shono
Advertisement
Suchitra Mitra

সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে 'কৃষ্ণকলি ১০০', স্মরণ ও শ্রদ্ধার নকশি কাঁথা

সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষ স্মরণে অনুষ্ঠান। গানে ও কবিতায় রায়া ভট্টাচার্য, পাঠে গৌতম ভট্টাচার্য।
Published By: Sandipta BhanjaPosted: 04:58 PM Nov 25, 2024Updated: 05:18 PM Nov 25, 2024

রঞ্জন বন্দ্যোপাধ‌্যায়: যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন বুঝতে পাচ্ছি সুচিত্রা মিত্রের অভাব অফুরন্ত অমাবস‌্যার মতো। ফিরবে না সেই রবীন্দ্রসংগীতের জ্যোৎস্না? যে বোধ ও বলিষ্ঠতা, যে প্রত‌্যয় ও স্পষ্টতা, যে দাপট ও ঝলক, যে প্রাণন ও প্রকাশ নিয়ে সুচিত্রা মিত্র সরিয়ে দিতেন কৃত্রিমতার বাধা, খুলে দিতেন তাঁর অনুষ্ঠানে রবীন্দ্রসংগীতের প্লাবনদ্বার, কণ্ঠের বহ্নিস্রোত, তা রয়ে গেছে স্মৃতিতে। এবং ইউটিউবের সৌজন্যে এখনও দেখতে পাই সেই সোনার হরিণের মৃগতৃষিকা-ঝিলিক। সুচিত্রা মিত্রের আর কোনও অনুষ্ঠান পৃথিবীর কোথাও কোনওদিন দেখা যাবে না, এই হল নিষ্ঠুর বাস্তব। রবীন্দ্রসংগীতের ছিপছিপে পূর্ণিমা চিরকালের জন্যে হারিয়ে গিয়েছে।

Advertisement

মনে পড়ে, চোখ বুজলে দেখতে পাই, রবীন্দ্রগানের সেই চাঁদের আলো সমস্ত মনপ্রাণ মেলে, শরীর ও আত্মার তরঙ্গ তুলে, গলে যাচ্ছে রবীন্দ্রনাথের বাণী ও সুরের অনন্ত সৈকতে : ‘তুমি হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে-আসা ধন–/তাই হঠাৎ পাওয়ায় চমকে ওঠে মন’। ‘হে নূতন, দেখা দিক আর-বার জন্মের প্রথম শুভক্ষণ’। ‘আগুনের পরশমণি
ছোঁয়াও প্রাণে’। ‘তুমি যে চেয়ে আছ আকাশ ভরে’। ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে’। ‘প্রলয়নাচন নাচলে যখন আপন ভুলে,/হে নটরাজ, জটার বাঁধন পড়ল খুলে’। এই শেষ গানটি যতবার শুনেছি সুচিত্রা মিত্রের কণ্ঠে, মনে হয়েছে সুরের জাহ্নবী মুক্ত ধারায় উন্মাদিনী, সংগীতে তার তরঙ্গদল উঠল দুলে। এই গানের আরও একটি লাইন সত‌্য হয়ে ওঠে যখন এই গান তিনি গেয়েছেন। সেই মৃত্যুহীন পঙ্‌ক্তিটি হল, ‘রবির আলো সাড়া দিল আকাশ পারে’। সত্যিই যেন রবীন্দ্রনাথ এই গান সুচিত্রাকণ্ঠে শোনার জন‌্য আবির্ভূত হন! যখনই শুনি তাঁর গলায় ‘এই উদাসী হাওয়ার পথে পথে’, সময় থমকে দাঁড়ায়। তিনি হয়ে ওঠেন বাণী ও সুরের ছিপছিপে জ্যোৎস্না। আর আমি অপেক্ষা করি তাঁর দৈবকণ্ঠে ওই চারটি অমৃতশব্দ শোনার জন‌্য : ‘লহো লহো করুণ করে’। এই চারটি শব্দের যাচনায় উথলে উঠেছে রবীন্দ্র প্রতিভার নিগূঢ় নির্যাস। আর সেই নির্যাসে সুচিত্রা মিশিয়েছেন তাঁর আত্মা,
তাঁর বোধ, তাঁর নিজস্ব জীবনদহনের সমস্ত আন্তর অবদান। ‘করুণ কর’- পৃথিবীর আর কোনও কবি মাত্র দুটি শব্দে এমন একটি মহাবিশ্বজোড়া কসমিক চিত্রকল্প ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন বলে আমার জানা নেই। শুধু এইটুকু বুঝতে পারি, সুচিত্রা মিত্রর উচ্চারণে, কণ্ঠ ব‌্যাখ‌্যায়, তাঁর মগ্নতায় ও নিবেদনে রবীন্দ্রনাথের চিত্রকল্পটি তিনি সুর ও বাণীর রেখায়-রঙে এঁকে দিলেন ওই চারটি শব্দের প্রার্থনায়।

