে আনা হল। এবার হঠাৎ এক কিশোর এসে দৌড়াতে দৌড়াতে অটোগ্রাফ খাতা এগিয়ে দিল। একে কি লাথিটাথি মারবেন? যা উগ্র মেজাজে আছেন। দিয়েগো কী করলেন? না, পরম স্নেহে জড়িয়ে ধরলেন। আসলে বরাবরই এ রকম। এই তিনি ভিলা ফ্লোরিতোর বস্তি। পাঁচ বাই পাঁচ ঘরের আবর্জনা। পরমুহূর্তেই স্বপ্নালু টানে আল্পসের পর্বতমালা। এত বড় ক্রীড়াবিদ এই রকম কন্ট্রাডিকশন নিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে জন্মেছে বলে মনে হয় না। মাত্র ৬০ বছর বয়সে মেসি-রোনাল্ডোদের সৌরজগৎ স্তব্ধ করে দিয়ে এ ভাবে চলে যাওয়ার সঙ্গে তুলনীয় কী হয়? হলিউডে মাইকেল জ্যাকসনের ৫১ বছর বয়সে চলে যাওয়া!
[আরও পড়ুন: সাফল্য, ব্যর্থতা, বিতর্ক, মারাদোনার বর্ণময় জীবনের এই ঘটনাগুলি জানেন?]
বিশ্বফুটবল ইতিহাস শুধু নয়। গোটা ক্রীড়াবিশ্বে একটা চিরন্তন কেস স্টাডি হয়ে থেকে যাবেন মারাদোনা। গরিবের জন্যে লড়েছেন। তৃতীয় বিশ্বকে সিংহাসনে বসিয়েছেন। ইংরেজদের অত্যাচারী প্রভুত্ব কখনও মেনে নেননি। এসব দিক দিয়ে তিনি মহম্মদ আলির সঙ্গে তুল্য। আবার যখনই মনে হয় তাঁর ড্রাগ কেলেঙ্কারির কথা। সাংবাদিকদের দিকে তাক করে এয়ারগান ছোড়া। বিশ্বকাপে ডোপিংয়ে ধরা পড়া। ইটালীয় মাফিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব বাধানো। কোন কুকর্মটা করেননি। পেলেকে কখনও এক নম্বর মানেননি। বলেছেন, “ব্রাজিলের ওপিনিয়ন পোলেই ও জিততে পারে না তো আমাকে কী হারাবে।” তখন মনে হয়েছে অন্তত সোফিসটিকেশনে পেলে তাঁর কয়েকশো মাইল আগে। ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো নিজেকে বিশ্বসেরা বলেছেন সেই ব্যাপারে কলকাতা সফরে প্রতিক্রিয়া চাওয়ায় প্রবল হেসে বলেছিলেন, “রোনাল্ডো আগে মেসিকে হারাক। তারপর আমার কাছে আসবে।” পরবর্তী সময়ে আবার উদোম গালাগাল করেছেন মেসিকে। ডেভিড বেকহ্যাম কত বড় ফুটবলার জিজ্ঞেস করায় বলেছেন, “ওকে খুব সুন্দর দেখতে।” মনোবিদরা তখনও বলেছিলেন ইগো ম্যাচিওরিটির অভাবে এটা হচ্ছে। জিনিয়াস হয়েও তাই নিজের ভার বইতে পারেন না। থেকে যান ফ্লড জিনিয়াস। মরণোত্তর এ সব শুনলেও মারাদোনার কিছু আসত-যেত বলে মনে হয় না। তিনি বরং বলতেন হাসপাতালে ব্রেন অপারেশনের পরও তাঁর অ্যাম্বুল্যান্সটা আগাগোড়া আর্জেন্তিনীয় মিডিয়া কীভাবে ফলো করেছিল। শেষ বিশ্বকাপ খেলেছেন ছাব্বিশ বছর আগে। তারপরও বিশ্বব্যাপী পাপারাৎজির প্রথম ও শেষ লক্ষ্য তিনি। তা হলে কোথায় মেসি? কোথায় রোনাল্ডো? কোথায় পেলে? লিনেকার ব্যঙ্গ করতে গিয়ে একটা ভুল করেছেন। ঈশ্বরের হাতে তিনি সমর্পিত নন। নাহ, ফুটবলের ঈশ্বর স্বর্গে গিয়েছেন ঈশ্বরের সঙ্গে দেখা করতে। ঈশ্বর যে তাঁকেই বেছেছেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীদের নয়।