সুমিত বিশ্বাস, বারাণসী: বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচীন শহর। যেন ইতিহাসের চেয়েও আদি! সেই বারাণসীতেও রয়েছে একটুকরো বাঙালিয়ানা। মাছে-ভাতে বাঙালি থেকে সন্দেশ-রসগোল্লায় ডুবে থাকা বাঙালি মন। তাই তো বারাণসীর বাঙালিটোলাতেও দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। এই তল্লাটের মানুষজনের কথায়, এই কাশীর বাবা বিশ্বনাথ তো বাংলার জামাই! তাই পুজোয় মা পার্বতী বাবাকে ছেড়ে বাপের বাড়িতে বাংলায় যান। যেমন বারাণসীর বেনারসি শাড়ি নানা কালেকশন নিয়ে কলকাতায় যায়, ঠিক তেমনই।
বিখ্যাত দশাশ্বমেধ ঘাট ছুঁয়ে প্রায় দুকিমি ব্যাসার্ধ জুড়ে এই বাঙালিটোলা। বারাণসী শহরের প্রাণকেন্দ্র গোধুলিয়া চক থেকে দশাশ্বমেধ ঘাট যাওয়ার রাস্তায় ডান দিকের গলিকে ঘিরে এই টোলা। মূলত অলি-গলি ঘিরেই এই পল্লী। স্রেফ এই কলোনিতেই ৩০-৪০ টি দুর্গাপুজো হয়। সমগ্র বারাণসীতে সংখ্যাটা ৩০০-র বেশি। তাই দুর্গা কুন্ড মন্দির থেকে পুরাতন দুর্গা বাটিতে পুজোর ব্যস্ততা তুঙ্গে। দুর্গাকুণ্ড মন্দিরে মা সোনায় মোড়া। ১৮ শতকে নাটোরের রানি ভবানী এই মন্দির নির্মাণ করেছিলেন।
এই প্রাচীন শহরে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বাঙালির বসবাস। সংখ্যার নিরিখে একলক্ষের বেশি। তাই তো বাঙালিটোলা একেবারে রসে বসে বাঙালি। রসগোল্লা, চমচম, কালোজাম, ক্ষীরকদম্ব, ক্ষীরের পেড়া, মালাইচপ, দরবেশ কি নেই? ফি সন্ধ্যায় গরম রসগোল্লার খোঁজে বাঙালি পর্যটক থেকে শুরু করে কাশী বিশ্বনাথে পা রাখা এদেশের কত ভক্ত যে বাঙালিটোলায় ভিড় জমান তার হিসাব নেই। রসভর্তি গামলার সামনে যেন আছড়ে পড়েন সবাই। এমনকি লম্বা, বড় ক্যামেরা হাতে বিদেশিরাও। রাতেও যেন জেগে থাকে এই বাঙালিটোলা।
[আরও পড়ুন: ‘কামদুনির নির্যাতিতার পরিবারের সঙ্গে দেখা করুন’, মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠিতে আর্জি অধীরের]
পাঁচ পুরুষ ধরে বারাণসীতে থাকা ১১৪ বছরের মিষ্টির দোকানের মালিক সঞ্জীব লাহা বলেন, “বাঙালির মিষ্টি জগৎ জোড়া। গামলা বোঝাই রসে ভরা মিষ্টি খেতে এই বাঙালিটোলায় প্রতি সন্ধ্যায় ভিড় জমে। এই ছবি শুধু আজকের নয়। এই ছবি বহু পরিচিত।” ক্ষীরের পেড়া পুজোর সময় আলাদা কদর। ৩৫০ টাকা কেজি এই পেড়া মায়ের চরণে দিয়ে পুজো দেওয়া হয়। তবে শুধু কি মিষ্টি? এই বাঙালিটোলায় মেলে লুচি-তরকারিও। এছাড়া আরও নানান খাবার।
অনেকটা কলকাতার ডেকার্স লেনের মতো। ধোসা, ইডলি, উট্টাপম, সম্বর বড়া, বার্গার, চাওমিন, চপ, সিঙ্গাড়া, জিলাপি সব মেলে। এই বাঙালিটোলায় ঘরে বসিয়েও বাঙালি পর্যটকদের ভাত, ডাল, শুক্তো, আলু পোস্ত, হরেক রকম মাছ দিয়ে খাওয়ানো হয়। এই পল্লীতে থাকা হোটেল বা গেস্ট হাউস গুলোতেও একেবারে প্যাক করে বাঙালি আহার পৌঁছে দেওয়া হয়। বাঙালিটোলার বাসিন্দা, দশাশ্বমেধ ঘাটের পুরোহিত ভান্ডারী পান্ডে বলেন, “বাঙালিদের সংস্কৃতি, ব্যবহার, আচার-আচরণ মন ছুঁয়ে যায়। আমরা একসঙ্গেই সবাই থাকি। পুজোতেও মাতি।”
এই বাঙালিটোলার গোল্ডেন ক্লাবের দুর্গাপুজো বারাণসীর বিখ্যাত। লম্বা-চওড়ায় মা উমা আলাদাভাবে নজর কাড়েন।তাই সবচেয়ে পরে বিসর্জন হয় এই মাতৃপ্রতিমার। এই বাঙালিটোলায় থাকা দশকর্মার দোকানের মালিক স্বপ্না গোস্বামী বলেন, “বারাণসীতে পুজোর প্রস্তুতি জোরকদমে চলছে। আমাদের পাঁচ পুরুষের দোকান। মা কে সাজাতে মুকুট-সহ নানান সম্ভার নিয়ে আসা হয়েছে। কলকাতার মতোই পুজো এখানে জমজমাট।” দুর্গাকুণ্ড মন্দিরের প্রধান পুরোহিত কৌশল পতি জানান, “নবরাত্রিতে মন্দিরে ঢুকতে পাঁচ ঘন্টা লেগে যায়। এতটায় ভিড় থাকে। এখানে প্যান্ডেল কিছু হয় না। কিন্তু পুজোকে ঘিরে প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছে।”
বেনারসী শাড়ির কারখানাগুলিতেও চরম ব্যস্ততা। পুজোয় বহু শাড়ি যে কলকাতায় আসছে। এই প্রাচীন শহরই যে বাঙালিকে দিয়েছে বেনারসী শাড়ি। তাই পুজো ছাড়া অন্যান্য সময়েও বারাণসীর সঙ্গে কলকাতার বাণিজ্যের আলাদা যোগ। এই আশ্বিনেও গঙ্গা থেকে ভেসে আসছে শীতল হাওয়া। আর এই হিমেল হাওয়া মনে করিয়ে দিচ্ছে বারাণসীতেও পুজো দোরগোড়ায়।