নির্মল ধর: ধর্ম-ধর্মান্ধতা-ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষ এখন এই দেশের ‘কল অফ দ্য ডে’। বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনা ধুয়েমুছে সাফ করার এক সামগ্রিক পরিকল্পনা সারা দেশ জুড়ে। ভিন্ন চিন্তার যেন কোনও স্থান নেই। প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করার ষড়যন্ত্র চারদিকে। এমন সর্বগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে সত্যিই এক জ্বলন্ত প্রতিবাদ হয়ে কলকাতার মঞ্চে এল ‘অ-পবিত্র’। ‘নাট্যআনন’-এর প্রযোজনায় এই নাটক তুলে ধরল এদেশের নয়, খোদ আমেরিকায় প্রায় একশো বছর আগে চার্চ পোষিত বিচার ব্যবস্থার ভয়ংকর একটি দিক। প্রকারান্তরে ওই ঘটনার সঙ্গে আজকের ভারতের সাদৃশ্য চোখে পড়ার মতো। বিদেশি নাটকটির ভাবানুবাদক এবং পরিচালক চন্দন সেন সত্যিই একটি সামাজিক দায়িত্ব পালন করলেন। এবং একইসঙ্গে আটের দশকে শম্ভু মিত্র-রুদ্রপ্রসাদ-অজিতেশদের কম্বিনেশন স্মৃতিও ফিরিয়ে আনলেন। একই মঞ্চে সব্যসাচী চক্রবর্তী-অসিত বসু মুখোমুখি ভাবা যায় না! তার ওপর শান্তিলাল-চন্দন জুটি আছেন, রয়েছেন ভদ্রা বসুও।
১৯২৬ সালে ওরিগন রাজ্যের মাঝারিমাপের শহর হিলসবোরোয় তরুণ স্কুল শিক্ষক বার্ট্রাম ছাত্রদের বাইবেল শেখানোর পরিবর্তে ডারউইনের বিবর্তন পড়ান। কচি মনের ওপর বিজ্ঞান শিক্ষার ভিত তৈরি করাতে চান তিনি। মহামতি যিশুক্রিস্টের জীবনযাপন ও পবিত্র বাইবেল সরিয়ে এমন বিজ্ঞান শিক্ষাকে শহরের যাজক, গির্জা এবং কিছু তথাকথিত ধর্মপ্রাণ মানুষ মানতে পারেনি। আদালতে বার্ট্রামের বিরুদ্ধে বাইবেল এবং ধর্ম বিরোধিতার মামলা ঠুকে দেয় তারা। সেই মামলা লড়তে বাদী পক্ষের হয়ে আসেন বিখ্যাত যাজক-কাম-উকিল হ্যারিসন ব্রাডি। আর তাঁর বিরুদ্ধে বার্ট্রামের হয়ে দাঁড়ান দুঁদে এবং যথেষ্ট বুদ্ধিধর বাগ্মী উকিল হেনরি ডুর্মন্ড। পাশে থাকেন একজন রসিক এবং সাহসী সাংবাদিক হর্নবেক।
[ পঞ্চমের পাশেই স্থান দুই কিংবদন্তীর, শচীন ও কিশোরের মূর্তি বসছে শহরে ]
ছয়টি দৃশ্যে বিভক্ত ‘অ-পবিত্র’ প্রযোজনাটি অ্যাকাডেমির মঞ্চে যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে ওঠে সব্যসাচী চক্রবর্তী (ডুর্মন্ড) আর অসিত বসুর (ব্রাডি) বাক্যবিন্যাস, যুক্তি-প্রতিযুক্তির চাপান-উতোরে। চন্দন সেনের অনুবাদে আমেরিকার হিলস বোরোর সঙ্গে গুজরাতের কোনও শহরের পার্থক্য বোঝা যায় না। জেরোম লরেন্স ও রবার্ট ই-লি’র লেখাকে তিনি স্থানান্তরিত