মাধবেন্দু হেঁস: রাজগ্রামে দত্তদের দুর্গামন্দির। স্থানীয় ভাষায় মন্দিরকে মেলা বলি। মানে দত্তদের দুর্গামেলা। আরো ছোট করে দত্তমেলা। বাঁদিকে একটা ছোট খোপ। সেখানে বিষ্ণু থাকে। আর ডান হাতে একফালি ভাঁড়ার ঘর। দত্তমেলায় শুধু দুর্গার পূজা(Durga Puja 2024) হয় না। বারো মাস সরস্বতীর চর্চাও হয়। কাগজের ভাষায় ভালো নাম রাজগ্রাম ইলামবাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়। স্থানীয় ভাষায় মেলার ইস্কুল। ভাড়ার ঘরে সবচেয়ে সিনিয়র ক্লাস ফোর। আর দুর্গার চালার (স্থানীয় ভাষায় মেড়) সামনে ক্লাস আধ-ওয়ান, ওয়ান, টু এর থ্রি।
৯০ এর গোড়ার দিকে যখন আবহাওয়া এতটা খামখেয়ালি ছিল না। শেষ বর্ষার দিকে মেড়ে খড়ের কাঠামো বেঁধে, মাটি লেপা শুরু হত। আর আমরা বাচ্চারা মেলা থেকে নেমে এসে আটচালায় ক্লাস করতে বসতাম। একপ্রস্থ মাটি লেপার পর আবার যখন পরের স্তর পড়বে তার আগেই মাটির মধ্যে লুকিয়ে থাকা ধানের বীজ মাথা চাড়া দিয়ে উঠত। ওই খড়, মাটি, কচি ধান গাছের মায়া কি কোনওদিন ছবিতে তুলতে পারব?
২
রাত থাকতে উঠে পড়া আমার মায়ের বহুদিনের স্বভাব। ওই একটা দিন আমরাও উঠে পড়তাম। হাওয়াতে হালকা ঠান্ডা। ঘাসে পা দিলে ভিজে যাচ্ছে। আলো-আঁধারির ঝুঁঝ্যক্যা। বাবার মাথার উপর রেডিওতে বাজছে তব অচিন্ত্য রূপচরিত মহিমা। গানগুলোর সময় খুব বিরক্ত লাগত। কিন্তু মন্ত্রপাঠ শুরু হলেই কেমন একটা কাঁটা দিত গায়ে। মুখিয়ে থাকতাম কখন রেডিওর মহালয়া শেষ হয়ে দূরদর্শনের শুরু হবে। মা শিখিয়ে দিয়েছিল রেডিওতে যখন দেহি দেহি গান হবে তখন বুঝতে হবে শেষ হয়ে এল। এই 'যখন ইচ্ছে তখন স্ট্রিম করুন' এর যুগে আমার ভোর চারটের দুঃখ বিলাস কোথায় পাব।
৩
তার পর কোন এক মেঘলা ভাদুপূজার সকালে শুরু হত ঘরঝাড়া নামের এক মহাযজ্ঞ। যত উঁচুতে আমার ছোট ছোট হাত পৌঁছয় না সেই সব গুপ্ত স্থান থেকে নেমে আসত সব অমূল্য রতন ভরা বাক্স, প্যাঁটরা, পুটুলি। কোনওদিন স্কুলে না যাওয়া জেঠুর লেখা কবিতার খাতা। বাসররাতে পিসিকে দেওয়া পিসের প্রেমপত্র। প্রীতি উপহার লেখা বইয়ের ফাঁকে লুকনো। সীতার বনবাস। বাতিল হওয়া সিলেবাসের নব গণিত মুকুল। কিংবা আমি পেটে থাকার সময় আমার ঠাকুমা মাকে যে জামবাটিতে চিঁড়ে-দই মেখে খাইয়েছিল সেটাও। লক্ষ্মীর ধান রাখা হাঁড়ির নিচ থেকে বেরিয়ে আসত পর্বতপ্রমাণ ব্যাঙ। যতদূরেই ফেলে দিয়ে এসো তাকে সে পথ চিনে ঠিক ফিরে আসত। ঝুল, কালি, ধুলো, মাকড়সার জাল ঘেঁটে সারাদিন ডুবে থাকতাম আমাদের পূর্বপুরুষের ওই যৎসামান্য ইতিহাসের মধ্যে। ঝুলকালি মাখা আমার নিজের একটা পোর্ট্রেট নেই কেন?