সুচিত্রা যখন ওই চারটি শব্দ গান, আমি মনের আকাশে দেখতে পাই দুটি করুণ কর গ্রহণ করেছে উদাসী হাওয়ায় পথে পথে ঝরে যাওয়া অনাদরের মুকুল। চোখ বুজলে আজও শুনতে পাই সারা আকাশ জুড়ে সুচিত্রা গাইছেন, ‘আমি চোখ এই আলোকে মেলব যবে/ তোমার ওই চেয়ে দেখা সফল হবে,/ এ আকাশ দিন গুনিছে তারই তরে’। সুচিত্রা সত্যিই ফুটিয়ে তুলতে পারেন, আকাশ-ভরা কস্‌মিক প্রতীক্ষা। আর সুচিত্রা, যখন বলেন, সেই আকাশ জোড়া অপেক্ষার পানে তাকিয়ে, ‘ফাগুনের কুসুমফোটা হবে ফাঁকি/ আমার এই একটি কুঁড়ি রইলে বাকি’- আহা! সুচিত্রাই কতবার চোখের সামনে হয়ে উঠেছেন সেই অপেক্ষমাণ একটি কুঁড়ি, আলোর কুঁড়ি, সংবেদনার কুঁড়ি, সমর্পণের কুঁড়ি। তবে সুচিত্রা মিত্র যখন রবীন্দ্রসংগীত থেকে সরে খোলা মাঠে গণসংগীত গেয়েছেন, তখনও তিনি চাঁদ। কাস্তের গায়ে বাঁকা চাঁদ। তখনও তুলনাহীনা।

