গৌতম ব্রহ্ম: সাধারণ মানুষের প্লীহার (স্প্লিন) ওজন মোটামুটি দু’শো গ্রামের আশপাশে থাকবে, এটাই নিয়ম। কিন্তু সেটা যদি সাড়ে তিন কেজি হয়ে যায়? তা-ই হয়েছিল স্বরূপনগরের মেয়েটির। দৈত্যাকার রূপ ধরে আগ্রাসী প্লীহা রক্ত চুষে খেয়ে ছিবড়ে করে দিচ্ছিল শরীরকে। দমবন্ধ হয়ে নাভিশ্বাস অন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের। ডায়াফ্রামে চাপ সৃষ্টি করে ফুসফুসের কাজেও দুর্দম ব্যাঘাত। পাশাপাশি হিমোগ্লোবিন ও প্লেটলেট দুয়ের হু হু অধোগমন, সামান্য আঘাতে রক্তক্ষরণ হয়ে প্রাণসংশয়ের শঙ্কা পদে পদে। প্লীহা বাদ দিয়ে এমনই সংকটাপন্ন রোগীকে কার্যত পুণর্জন্ম দিল এনআরএস (NRS) হাসপাতাল।
এর জন্য অবশ্য কাঠখড় কম পোড়াতে হয়নি। অস্ত্রোপচারের (Operation) আগে পরে পাঁচ বোতল রক্ত দিয়ে রক্তকণিকাগুলির মধ্যে ভারসাম্য আনতে হয়েছে। এমনকী, কাটতে হয়েছে ডায়াফ্রামও। এত কিছুর পরই জীবন ফিরে পেয়েছেন ওই তরুণী।
[আরও পডুন: নন্দীগ্রামে জখম মুখ্যমন্ত্রী: রিপোর্টে ‘অস্পষ্টতা’, ফের জবাব তলব কমিশনের]
পর্ণশ্রী ঢালি। বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগরে। তিরিশ বছরের তরুণী তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থায় কাজ করতেন। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত। সম্প্রতি শারীরিক অসুস্থতার জন্য চাকরি ছাড়তে হয়। হিমোগ্লোবিন ছ’য়ের নিচে নেমে গিয়েছিল। প্লেটলেট নেমে গিয়েছিল ২০ হাজারে। প্লীহার আকার বাড়তে বাড়তে সাড়ে তিন কেজি ওজন হয়ে গিয়েছিল। পাথর জমেছিল পিত্তথলিতে। বেড়ে গিয়েছিল লিভারও। এতগুলি সমস্যার সঙ্গে যুঝে অস্ত্রোপচার করাটা শুধু ঝুঁকিরই নয়, কঠিনও। কিন্তু একপ্রকার চ্যালেঞ্জ নিয়েই সেই কাজটা করে ফেললেন এনআরএসের ডাক্তারবাবুরা।
১৫ ফেব্রুয়ারি পর্ণশ্রীকে ভরতি করা হয়। ডাক্তারবাবুরা পরীক্ষানিরীক্ষা করে বুঝতে পারেন, একটা নয়, একাধিক রোগে ভুগছেন পর্ণশ্রী। অস্ত্রোপচার করতে গেলে আগে রক্তে হিমোগ্লোবিন ও প্লেটলেটের মাত্রা স্বাভাবিকের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। পর্ণশ্রী জানালেন, “প্লীহা এতই বড় হয়ে গিয়েছিল যে সামান্যতম আঘাতেও রক্তক্ষরণ হয়ে মারা যেতে পারতাম। তার উপর গলব্লাডারে সমস্যার কারণে পেটের গোলযোগ শুরু হয়েছিল।” ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্ণশ্রীর অস্ত্রোপচার হয়। প্লীহা বাদ দেওয়া হয়েছে। এত বড় প্লীহা বাদ দেওয়ার নজির বিরল। এমনটাই দাবি করলেন এনআরএসের সার্জারি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. ঋতঙ্কর সেনগুপ্ত। অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক জানালেন, “প্লীহা অতিরিক্ত বড় হয়ে ডায়াফ্রামের সঙ্গে আটকে গিয়েছিল। ডায়াফ্রাম কেটে অপারেশন করতে হয়েছে। সেই সঙ্গে বাদ দিতে হয়েছে গলব্লাডারও। অস্ত্রোপচার সফল।” ঋতঙ্করকে সহযোগিতা করেছেন ডা. সুচেতা সরকার, ডা. বিধায়ক সরকার, ডা. সহবাজ আহমেদের মতো চিকিৎসকরা।
[আরও পডুন: ভোটের মুখে বড় চমক! তৃণমূলে যোগ প্রাক্তন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিনহার]
এনআরএসের হেমাটোলজি বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক ডা. প্রান্তর চক্রবর্তী জানালেন, “পাঁচ বছর আগেও ৪০ শতাংশ থ্যালাসেমিয়া রোগীর প্লীহা কেটে বাদ দেওয়া হত। পরে ধারণা বদলায়। কারণ প্লীহা শুধু রক্ত ধ্বংস করে তা নয়, অনেক ক্ষতিকারক জীবাণুকে মেরে জীবণধারণের ঝুঁকি কমায়। এই তরুণীর ক্ষেত্রেও থ্যালাসেমিয়া চিকিৎসা, রক্ত দেওয়া ঠিকমতো হয়নি। না হলে প্লীহা এত বড় হত না।” প্রান্তরবাবুও স্বীকার করে নিলেন, ডায়াফ্রাম কেটে এত বড় প্লীহা অস্ত্রোপচার করা শুধু বিরলই নয়, প্রশংসনীয়। সবথেকে তাৎপর্যের এই গোটা অস্ত্রোপচার পর্ব সারতে বেসরকারি ক্ষেত্রে কয়েক লক্ষ টাকা। কিন্তু, সরকারি হাসপাতাল হওয়ায় পর্ণশ্রীর একটিও টাকা লাগেনি।