বিশ্বদীপ দে: মহাভারতের একেবারে শুরুতেই কুলপতি মহর্ষি সৌতি জানিয়েছিলেন, মহাভারতের (Mahabharat) কাহিনি এর আগেও অন্যরা বলেছেন। আবার ভবিষ্য়তেও অন্যরা বলবেন। একথা কেবল মহাভারত নয়, রামায়ণের (Ramayana) ক্ষেত্রেও একথা প্রযোজ্য। আসলে মহাকাব্যের বৈশিষ্ট্যই যে তাই। যুগে যুগে দেশকাল তাকে নিজের মতো করে গড়ে তুলবে। এই বিভিন্ন সংস্করণগুলির কথা ভাবতে বসলে সত্য়িই অবাক হতে হয়। চেনা কাহিনি কীভাবে বদলে বদলে গিয়েছে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির আঁচে! কীরকম পরিবর্তন? একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। রামায়ণের এমন সংস্করণের হদিশও মেলে, যেখানে রাবণ সীতার বাবা! জন্মের পরই নিজের শিশুকন্যাকে মাটিতে পুঁতে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন লঙ্কাধিপতি। এমনকী সীতার জন্মকাহিনিও আলাদা।
শুনতে যতই অবাক লাগুক, গুণভদ্রর উত্তর পুরাণ, জৈন রামায়ণ ও অদ্ভুত রামায়ণের কাহিনি কাঠামো সেরকমই। কী সেই কাহিনি? সেখানে বলা হয়েছে, রাবণ ও মন্দোদরীর সন্তান সীতা। কিন্তু জন্মের পরেই জ্যোতিষীরা বলেন, এই কন্যাই হবে রাক্ষসরাজ রাবণের মৃত্যুর কারণ। শোনার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি নির্দেশ দিলেন এই মেয়েকে ঝুড়িতে রেখে মাটির তলায় পুঁতে দিতে হবে। তাই করা হয়। তারপর একসময় রাজা জনক ভূমিকর্ষণ করতে গিয়ে লাঙলের রেখায় খুঁজে পান সীতাকে। এযাবৎ ৩০০টি রামায়ণের সন্ধান মিলেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ২২টি আলাদা ভাষায় লেখা অন্তত ৩ হাজার রামায়ণের সংস্করণ রয়েছে। বাল্মীকি রচিত মূল রামায়ণের এমনই নানা বিনির্মাণ লক্ষিত হয় এই ভিন্ন ভিন্ন রামায়ণে।
[আরও পড়ুন: বিনিয়োগকারীদের ধাক্কা, রেকর্ড পতন এলআইসির শেয়ারে]
বেলজিয়াম থেকে ভারতে আসা যাজক কামিল বুল্কে দীর্ঘদিন ধরে রামায়ণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তাঁর লেখা ‘রামকথা: উৎপত্তি অউর বিকাশ’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ”এটা সর্বজনবিদিত যে রামের জীবন নিয়ে প্রথম গ্রন্থটি মহর্ষি বাল্মিকীই লিখেছেন। কিন্তু রামের উল্লেখ প্রথম ওই বইতেই পাওয়া যায় তা নয়। ঋগ্বেদের একটি অংশে রামের নাম উল্লিখিত হয়েছে এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ ও ধার্মিক রাজা হিসেবে।” কেবল রাম নয়, সীতার নামও পাওয়া যায় ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে। সেখানে কৃষির দেবদেবীর উদ্দেশে যে প্রার্থনা লিখিত আছে, তাতেই প্রথম সীতার নাম পাওয়া যায়। এছাড়াও ৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা ‘দশরথ জাতক কথা’ কাহিনিতেও রয়েছেন সীতা।
