হাতে মোবাইল থাকলেই যেন যত সুখ। কিন্তু এই সুখই হতে পারে আপনার অসুখের কারণ। কীভাবে? জানালেন এন্ডোক্রিনোলজিস্ট ডা. নীলাঞ্জন সেনগুপ্ত। তাঁর কথা লিপিবদ্ধ করলেন জিনিয়া সরকার।
২৫ বছরের তন্ময়। কিছুদিন আগেই চিকিৎসা করাতে আসে আমার কাছে। তাঁর হঠাৎ করেই চেহারা ভাঙতে শুরু করে। বেশ গাট্টাগোট্টা চেহারার ছেলেটি হঠাৎ করেই অসম্ভব ক্লান্তি, জিভ শুকিয়ে যাওয়া ও মাথাঘোরার সমস্যায় কাবু। সুগার টেস্ট হল। রিপোর্ট দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ। ব্লাড সুগার ৩১০। কী করে? পরিবারের কারও ডায়াবেটিসও নেই। তাহলে কীভাবে?
নানা কথায় এটাই বোঝা যায়, তন্ময় নাকি বাড়ি থেকে বেরতেই চায় না। কারও সঙ্গে মন খুলে কথা বলতেও অনীহা। ভীষণ একগুঁয়েমি, সঙ্গে সারাক্ষণ সোশাল মিডিয়ার ঘেরাটোপেই থাকে। এই জগতের বাইরে নাকি ওর আর কোনও জগৎ নেই। পড়াশোনা শেষ করে এখনও চাকরি পায়নি। তাঁর যাবতীয় চেষ্টা থেকে নিজের বিনোদন সবকিছুই ঠায় বসে, বদ্ধ ঘরেই উপভোগ করছে। ডিজিটাল মাধ্যমে নিজেকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রেখেছে। এটাই কাল হয়েছে।
আর শরীরে বাসা বেঁধেছে ডায়াবেটিস।
এই সোশাল মিডিয়া বা মুঠোফোনে আসক্তি কিন্তু আট থেকে আশি সকলের ক্ষেত্রেই ডায়াবেটিসের একটি অন্যতম কারণ। ব্রিটিশ মেডিক্যাল জার্নালের তথ্য, যারা সারাদিনে তিনঘণ্টার বেশি সময় বসে টিভি দেখে, ভিডিও গেম খেলে তাদের একদিকে যেমন বডি ফ্যাটের মাত্রা বাড়তে থাকে অন্যদিকে ইনসুলিন হরমোন রেজিস্ট্যান্স হতে শুরু করে। আসলে রক্তে ইনসুলিন হরমোন আমাদের শরীরে সুগারকে এনার্জিতে পরিণত করে। অগ্ন্যাশয় থেকে নিঃসৃত এই হরমোন রেজিস্ট্যান্স হয়ে গেলে তা রক্তে সুগারের মাত্রা বাড়ায়।
[আরও পড়ুন: অল্টম্যানের প্রত্যাবর্তন! চ্যাটজিপিটির স্রষ্টাকে ফেরাতে আলোচনা শুরু ‘ওপেন এআই’ বোর্ডে]
আসক্তি কখন অস্বস্তির কারণ
সারা দিন ধরে যদি সোশাল মিডিয়ায় কেউ মজে থাকেন সেক্ষেত্রে তাঁর শারীরিক নানা সমস্যার পাশাপাশি মানসিক অস্থিরতাও প্রকাশ পায়। এখন স্ক্রিন টাইম অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। বিশেষত বাচ্চাদের মধ্যে এই প্রভাব মারাত্মক। বাইরে বা খেলার মাঠে দৌড়ঝাঁপ না করে সারাক্ষণ বসে বসে শরীরে রোগ ডেকে আনছে। ফেসবুক, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ সব কিছুর যেমন ভালো দিক রয়েছে, তেমনই এগুলির দীর্ঘ ব্যবহারে ক্ষতি হচ্ছে। এমনকী ঠায় বসে অফিসের কাজ করে যাওয়াও এখন ভীষণভাবে অ্যালার্মিং।