৪
বেশ কয়েক দফা, ঝগড়াঝাঁটি মন কষাকষির পর শুরু হত পুজোর কেনাকাটার পর্ব। ভরসা দত্ত কুটির কিংবা পরিধান। কখনও কখনও রিকশা করে মাচানতলার বন্ড, মালতি স্টোর। নিম্ন মধ্যবিত্ত হিসাবে কখনও বয়সের উপযুক্ত সাইজের জামাকাপড় কেনা হয়নি। শুকনো খ্যাংড়া কাটির মতো চেহারায় দু সাইজ বড় জামা মনে হয় যেন কাকতাড়ুয়া। নাই বা থাকলে ব্র্যান্ড। নাই বা হল ফ্যাশন। নতুন জামার গন্ধ আজও অমলিন।
৫
দুর্ভাগ্যজনকভাবে বয়স বাড়তে থাকল। পত্র-পত্রিকায় পূজা স্পেশাল লেখালেখি বের হয়। ছোট শহরের পূজায় নবমী পর্যন্ত নিরামিষ খেতে খেতে জানতে পারি বড় শহরে কোনও হোটেলে চপ-চাউমিন-কাবাব-রোল পাওয়া যাচ্ছে। জুলজুল চোখে তাকিয়ে দেখি নাম না জানা সব রেসিপির ছবি। উত্তেজনার আতিশয্যে রাস্তার ঠেলা থেকে মুরগির চটপটি খেয়ে ফেলি আর সঙ্গে সঙ্গে খাই মায়ের উত্তম মধ্যম। তবে সবটা এতটা দুঃখীও নয়। দশমীর রাতে বাড়িতে বেশ ভিড় জমত। মায়ের হাতের ঘুগনি আর স্পেশাল ছোলার ডালের মিষ্টির জন্য।
৬
ডানার সাইজ আরও বড় হতে থাকল। জানতে পারলাম হাল ফ্যাশনের থিওরি হল ঠাকুর দেখতে যাওয়া ইজ সো ডাউন মার্কেট। তার চাইতে বাড়িতে বসে আড্ডা দেওয়া অনেক কুল। ছোট শহরের পুজোতেও কলকাতার হাওয়া লেগেছে। কলকাতার আগের বছরের ফেলে দেওয়া থিমকে জোড়া তাপ্পি লাগিয়ে মফস্বলে খুব চলে। আদিবাসী অধ্যুষিত রাঢ় বাংলা, কলকাতা থেকে তুলে আনা নকল সাঁওতালি গেরস্থালির অন্দরমহল দেখে আপ্লুত হয়। পিন্দারে পলাশের বন শুনে কোমর নাচায়। তাও আবার শিলাজিতের ভার্সন। জানতে পারে না রচয়িতার নাম। এঁটোকাটা থিমেরও শারদ সম্মান হয়। প্যান্ডেলের সামনে ট্রফি সাজানো থাকে। আর টোটোর ভিড়ে রাত দুটোতেও জ্যাম লেগে যায়, কয়েক বছর আগেও ঘুমিয়ে থাকা ছোট শহরে।
দেদার মদ। বেপরোয়া গাড়ি। কুড়িয়া নি তেরে, ব্রাউন রাং নে। আমাদের ভয় লাগে।
১০ জন। ৭ জন। কমতে কমতে তিনজন দুইজন। বৃত্ত ছোট হয়।
২৪ মিলিমিটারেও যে ছবি তোলা যেত না, ৫০ মিলিমিটারে তুললেও ওয়াইড মনে হয়।
৭
ক্যামেরার হাতে নেওয়ার পর ছবি তোলার চক্করে কখন যে ছবিটা মুখ্য হয়ে বাকি সব গৌণ হয়ে গেল খেয়াল পড়েনি। পারফেক্ট ফ্রেমের নেশায় কুমোরটুলিতে বসে থেকেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ছবির মতো বিসর্জনের ছবি তুলতে দৌড়ে গিয়েছি পুরুলিয়ার প্রত্যন্ত গ্রামে।
নিম্ন মধ্যবিত্ত চিন্তাভাবনা কোনওদিন নিজের মতো ভাবতে শেখায়নি। স্বপ্ন দেখার মধ্যেও রয়ে গেছে কিপটেমি। তাই অনেকগুলো বছর শুধু পেরিয়ে গিয়েছে শিখিয়ে নির্দিষ্ট কিছু ছবির মতো ছবি তুলে যাওয়ার বৃথা চেষ্টায়।
কোন নির্দিষ্ট পারফেক্ট ফ্রেম নয়। ক্যামেরা তো খুঁজে গিয়েছে হারিয়ে যাওয়া ছোটবেলার ছোট ছোট স্বপ্ন, হতাশা, ব্যর্থতা।
৮
এক দশকেরও বেশি সময় ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে আদৌ কিছু করতে পারলাম কি? এবছরের পুজোটাই যার দেখা হবে না তার শখ-আহ্লাদ-স্বপ্ন ধরতে পারলাম কি? সাবির মল্লিকের আর কোনওদিন কোনও উৎসবে বাড়ি ফেরা হবে না। তার কথাও তো বলতে পারলাম না। ভূতনির চরে কি এ বছর পূজা হবে? কিংবা খানাকুলে? এমপ্লয়ি না বলে পার্টনার নামের গালভরা টুপি পরিয়ে সব অধিকার কেড়ে নিয়ে যাদের কিলোমিটারের পর কিলোমিটার সাইকেল মোটর সাইকেলে দৌড় করাচ্ছে তাদের পুজোর বোনাস দেবে? বোনাস তো দূরের কথা। প্রায় এক দশক ধরে মামলা মোকদ্দমায় ফাঁসিয়ে দিয়ে যাদের যৌবনটাই 'চাকরি চাকরি' হা পিত্যেশ করে কাটিয়ে দিতে বাধ্য করা হল তাদের কথাও তো বলতে পারলাম না। আর এই সব মায়া কাটিয়ে যারা অন্য রাজ্যে পাড়ি দিল, 'বাংলাদেশি' বলে মার খেল তাদের কথাই বা কী বলতে পারলাম। পরিযায়ীদের পায়ের ক্ষত দিয়ে থিম তো বানিয়ে দিলাম কিন্তু ওরা পরিযায়ী হল কেন সেই ছবি তো তুলতে পারলাম না।