২৩ নভেম্বর সন্ধেবেলা সল্টলেকের রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনে গিয়েছিলাম ‘কৃষ্ণকলির ১০০’ অনুষ্ঠানে একবুক সুচিত্রা-মনকেমন এবং বিষণ্ণ নস্ট‌ালজিয়া নিয়ে। অনুষ্ঠানটি সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষ স্মরণে। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় জয়ন্ত মুখোপাধ‌্যায়, তিনি সুচিত্রা মিত্রর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ‌্য পেয়েছিলেন। তিনভাগে বিভক্ত এই দীর্ঘ অনুষ্ঠান। এবং প্রথম ভাগে সংবর্ধনা জানানো হল সুচিত্রা মিত্রের জীবনে কিছু বিশিষ্ট মানুষকে। দ্বিতীয় ভাগের আলো- এবং এই অনুষ্ঠানের মূল আকর্ষণ- বিশ্বভারতীর বিখ‌্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী মোহন সিং খাঙ্গুরা। আর শেষ বা তৃতীয় অংশের উষসী মিউজিক অ‌্যাকাডেমির শিক্ষার্থীদের গানের সঙ্গে রায়া ভট্টাচার্যের পাঠ ও গান এবং গৌতম ভট্টাচার্যেরও পাঠ ও গান (সোলো)। সন্ধ‌্যার বিশেষ অতিথি রূপক সাহা এবং গৌতম ভট্টাচার্য। মঞ্চে এসেই মোহন সিং ঘোষণা করলেন, তাঁর গলার অবস্থা খুব খারাপ। এই অবস্থায় তাঁর
গান করা উচিত নয়। কথাটা সত্যি, প্রথম দিকে গলাটা যুৎসই সত্যি ছিল না। তবু প্রথম গান হিসাবে তিনি বাছলেন রবীন্দ্রনাথের মধ‌্যবয়সে লেখা পূজা পর্বের বিখ‌্যাত গান, ‘ভুবনেশ্বর হে, মোচন করো বন্ধন সব, মোচন করো হে’। ইমন-ভূপালী, একতালের ব্রহ্মসংগীত, গম্ভীর গান। ভুবনেশ্বরের কৃপাতেই মোহন সিংয়ের গলাটা হঠাৎ স্বাভাবিক হয়ে গেল যেই তিনি গাইলেন, ‘সমুখে তব দীপ্ত দীপ তুলিয়া ধরো হে’। দীর্ঘ গানটি, অনেকক্ষণ ধরে গাইলেন মোহন সিং। আমরাও বেশ আনন্দ পেলাম তিনি কণ্ঠ ফিরে পেতে। মোহন সিং দ্বিতীয় গান শুরু করলেন দারুণ মেজাজে। পূজা ভাবেই আছেন। কিন্তু ঈশ্বরের সঙ্গে এই পর্বে রবীন্দ্রনাথের বন্ধুভাব। নোবেল প্রাইজ পেতে এখনও তার বছর তিনেক দেরি। তবে এটি গীতাঞ্জলিরই গান: ‘কবে আমি বাহির হলেম
তোমারি গান গেয়ে- সে তো আজকে নয়’ সে আজকে নয়।’ খুব দরদ দিয়ে গাইলেন- গানটির বোধের সঙ্গে যুক্ত হলেন ক্রমশ। এবং আমরা মুগ্ধ হলাম। যখন গাইলেন, পুষ্প যেমন আলোর লাগি না জেগে রাত কাটায় জাগি/ তেমনি তোমার আশায় আমার হৃদয় আছে ছেয়ে, মনে হল মোহন সিং আজও ছুঁতে পারেন তাঁর অনন‌্য মাত্রা। তাঁর তৃতীয় গান : ‘শুধু তোমার বাণী নয় গো, হে বন্ধু হে প্রিয়’। একসঙ্গে ডুব দিলাম মুগ্ধতা এবং মগ্নতায়।

সমস্ত মনপ্রাণ উজাড় করে মোহন সিং গাইলেন, ‘হৃদয় আমার চায় যে দিতে, কেবল নিতে নয়’, দৃষ্টি ঝাপসা হল, সমস্ত মন ভিজে গেল আবছা বেদনায়। চতুর্থ গানে আমাকে অন্তত চমকে দিলেন মোহন সিং। দুম্‌ করে চলে গেলেন রবীন্দ্রনাথের ২৪ বছর বয়সে। কাদম্বরী দেবীর মৃত‌্যুর এক বছর পরে লিখেছিলেন এই ভয়ংকর বেদনার গান। মাত্র চার লাইনের এই গান লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ কী গভীর বিষাদের মধ্যে তা কি এতদূর থেকে আজ আমরা কল্পনা করতে পারি? তবে কী ফিরিব ম্লানমুখে সখা, জরজর প্রাণ কি জুড়াবে না॥ আঁধার সংসারে আবার ফিরে যাব? হৃদয়ের আশা পুরাবে না? রবীন্দ্রনাথের এই তীব্র ব‌্যক্তিগত বেদনা ও সংশয়ের গান কেউই প্রায় গান না। মোহন গেয়েছেন। আমরা কৃতার্থ। গানের শেষে তিনি নিজেও কান্না লুকোতে পারেননি। পঞ্চম গানে মোহন সচেতনভাবে ফিরে এলেন নিটোল আনন্দে ও বিশ্বাসে। এবং থাকলেন পূজার গানেই : ‘রাখো রাখো রে জীবনে জীবনবল্লভে,/ প্রাণপণে ধরি রাখো নিবিড় আনন্দবন্ধনে’। শত বেদনা-যন্ত্রণাতেও যেন এই আনন্দ থেকে সরে না যাই। পরের গানটিতে সমস্ত ভালোবাসা ঢেলে দিলেন মোহন : ‘আঁখিজল মুছাইলে জননী’। এই গান লিখেছেন তেইশ বছরের রবীন্দ্রনাথ কাদম্বরী দেবীর আত্মহত‌্যার সাত মাস পরে! তবু গানের শেষ লাইনটি : ‘ঘুচেছে হৃদয়বেদনা।’ বারবার মোহন গেয়েছেন অসীম দরদে এই দুটি শব্দ! এরপরে যে-গানটি গাইলেন মোহন, মন ভরে গেল : ‘যারা কাছে আছে তারা কাছে থাক, তারা তো পারে না জানিতে– তাহাদের চেয়ে তুমি কাছে আছ আমার হৃদয়খানিতে।’ তাঁর অসাধারণ অনুষ্ঠানটি মোহন সিং শেষ করলেন পূজা থেকে প্রেমে সরে গিয়ে। ছেষট্টি বছরের রবীন্দ্রনাথ তখন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে ব‌্যর্থ সম্পর্কের নস্ট‌ালজিয়ায় : ‘কাঁদালে তুমি মোরে ভালোবাসারই ঘায়ে–’। সত্যিই তাঁর শেষ গানে মোহন নিয়ে এলেন দুঃখের মোহন মাধুরী!

