শুভময় মিত্র: বিকট লাল আলুর দমের ঝাল আগুন নেভাতে গিয়ে অরেঞ্জ কাঠি আইসক্রিম খেয়ে, সিংহের মতো জিভ বের করে হ্যা হ্যা করতে করতে বাড়ি ফেরা মাত্র মা ঝাঁপিয়ে পড়ল হিংস্রভাবে। ''আবার (ছোটলোকদের মতো) রাস্তার খাবার খেয়েছ?'' দু কানের রং জিভের সঙ্গে ম্যাচ করিয়ে নিষ্কৃতি দিল। সঙ্গে সাবসনিক হুমকি। ''বিজয়ার আগে মুখে একটি বাদাম-ও যেন না দেখি।''
''সব কিছু বাড়িতে হয় নাকি? ফুচকা হয়? লজেন্স হয়?'' জিভে এসে গেলেও কথাগুলো গিলে ফেলেছিলাম। আজ যদি আমার বয়স হত দশ, তাহলে এই ঘটনা ঘটত না। আসলে সব কিছুর মতো খাওয়াদাওয়ার আবহটা বিলকুল বদলে গিয়েছে। বড়রা নিজেরাই তো বাইরে খেয়ে ফাটিয়ে দিচ্ছে। বাড়িতে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে কিছু একটা রান্না করা, ফ্রিজের শীতে বাসি করা, ফের মাইক্রোওয়েভে তেজি করা, গ্যাস চেম্বারের তাপ শুষতে ওস্তাদ সাঁ সাঁ চিমনির মায়াবী আলো, কী নেই? শুধু আসল কাজটা হয় না। ফোনের ডাকে আলমারি, শাড়ি শুধু নয় উটপাখির ডিমের ওমলেট অবধি পাওয়া যায় দোরগোড়ায়। ঠ্যাং ঠ্যাং করে আজকাল কারুরই রেগুলার রান্না করায় মতি নেই। পুজোর (Durga Puja 2024) সময়ে তো নয়ই।
উচ্চ মধ্যবিত্ত ঘরে একদা কাজের লোক করত বাজার। ঠাকুর করত রান্না। অতিথি স্পেশ্যাল হলে গৃহিণী সিনে নামতেন। শৌখিন পরিবারে আসল ভেটকির ফিশ ফ্রাই, মাংসের চপ, দেদার মিষ্টি দেওয়া ছোলার ডালের সঙ্গে ক্রমাগত লুচি, মালপোয়া, এসব হত বইকি। এখন সবটাই মাসির কন্ট্রোলে। কিছুদিনের মধ্যে বিরক্তি, অবধারিতভাবে। খাই খাই অতি সুকুমার প্রবৃত্তি। তাই অপশন এক: স্বর্ণযুগের যাবতীয় ডিলিসিয়াস ডেলিকেসি, দিশি, বিদেশি, জাস্ট ওয়ান ক্লিক অ্যাওয়ে। অপশন দুই : সারাবছর না হলেও উৎসবকালে রাস্তা দখল। পথের দাবি মেনে। টুইন টাওয়ার ব্লাস্ট, ক্রমাগত ফ্ল্যাশ ফ্লাড, হুমকিরাজ, এবি ইডি-র ধরপাকড়, যাই ঘটুক না কেন, নোলা যাবে কোথায়? সুগন্ধে ম ম করা দুর্গাপথের অদৃশ্য মাইক থেকে ভেসে আসে ...
অনেক তো দিন গেল বৃথাই সংশয়ে,
এসো এবার দ্বিধার বাধা পার হয়ে
তোমার আমার মালাই চিকেন
মিলাই প্রাণের মোহনায়
কিসের মানা।
কীসের মানা? হবেই হবে বিরিয়ানি বা চাউমিন। অধুনা স্ট্রিট স্মার্ট হয়ে ওঠা মুখে মারিতং আমাদের কাছে স্ট্রিট ফটোগ্রাফির মতোই, দ্য ইন থিং হল স্ট্রিট ফুড। মাঝে কয়েক বছর একটু ঝিমিয়ে পড়লেও, উৎসবের গরম তেলে ইউনেস্কোর লঙ্কা ফোড়ন পড়তেই লোকজন আবার জেগে উঠেছে। সবাই সেয়ানা। ভুলে থাকার, ভুলিয়ে রাখার উৎসবে কেউ সময় নষ্ট করে না। একটু বড় সাইজের সরস্বতীতে আরও কিছু হাত ফিট করা দুর্গা দেখতে কেউ রাজি নয় এখন। পুজোর অনেক আগেই 'সেরা কাঠামো সম্মান' ঘোষণা করা হয়। অসুরেরা লিক আউট করে দেয় (ওদের জন্য অসুরশ্রী প্রকল্প ঘোষিত হয়নি) কোন থিমকে এবারে মাথায় তোলা হবে। টার্গেট করে ছোটে সবাই।
