নির্মল ধর: ১৬২ বছর আগে লেখা নাটক। প্রথম অভিনয় হয় ঠিক দেড়শো বছর আগে উত্তর কলকাতার মধুসূদন সান্যালের বাড়ির উঠোনে মঞ্চ বেঁধে। জমিদার বাবুর দল নয়, সাহেব সুবোদের আমন্ত্রণ নয়, মঞ্চে নাটক দেখার জন্য দরজা খোলা ছিল সাধারণ মানুষের জন্য, অবশ্যই টিকিটের বিনিময়ে। সম্প্রতি মঞ্চস্থ হল আগে লেখা দীনবন্ধু মিত্রের “নীলদর্পণ”!
কলকাতার বঙ্গীয় নাট্য সংহতি সেই প্রযোজনার সার্ধশতবার্ষিকী উদযাপনের শুভ সন্ধ্যায় আমন্ত্রণ জানিয়ে কলকাতায় নিয়ে আসে ঢাকার জনপ্রিয় ও বিশিষ্ট নাট্যব্যক্তিত্ব জনাব মামুনুর রশিদ ভাইকে। তাঁকেই অনুরোধ করেন “নীলদর্পণ” নাটকটির পরিচালনা ও পরিবেশনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। একদিক থেকে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানানোয় আরও একটি সম্মান জানানো গেল ঢাকা শহরকে। কারণ “নীলদর্পণ” প্রথম প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকেই। সম্ভাব্য কারণ, দীনবন্ধু মিত্র তখন সরকারি চাকুরে, তাঁর লেখা কলকাতা থেকে প্রকাশিত হলে গন্ডগোলের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
[আরও পড়ুন: বিদেশে বাঙালি বউ! ‘মিসেস চ্যাটার্জি ভার্সেস নরওয়ে’ ছবির লুকে চমক দিলেন রানি ]
মামুনুর ভাই প্রায় সম্পূর্ণ মূলানুগ থেকেই এই ঐতিহাসিক নাটকটির মঞ্চায়ন ঘটিয়েছেন কলকাতার স্বল্পপরিসর মঞ্চ তপন থিয়েটারে। গত ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় সত্যিই যেনো নেমে এসেছিল সেই মধুসূদন সান্যাল বাড়ির আবহ। দর্শক আসন জুড়ে আজকের বাংলা নাটকের নামি অনামী চেনা অচেনা নাট্যপ্রেমিদের ভিড়ে যাকে বলে “হাউসফুল”! মামুনুর ভাইয়ের নেতৃত্বে ঢাকার বেশ কটি দলের শিল্পীদের নিয়ে নীলকর সাহেব দের অত্যচার, সাধুচরণ, রাইচরণ,তোরাপ দের প্রতিরোধ, গোলক বসু ও তার দুই ছেলে নবীন ও বিন্দুমাধব প্রতিবাদ, দেওয়ান গোপীনাথের সাহেব তোসামোদিপনা সব কিছুই ঠিকঠাক রেখে, এমনকী সংলাপের পুরনো দিনের ভাষাকেও আবিকৃত রেখে মূল নাটকের বক্তব্য ও রসকে এতটুকু ক্ষুন্ন না করে পরিবেশন করেছেন।
হ্যাঁ, অবশ্যই এখনকার নাট্যপ্রকরণ ও শৈলীর প্রেক্ষিতে পুরনো চলন একটু ধীর গতির লাগতেই পারে, কিন্তু ঐতিহাসিক প্রযোজনার কোনো পরিবর্তন অবশ্যই বাঞ্ছনীয় নয়। মামুনুর ভাইয়ের সঙ্গে সুন্দর সঙ্গত দিয়েছেন সন্ধ্যার প্রতিটি শিল্পী। গোলকচন্দ্রের শুভাশিস মৈত্র থেকে উড ও রোগ এর ভূমিকায় খালিদ রুমী ও ফয়েজ জহির, রাইচরণ ও গোপীনাথের চরিত্রে সুজাত শিমুল ও আহমেদ পিয়াস এবং বিশেষ করে গোপীনাথ বেশি ছোট্ট চেহারার রুহুল আমিন চমকে দেন। স্ত্রী চরিত্রে শাহনাজ খুশী (পদি), সঙ্গীতা চৌধুরী(ক্ষেত্রমণি), লায়লা বিলকিস(সাবিত্রী), সুষমা সরকার(সৈরিন্ধ্রি), তাসমি চৌধুরী(রেবতী), এমনকি শামীমা শওকত লাভলি(আদুরী) প্রত্যেকেই এক সুরে লয়ে নাটকের গতি ও চলন বজায় রেখে অভিনয় করে গিয়েছেন। সব চাইতে অবাক করে দিয়েছে পরিমল মজুমদারের আবহ ভাবনা। গানের সুরেই নিহিত রয়েছে এক দীর্ঘ বিষাদ ও দক্ষের বাতাবরণ! “নীলদর্পণ”:গত পঞ্চাশ বছরে কলকাতা বা ঢাকার কোনও দল প্রযোজনা করেছেন বলে শুনিনি, সেই দিক থেকে মামুনুর ভাইয়ের এই প্রযোজনাও এক অর্থে ঐতিহাসিক ঘটনা হয়ে রইল। ধন্যবাদ বঙ্গীয় নাট্য সংহতি এবং সংস্থার প্রধান কারিগর বিভাস চক্রবর্তী, অরুণ মুখোপাধ্যায়, মেঘনাদ ভট্টাচার্য, অশোক মুখোপাধ্যায়কেও। আগামী এক বছর ধরে প্রতি মাসের প্রথম শনিবার এমন আরও একডজন নাটকের পুনরাভিনয় দেখব সেই আশায় রইলাম।