না করে বুদ্ধিমানের কাজই করেছেন। বাইবেল নিয়ে দুই বিপ্রতীপ চিন্তার উকিলের কথাবার্তায় স্পষ্টই প্রতিফলিত হয় এদেশের এখনকার কিছু রাজনৈতিক নেতার বুলি! বাক্যজাল বিস্তারে চন্দনের অনুবাদের কাজটির প্রশংসা করতেই হয়। মঞ্চটিকে বিচারালয় গড়ে তোলায় দু’পক্ষের মুখোমুখি কথা বলার জায়গা একটু প্রশস্ত হয়েছে। শিল্পী দু’জনেই সাবলীল ভাবে অভিনয় করতে পেরেছেন। আবার দু’-চারটি কাঠামো উলটে পালটে সেখানে গির্জার উপাসনা ঘর গড়ে তোলার পরিকল্পনাটিও ভাল। এজন্য মঞ্চ রূপকারের প্রশংসা প্রাপ্য। আলো এবং আবহর ব্যবহারেও পরিবেশ ও নাট্যমুহূর্ত তৈরিতে সাহায্য করেছে। দ্বিতীয় শোতেই নাটকটি দেখা- আশা পরবর্তী অভিনয়ে আরও পরিচ্ছন্ন এবং নিপুণ হবে সব কাজ।
তবে টেকনিক্যাল কাজের খুঁত ধরার চাইতে দর্শকের চোখ ও কান মগ্ন রাখতে নাটকের বাঁধুনি এবং বিষয়টাই বড় আকর্ষণ। এই পার্থিব জগতে বাইবেল-ই শেষ কথা। অখ্রিস্টান মানেই বর্বর, বিজ্ঞান শিক্ষা ও বিবর্তনবাদীরা বিষ ছড়ায়, ধর্ম এবং ধর্ম শাস্ত্রই সংবিধান এইসব উপপাদ্যের প্রতিবাদ করে ডুর্মন্ড প্রমাণ করে দেয় বাইবেল শুধুই একটা বই! মানুষকে অধীনে রাখার জন্য চার্চ এবং যাজকরা বইটিকে ব্যবহার করে। বার্ট্রামের মামলা উচ্চ আদালতে স্থানান্তরিত হয়, ব্রাডি পরাজয়ের গ্লানিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হন। আর ড্রুর্মন্ড বার্ট্রামকে বলেন ‘তুমি শেষপর্যন্ত মামলায় জিতবে কি না জানি না, কিন্তু তোমার এই প্রতিবাদী মনোভাব পরের মানুষটাকে এগিয়ে দিল, সাহস জোগাল।’ এই নাটকের সারকথা এটাই।
সব্যসাচী-অসিত বসুর পাশাপাশি শান্তিলাল (যাজক) এবং চন্দন (ক্ষণে ক্ষণে ফুট কাটা সাংবাদিক) সেনের কাজকেও প্রশংসা করে খাটো করতে চাই না। ওঁরা বেশ ভাল। তবে আরও চমক র্যাচেলের চরিত্রে তোর্সা বন্দ্যোপাধ্যায় কখনও দৃপ্ত, কখনও ভীত হওয়ার অভিনয়। অনেকদিন পর ভদ্রা বসুকেও (সারা) দেখে ভাল লাগল। ব্রার্ট্রামের চরিত্রে তুহিন শুধু ঠিকঠাকই বলব, আসলে এত সব তারকার ভিড়ে তাঁকে অনুজ্জ্বল লাগবেই। সবার উপর রয়েছে নাটকটির ওজনদার বক্তব্য। এখানেই ‘অ-পবিত্র’ হয়ে ওঠে আজকের অপবিত্র পরিবেশে ‘পবিত্র’ হয়ে ওঠার রসদ এবং অত্যন্ত সমসাময়িক।
[ প্রয়াত হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতের বিশিষ্ট শিল্পী অন্নপূর্ণা দেবী ]
The post পুরনো দিনের স্মৃতি ফিরিয়ে আনল ‘অ-পবিত্র’, নজর কাড়ল অভিনয় appeared first on Sangbad Pratidin.