এরপরে শুরু হল অনুষ্ঠানের শেষ পর্ব ‘কৃষ্ণকলি ১০০’। অংশগ্রহণে উষসী মিউজিক অ‌্যাকাডেমির ছাত্রীরা। এ-ছাড়া গানে ও কবিতায় রায়া ভট্টাচার্য, পাঠে গৌতম ভট্টাচার্য। রায়া ভট্টাচার্যের রবীন্দ্রসংগীত প্রথম শুনলাম। অবশ‌্য অনেকের সঙ্গে : 'ওগো তোমার চক্ষু দিয়ে মেলে সত‌্য দৃষ্টি/ আমার সত‌্যরূপ প্রথম করেছে সৃষ্টি।' ভারি শক্ত গান, কী ব‌্যঞ্জনায়, কী সুরে। তবু রায়ার কণ্ঠের মিষ্টতা গানটিকে আচ্ছন্ন করেছে। এরপর রায়া পাঠ করলেন ওই বিখ‌্যাত কবিতা: আজি হতে শতবর্ষ পরে। রায়ার পাঠ, কবিতা, গান, গৌতমের পাঠ ও ব‌্যাখ‌্যা খুলে দিতে লাগল পরতে-পরতে কৃষ্ণকলি অর্থাৎ সুচিত্রা মিত্রের জীবন- তাঁর কাজের ব‌্যাপ্তি, তাঁর অন্বেষের প্রসার, তাঁর প্রাপ্তির তুলনাহীনতা। সমগ্র অনুষ্ঠান গানে-কবিতায়-পাঠে হয়ে উঠল স্মরণ ও শ্রদ্ধার নকশি কাঁথা।অনুষ্ঠানের শেষের দিকে রায়া ভট্টাচার্যের কণ্ঠে ‘কৃষ্ণকলি’ কবিতাটির রোম‌্যান্টিক আয়তি ও আবৃত্তি রেশ রেখে গেল। যা মিস্‌ করেছি সর্বক্ষণ, সুচিত্রা মিত্রের মতো সাদা তাঁতের শাড়ি জড়ানো, সম্পূর্ণ অলংকারহীন, রবীন্দ্রসংগীতের বিপুল বলিষ্ঠতা ও বর্ণময়তা।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ২৩ নভেম্বর সন্ধেবেলা সল্টলেকের রবীন্দ্র ওকাকুরা ভবনে গিয়েছিলাম ‘কৃষ্ণকলির ১০০’ অনুষ্ঠানে একবুক সুচিত্রা-মনকেমন এবং বিষণ্ণ নস্টালজিয়া নিয়ে। 
  • অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও পরিচালনায় জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়, তিনি সুচিত্রা মিত্রর ছাত্র হওয়ার সৌভাগ্য পেয়েছিলেন।
  • অনুষ্ঠানটি সুচিত্রা মিত্রের জন্মশতবর্ষ স্মরণে।
Advertisement