চতুর্থীর রাতে সুমো ঠেসে আগেই লিস্টেড প্যান্ডেল দেখে ফেলতে পারলে ভালো। পরে বেরলে কিছুই দেখা যাবে না। সপ্তমীতে লাইনে দাঁড়ালে নবমীর রাতে ডেস্টিনেশন রিচড ব্যাপারটা হতেও পারে। এরই মধ্যে দুর্গালোভী অত্যুৎসাহীরা এগোতে থাকে বংশবন্ধন সরণি ধরে। দুর্গাদর্শন পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। ঠিক এই সময়, অনিবার্যভাবে, খিদে পেয়ে যায়। মূল মণ্ডপে যারা ঢুকতে পারল, তারা অন্যের ইচ্ছায়, পিঠে ক্রমাগত গুঁতো খেতে খেতে, উত্তোলিত চৈতন্যবাহুলগ্ন ফোনে ছবি তুলে নিয়ে হঠাৎ ইজেকটেড হয়ে যায়। সম্মান ছিনিয়ে নেওয়া সব দুর্গাপুজো মণ্ডপের আগে ও পরে অন্তত কিলোমিটার খানেক ছোট বড় প্যান্ডেল তৈরি থাকে। সেখানে চোখে পড়ে সর্ষের তেলের বিজ্ঞাপনে ঝাঁঝাল বাংলা ক্যাপশন, 'খুশির রাতে মাতো, সাজো। নিষ্ঠাভরে মানাও সবাই শারদীয় পেট পুজো।'
মেনুতে, স্টলের নামে চোখে পড়ে বাহারি সৃজনশীলতা। 'ম্যারাডোনা চাট', 'কার্তিকের বেকড পটেটো', 'ভাজাভুজিভজনা'। নামী দোকানের কপি, 'বলিহারি রান্না'। সহজ সরল 'শ্ৰীভেঙ্কটেশ বিরিয়ানী'। সীমান্ত পেরিয়ে 'ফা-হিয়েন ফাস্ট ফুড,' 'আদি তালিবান তেলেভাজা'। এর মধ্যেই হঠাৎ, 'কাফি কফিদে', 'শরবৎ-ই-হজম'। বেস্টসেলার রক্তবরণ, মুগ্ধকরণ শালু জড়ানো বিরিয়ানী। এরপর কড়াই ছেড়ে রকেটের মত আকাশে উঠতে থাকা পকেট ফ্রেন্ডলি চাউয়ের স্ফুলিঙ্গ। তার পর রোল। ইট অলওয়েজ রকস ম্যান। রাস্তার ঝিনচ্যাক আলো, ধুনোর স্মোকি ফ্লেভার, ঘোমটা চুড়ি ভেলপুরি, কোমরের বিপদসীমায় লটকে থাকা সুরক্ষিত জিনস, দশ হাতে জলজ ফুচকা বোমার ননস্টপ সরবরাহ, এসবের পাশে প্রায়ান্ধকার রেস্টুরেন্টের হিসহিসে এসির নিচে ফিসফিসে চেলো কাবাব গোলের পর গোল খেতে থাকে। ইউটিউবারদের কল্যাণে শুধুই অ্যালেন, পুঁটিরাম, অ্যামবার, নিজামস নয়, আদি কলকাতার গ্রেটার রেডিয়াসের পথে ঘাটে প্রচুর হ্যাংলামোর হ্যাংআউটের খবর পেয়ে গেছি আমরা। বসে সাঁটো, স্ন্যাচ-অ্যাওয়ে। যা খুশি।
নবমীর মধ্যরাত। রাসবিহারীর মোড়। চতুর্দিকে দুর্গা। বাঁশ ধরে এগোতে হবে। যেটি টার্গেট করেছেন, ধরা যাক 'ছাতিম সংঘ কদমতলা', সেটির বদলে অন্য দুর্গা ঘরে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আমি বুড়ো লোক, আর পারি না ঘুরতে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছিলাম। একটি পরিবার চোখে পড়ল। পোশাক দেখে মনে হল গ্রামের লোক। বসলাম। সেই সকালে এসেছে ওরা। দুপুরে ভোগ পেয়েছে। সারাদিন রাস্তায় ঘুরছে।
ভোররাতের লোকাল ধরে আবার ফিরবে। একটা বেঞ্চে মা, দুই মেয়ে, এক ছেলে আর বাবা পাশাপাশি বসেছে। মায়ের হাতে একটা প্লাস্টিকের থালা। এক প্লেটই নেওয়া হয়েছে। বাবা মা দুপাশ থেকে ঝুঁকে পড়ে দেখছে। নিজেরা নিচ্ছে না। বাচ্চারা খাচ্ছে। শুষে নিচ্ছে। দূর্গা দৃষ্টির আওতার বাইরে একটি প্লেট ও তিনটি মুখ ক্ষণিকের জন্য হলেও চাউ সূত্রে বাঁধা পড়ে গেল।
বাড়ি ফিরে একটু টিভি খুললাম। মহম্মদ আলি পার্ক, শ্রীভূমি, ত্রিধারা... স্ক্রিনের তলায় দুর্গা দর্শকের মিটার। এইমুহূর্তে কোথায় কত লক্ষ, মেপে যাচ্ছে। অন্য চ্যানেল। পুজোর সময় রাস্তার খাবার খাওয়ার পৌরাণিক উপযোগিতা প্রসঙ্গে ভাদুড়ি মশাই বলছেন ...
দশভুজার ভাজাভুজি
ফুটেই সুখের উৎস খুঁজি
দুর্গাস্থানে খাদ্যাসক্তি
প্রাচীন রক্ষা ক-ব-চ।