পরবর্তী সময়ে আনুমানিক ২ হাজার ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মহর্ষি বাল্মিকী রামায়ণ লেখেন। আর পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে বারবার বদলে বদলে গিয়েছে রামায়ণের কাহিনি। যেমন কম্ব রামায়ণে রাবণ লক্ষণরেখা অতিক্রম করেননি। একেবারে কুটির সমেতই সীতাকে হরণ করে নিয়ে যান। আবার অশোকবনে সীতার সঙ্গে হনুমানের সাক্ষাতের পরে স্বর্ণলঙ্কা দহনের যে কাহিনি তা নেই চতুর্দশ শতাব্দীতে লেখা আনন্দ রামায়ণে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, অশোকবনে বসে থাকা সীতা ক্ষুধার্ত হনুমানের হাতে নিজের হাতের অলঙ্কার দিয়ে বলছেন, সেটি বিক্রি করে লঙ্কার কোনও দোকান থেকে ফল কিনে খেতে।
[আরও পড়ুন: কলম ছেড়ে ধরেছিল বন্দুক, আদালতে দোষী সাব্যস্ত আইএস জঙ্গি সেই মার্কিন শিক্ষিকা]
জাভার সেরিরাম রামায়ণে আবার রাবণ বিভীষণের উপরে ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁকে সমুদ্রে ছুঁড়ে ফেলে দেন। তিনি এক কুমিরের পিঠে চড়ে বসেন। পরে হনুমান তাঁকে উদ্ধার করে রামের কাছে নিয়ে যান। এবং যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই রাম বিভীষণকে লঙ্কার পরবর্তী রাজা হিসেবে ঘোষণা করেন। তখন হনুমান তাঁর জন্য তৈরি করেন বালির তৈরি লঙ্কা। বলা যায় প্রতীকী লঙ্কা। সেই লঙ্কার নাম ‘হনুমন্লঙ্কা’।
জৈন রামায়ণে আবার বদলে গিয়েছে রাবণ বধের আখ্যান। যেহেতু সেখানে অহিংসাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে, তাই সেখানে দেখানো হয়েছে রাবণ রামের হাতে প্রাণ হারাননি। হারিয়েছেন লক্ষ্মণের হাতে। লক্ষ্মণও সেখানে লক্ষ্মণ নন, তিনি বাসুদেব। রাবণকে বধ করে তাঁকে উদ্ধার করলেও এই হত্যার কারণেই লক্ষ্মণকে নরকে যেতে হয়েছিল। অন্যদিকে রাম নির্বাণ লাভ করেন হিংসার পথে না যাওয়ার জন্য। ৭৩২ থেকে ১০০৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে লেখা হয়েছিল কাকাউইন রামায়ণ। সেই রামায়ণে দেখা যায় সীতা এক সাহসী, শক্তিশালী রমণী। রাম তাঁকে এসে উদ্ধার করবেন, সেজন্য অপেক্ষা না করে তিনি নিজেই যুদ্ধ করেন রাবণের বাহিনীর সঙ্গে।
এই ভাবেই ভারতের নানা প্রদেশে তো বটেই, নেপাল, বর্মা, জাপান, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্সের মতো দেশগুলিতেও রামায়ণের নানা চেহারা। কাহিনি কাঠামোর বদল করে তার মধ্যে সেই সব দেশের সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞানও নিজের জায়গা করে নিয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রেই মূল অনুপ্রেরণা হয়ে কিন্তু রয়ে গিয়েছে বাল্মিকীর রামায়ণই। অশুভের উপরে শুভ, অধর্মের উপরে ধর্মের বিজয়ী হওয়াই যে কাহিনির মূল বার্তা।
আজকের ভারতে রামকে ঘিরে তৈরি হওয়া রাজনৈতিক ডিসকোর্সকে মাথায় রেখেই বলা যায়, রামায়ণ কিন্তু কেবল মাত্র ধর্মকথা নয়। তা এক মহৎ সাহিত্যও বটে। যার কাহিনি এবং তার মধ্যে নিহিত দর্শন ও জীবনধর্মের আবেদন অনস্বীকার্য। তাই তাকে নিজের নিজের মতো করে গ্রহণ করেছে ভিন্ন দেশ ও ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষ। হয়ে উঠেছে গোটা উপমহাদেশের সংস্কৃতির অপরিহার্য প্রতীক।