স্ক্রিন টাইম যেমন বাড়ছে, তেমনই সারাক্ষণ সেই স্ক্রিনে কী দেখছেন সেটার উপরও নির্ভর করে শরীরে ও মনে তার প্রভাব। যেমন ধরুন, অনেকেই রয়েছে যাঁরা সবসময় বিভিন্ন ফুড ফ্লগ দেখেন, রান্না, লোভনীয় খাদ্য ইত্যাদি দেখতে থাকলে সেগুলি খাওয়ার ইচ্ছেও বাড়ে। এই কারণেই বর্তমানে সকলের মধ্যেই জাঙ্কফুড খাওয়ার প্রবণতা ভীষণভাবে বেড়েছে। যা ওজন বৃদ্ধির অন্যতম কারণ, ফলে রক্তে সুগার ও কোলেস্টেরলের মাত্রাও বাড়ছে। আবার অন্যভাবে ভাবলে, যদি আমরা সারাক্ষণ মুঠোফোনে বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বুঁদ হয়ে থাকি সেক্ষেত্রে আমাদের নিত্য খাদ্যাভ্যাসও নানা কারণে ব্যাহত হয়। অসময়ে খাওয়ার অভ্যাস তৈরি হয়, অজান্তেই বেশি খেয়ে ফেলেন অনেকেই, উপযুক্ত সময়ে সঠিক খাবার খাওয়ার প্রবণতা কমতে থাকে। এগুলো সবই কিন্তু পরোক্ষভাবে শরীরের ইনসুলিন হরমোনের উপর প্রভাব ফেলে।
অনেক রাত পর্যন্ত স্ক্রিন টাইম চলতে থাকলে তৈরি হয় ফোটিক স্টিম্যুলেশন অর্থাৎ চোখে একটি উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এতে করে একজনের যে স্বাভাবিক স্লিপ সাইকেল থাকে সেটা ধীরে ধীরে বিনষ্ট হতে শুরু করে। অপর্যাপ্ত ঘুম বা ইনসমনিয়া কিন্তু ডায়াবেটিসের অন্যতম একটি কারণ। নিত্য ডায়াবেটিক নিয়ে যত রোগী আসেন তাঁদের একটা বড় সংখ্যকের অভিযোগ, তাঁদের ঘুম হয় না ঠিক মতো। এও দেখেছি, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশেরই স্ক্রিন টাইম চলে অনেক রাত পর্যন্ত। অপর্যাপ্ত ঘুম থেকে সেরাটোনিন, ডোপামিন হরমোনে অসামঞ্জস্য শুরু হয়। ভাল ঘুম হলে হরমোন্যাল সমস্যাগুলি রিপেয়ার ঠিকমতো হয়, শরীর ভালো থাকে।
ডায়াবেটিক এক ধরনের মেটাবলিক ডিজিজ। এটা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রত্যেক দিন ৬-৮ ঘণ্টা পর্যাপ্ত ঘুম জরুরি। অন্যদিকে, অতিরিক্ত ঘুমও আবার ভালো নয়। বিশেষত দুপুরে পেট ভরে খেয়ে টানা ঘুমোনো থেকে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। ৯-১০ ঘণ্টা টানা ঘুমোতে থাকলে, সারাদিন শুয়ে থাকলে চিন্তার।
বর্তমানে মানুষ সারাক্ষণ সিরিজে মগ্ন। ফ্রি টাইমেও একে-অপরের সঙ্গে গল্পগুজব না করে, হাসি-ঠাট্টা না করে চোখ আটকে ফোনের স্ক্রিনে। বিনোদন জগতে মজে মন। চলছে একের পর এক এপিসোড। এটা কিন্তু মনের উপর অত্যন্ত চাপ ফেলে। বর্তমানে অধিকাংশ সিরিজই খুবই আক্রমণাত্মক। এগুলি মানসিকভাবে খুব একটা রিলিফ দেয় না। বরং মনে চাপ সৃষ্টি করে, উদ্বেগ বাড়ায়, ডিপ্রেশন বাড়ায়। অন্যদিকে, সারাক্ষণ রিলস, ডিপিতে কত লাইক-শেয়ার হচ্ছে চলছে তার প্রতিযোগিতা।
এতে করে ভালোর বদলে খারাপই হয়। স্ট্রেস হরমোন যেমন, কর্টিজল, অ্যাড্রিনালিন হরমোন স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রার বেরতে শুরু করে। যা ধীরে ধীরে কোলেস্টেরল, রক্তচাপ বাড়ায়। ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয়ে রক্তে সুগারের মাত্রাও বাড়তে শুরু করে। এছাড়াও ফ্যাটিলিভারের ঝুঁকিও বাড়ে। মনে রাখুন, আজকের দিনে মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদি ছাড়া চলা মুশকিল। তবে এটা নেশায় পরিণত হলে চলবে না। এই নেশাও কিন্তু একাধিক অসুখের কারণ। তাই বুঝে ব্যবহার করুন। শিশুদের মধ্যেও এর ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখুন।