সুপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায়: “মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে/মানবের মাঝে আমি…”
কিন্তু হায়! শেষ পর্যন্ত মরতেই চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷ নিত্যদিনের পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে একটা সময় তিনি অনেকটাই হয়ে উঠেছিলেন আধ্যাত্মিক৷ আধ্যাত্মিকতার পাশাপাশি সাংসারিক জীবনে তিনি একরকম দার্শনিকও হয়ে উঠেছিলেন৷ সেই দার্শনিকতার উপর ভর করেই পারিবারিক অশান্তি থেকে মুক্তি পেতে শেষ পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ভূলোক ছেড়ে় অমৃতলোকে পাড়ি দেওয়ার সিদ্ধান্ত পাকা করে ফেলেছিলেন৷ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গভীর রাতে একা রবীন্দ্রনাথ ব্রেবোর্ন রোড ধরে হাঁটতে হাঁটতে সোজা চলে এলেন একেবারে হাওড়া ব্রিজের মাঝখানে৷ ব্রিজের উপর থেকেই মাঝগঙ্গার দিকে তাকিয়ে মা গঙ্গাকে উদ্দেশ্য করে শেষ প্রণামটি সেরে নিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ পায়ের চটি জোড়া পাশে খুলে রেখে ব্রিজের রেলিংয়ের ওপারে বাড়িয়ে দিলেন একটি পা৷ আরও একটি পা রেলিংয়ের উপর তুলে মরণঝাঁপ দেওয়ার শেষ মুহূর্তে ঘটে গেল অঘটন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ মরণ ইচ্ছা পূরণ হল না৷ পা ধরে পিছন থেকে টেনে ধরলেন কলকাতা পুলিশের কর্তব্যরত সাদা পোশাকের কনস্টেবলরা৷ আত্মহত্যা করতে যাওয়া রবীন্দ্রনাথকে শেষ পর্যন্ত বাঁচিয়ে দিল পুলিশ৷
বৃহস্পতিবার রাত প্রায় দুটো৷ লালবাজারের ১০০ ডায়ালে বেজে উঠল ফোন৷ উল্টোদিক থেকে বলা হল, “স্যার, হাওড়া ব্রিজে একটি লোক আত্মহত্যার চেষ্টা চালাচ্ছে৷ মনে হচ্ছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই সে জলে ঝাঁপ দেবে৷” এই খবর পেয়েই লালবাজারের ওসি কন্ট্রোলে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মীরা উত্তর বন্দর থানায় যোগাযোগ করে বিষয়টি জানান৷ হাওড়া ব্রিজের উপরে রয়েছে উত্তর বন্দর থানার কিয়স্ক৷ সেই কিয়স্কে ফোন করে এই বিষয়ে দ্রূত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলেন উত্তর বন্দর থানার কর্তব্যরত পুলিশ কর্মীরা৷ সঙ্গে সঙ্গে কিয়স্ক থেকে পুলিশ কনস্টেবলরা বের হয়ে চলে আসেন হাওড়া ব্রিজের মাঝ বরাবর৷ সেখানে ততক্ষণে ওই ব্যক্তি আত্মহত্যা করার চেষ্টা চালাচ্ছেন৷ মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধান৷ একটু দেরি হলেই ঘটে যেত আত্মহত্যার ঘটনা৷ ওই ব্যক্তিকে ধরে নিয়ে আসা হয় উত্তর বন্দর থানায়৷ থানার মোটা জাবদা ডায়েরি খুলে ডিউটি অফিসার গম্ভীর মুখে আত্মহত্যা করতে যাওয়া ব্যক্তির নাম জিজ্ঞেস করলেন৷ গম্ভীর মুখেই উত্তর এল ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’৷ উত্তর শুনে চক্ষু চড়কগাছ পুলিশের৷
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের মতো এই রবীন্দ্রনাথের গালভর্তি সাদা দাড়ি নেই৷ নেই কাঁধ পর্যন্ত ঝোলানো সাদা চুল৷ বরং এই রবীন্দ্রনাথের গোঁফ-দাড়ি পর্যন্ত নেই৷ বয়স খুব জোর মেরেকেটে ৩২৷ গায়ের রং কালো৷ রোগাটে চেহারা৷ উচ্চতা মেরে-কেটে পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি৷ বাড়ি হরিদেবপুরের মহাত্মা গান্ধী রোডে৷ বাবার নাম জয়দেব ঠাকুর৷ হরিদেবপুরের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নেশা হল জ্যোতিষচর্চা৷
স্নাতক হওয়ার পর থেকেই পুরোপুরিভাবে জ্যোতিষচর্চায় মজে ওঠেন হরিদেবপুরের রবীন্দ্রনাথ৷ পাড়ায় অতি পরিচিত তিনি৷ কারণ, পাড়ার মানুষের তিনি হাত দেখে বেড়ান বিনা পারিশ্রমিকে৷ বিনা পয়সায় মানুষের হাত দেখে ভবিষ্যৎবাণী করাই হল হরিদেবপুরের রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় নেশা৷ বিনা পারিশ্রমিকে জ্যোতিষচর্চার ফলে কোনও রোজগারপাতি বড় একটা হত না তাঁর৷ এর ফলে প্রায় বেকারই ছিলেন হরিদেবপুরের রবীন্দ্রনাথ৷ এর জন্য পরিবারের লেগে থাকত অশান্তি৷ হয় পারিশ্রমিক নিয়ে জ্যোতিষচর্চা করা, নয়তো চাকরি-বাকরির সন্ধান করার জন্য হরিদেবপুরের রবীন্দ্রনাথকে চাপ দিতেন বাবা জয়দেব ঠাকুর৷ তাতে রাজি ছিলেন না রবীন্দ্রনাথ৷ এই নিয়ে পারিবারিক দ্বন্দ্ব লেগেই থাকত৷ সেই অশান্তি থেকে মুক্তি পেতেই আত্মঘাতী হতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷
রবীন্দ্রনাথের মুখ থেকে এই কথা শোনার পর রাতেই বাবা জয়দেব ঠাকুরকে উত্তর বন্দর থানায় ডেকে পাঠায় পুলিশ৷ বাড়ির লোকজনের সামনে রবীন্দ্রনাথকে মুখোমুখি বসিয়ে চলে পুলিশের কাউন্সেলিং৷ প্রায় দু’ঘণ্টা কাউন্সেলিংয়ের পর জ্যোতিষী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিয়ে হরিদেবপুরের বাড়িতে ফিরে যান বাবা জয়দেব ঠাকুর৷
The post সাংসারিক অশান্তি, মরতে চেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর! appeared first on Sangbad Pratidin.