সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: পুজো (Durga Puja 2024) ! এই একটি শব্দই যেন মুহূর্তে মনের বিষণ্ণ মেঘকে ফুৎকারে উড়িয়ে ঘন নীল আকাশকে ফুটিয়ে তোলে। তবে পুজো মানেই কেবল নীল আকাশ, সাদা মেঘ তো নয়। কাশফুল আর ঢাকের বাদ্যির সঙ্গে মিলেমিশে থাকে অসংখ্য অনুষঙ্গ। যার মধ্যে অন্যতম নিঃসন্দেহে পুজোর গান। বছরের পর বছর পূজাবার্ষিকীর পাশাপাশি বাঙালি অকুল আগ্রহে তাকিয়ে থেকেছে পুজোর গানের দিকে। সেই সব গানের মধ্যে অনেকগুলি আজও মাইকে বেজে উঠে মুহূর্তে সময়রেখাকে মুছে দিয়ে নস্ট্যালজিয়ায় ভাসিয়ে দেয় সকলকে। কিন্তু আজ কি পুজোর গানের সেই আবেদন আর আছে?
কবে থেকে শুরু হয়েছিল পুজোর গান প্রকাশের এই রীতি? ১৯০১ সালে কলকাতায় অফিস খোলে 'দ্য গ্রামাফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেড'। ১৯০৭ সাল নাগাদ সেই অফিস এসপ্ল্যানেড থেকে স্থানান্তরিত হয় বেলেঘাটায়। আর সেই বছর থেকেই শুরু হয় রেকর্ড প্রিন্ট করা। আর তখন থেকেই সারা বছরের মতো পুজোর সময়ও প্রকাশিত হতে থাকে নতুন রেকর্ড। কিন্তু ১৯১৪ সালের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত রেকর্ড ক্যাটালগে পুজোর নতুন রেকর্ড প্রকাশের খবরে লেখা ছিল 'শারদীয়া পূজা উপলক্ষে'। সেই শুরু। তালিকায় মানদাসুন্দরী দাসী, কৃষ্ণভামিনী, চণ্ডীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়দের সঙ্গে ছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বোন অমলা দাশের রেকর্ডও। দ্রুতই পুজোর গান হয়ে উঠল 'ট্রেন্ডিং'!
এখানে 'পুজোর জলসা'র কথা না বললে বিষয়টি অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সারা রাতের অনুষ্ঠান। যাঁরা টিকিট পেলেন তাঁরা তো হাতে চাঁদ পেলেন। আর যাঁরা পাননি, তাঁদের জন্য বাইরে রয়েছে লম্বাটে মাইক। মাথায় পড়তে থাকা হিমকে অগ্রাহ্য করে কত রসিক মানুষ সুরসাগরে ভেসে যেতেন। শীতকাল বা অন্যসময়ও অবশ্য একই ছবি দেখা যেত। কিন্তু পুজোর সময় থেকেই মূলত শুরু হত এই জলসা। কেবল কি ছায়াছবি বা আধুনিক গানের জনপ্রিয় গায়ক-গায়িকা? ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, আখতারি বাই (বেগম আখতার), আল্লারাখা, বড়ে গোলাম আলি প্রমুখদের আসর ঘিরেও থাকত বিপুল উত্তেজনা।
ঠিক কোন সময়টা পুজোর গানের সেরা সময়? হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছিলেন, ছয়ের দশকেই পুজোর গান জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছয়। আসলে তার আগে পর্যন্ত সারা বছরই রেকর্ড প্রকাশ হত। এটা একেবারে শুরুর সেই 'দ্য গ্রামাফোন অ্যান্ড টাইপরাইটার লিমিটেডে'র দিন থেকে অব্যাহত ছিল। কিন্তু ছয়ের দশক থেকে তা কমে যায়। তখন নতুন গান মানেই পুজোর দিকে তাকিয়ে থাকতেন সবাই। ফলে পুজোর গানের জনপ্রিয়তা আকাশ ছুঁয়ে ফেলে। তবে তার বহু আগে থেকেই পুজোর সময় প্রকাশিত গান জনপ্রিয় হতে থাকে।
আজও পুজোর সময় হিন্দি গানের দৌরাত্ম্যের (তা সে মহম্মদ রফি হোক বা হানি সিং) সঙ্গে টক্কর দিয়ে বাজতে থাকে হেমন্ত, শ্যামল, সন্ধ্যা, আরতি, আশা, কিশোরদের গান। 'নয়ন সরসী কেন', 'শোনো কোনও একদিন', 'আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে' মুহূর্তে সময়ের গা থেকে পলেস্তরা খসিয়ে ফিরিয়ে আনে পুরনো দিন। আসলে অনেক কিছুই বদলে গিয়েছে গত কয়েক বছরে। শপিং মল আর অনলাইন শপিং থাবা বসিয়েছে ফুটপাতের ভিড়কে।
পুজোর গান ঘিরে সেই উন্মাদনাও অস্তমিত। আজকের গায়ক-গায়িকারাও পুজো উপলক্ষে গান প্রকাশ করেন বটে। কিন্তু সেই গানে পুজোর গানের আমেজ বোধহয় নেই। আসলে তথাকথিত বাংলা 'স্বর্ণযুগের গান'-এর একটা পর্ব নিশ্চয়ই পুজোর গান। আর সেই গানের আমেজও ওই সময়টার সঙ্গে সঙ্গেই হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। তবু এই সময়ের বুকেও জেগে থাকে হারানো সেই সময়। পুজোর গান সেই মুহূর্তকে ফিরিয়ে ফিরিয়ে আনে। ওই গান ছাড়া বাঙালির পুজো সম্পূর্ণ হত না। আজও হয় না।