সুতীর্থ চক্রবর্তী: পুজোর বইয়ের স্টলে সিপিএমের আর একাধিপত্য না থাকলেও, প্রতি বছর সংবাদমাধ্যমে একমাত্র তাদের স্টলের বিক্রিবাটাই পরিমাপ করা হয়। বই বিক্রির অঙ্ক কি তাদের জনসমর্থনের সূচক? পুজোর সময় অন্তত স্টলে বই বিক্রির বহর দেখিয়ে এমনটাই বোঝানোর চেষ্টা করেন বাম নেতারা। কিছুদিন বাদে ভোটের বাক্সে অবশ্য জনসমর্থন বৃদ্ধির কোনও প্রতিফলন থাকে না।
মণ্ডপে স্টলের সংখ্যার নিরিখে এখন সিপিএমকে অনেক পিছনে ফেলে দেবে তৃণমূল। ‘জাগো বাংলা’র ব্যানারে পুজোয় তৃণমূলের কত বইয়ের স্টল হয়, সেই হিসাব নেতাদের কাছেও চট করে মিলবে না। তবে সেই সব স্টলে কতটা লোকসমাগম হল, তা নিয়ে বিচলিত হতে দেখা যায় না সংবাদমাধ্যমকে। তৃণমূল নেতারাও এই নিয়ে বিশেষ চর্চা করেন না। কারণ গোটা বাংলাজুড়ে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যেভাবে পুজোর সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকেন তাতে তাঁদের জনসংযোগের জন্য আলাদা করে পুজোমণ্ডপের বইয়ের স্টলের উপর নির্ভর করতে হয় না।
বাম জমানার ৩৪ বছরে পুরো মণ্ডপের সামনে বইয়ের স্টল দেওয়ার সংস্কৃতির বিস্তর চাষবাস হয়েছিল। লাল শালুতে মোড়া মার্কসবাদী সাহিত্যের স্টল পুজোর ভিড়ে সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ত। পুজো যত বড় হত, সিপিএমের স্টলও তত বড় হত। সেসময় আপাতভাবে ধর্ম ও জিরাফে যথেষ্ট বিরোধ ছিল। সরাসরি পুজো মণ্ডপের ভিতরে গিয়ে বসার ক্ষেত্রে লোকাল কমিটির নেতাদের কুণ্ঠা থাকত। পার্টির নিষেধাজ্ঞাও ছিল। বইয়ের স্টলই ছিল ভরসা। তখন স্টলের বিক্রিবাটার পরিমাপ নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না। দল ক্ষমতায়, ফলে পুজোর স্টলে ভিড়ও অঢেল। লোকাল কমিটির নেতাদের সুনজের পড়তে ঠাকুর দেখার ফঁাকে মার্কসবাদী সাহিত্য একটু ঘেঁটে দেখার লোকেরও অভাব ছিল না।
২০১১-এর পর ছবিটা দ্রুত বদলে গিয়েছে। অধিকাংশ মণ্ডপের বাইরে আর সেই লাল শালুতে মোড়া চিরাচরিত সিপিএমের বইয়ের স্টল খুঁজে পাওয়া যায় না। অল্প কয়েকটি বাছাই করা জায়গা ছাড়া স্টলে সাধারণ মানুষের ভিড় দেখা যায় না। কোথাও কোথাও কমরেডরা বুড়িছোঁয়ার মতো স্টলে হাজির হলেও, রাত নামতেই বেপাত্তা হয়ে যান। শূন্য স্টলগুলো যেন সিপিএমের কঙ্কালসার চেহারাটা নিয়ে মানুষের সামনে দঁাড়িয়ে থাকে। যাদবপুর এইটবি বা অারও যে দু’-চারটি স্টলে এখনও কিছুটা ভিড় হয়, সেখানকার বই বিক্রির হিসাব দিয়েই বাজার মাত করেন দলের নেতারা।
পুজোয় মণ্ডপের সামনে বইয়ের স্টল দেওয়ার সংস্কৃতি যে বামপন্থীরাই আমদানি করেছিল তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। স্বাধীনতার পর পরই সম্ভবত এই সংস্কৃতির প্রবর্তন ঘটে। সিপিএমের নেতাদের কাছে জানা যায়, ১৯৫৪ সালে পার্কসার্কাসে মুজফ্ফর আহমেদের উদ্যোগে প্রথম পুজোয় বইয়ের স্টল দেওয়া হয়েছিল। পার্কসার্কাসে স্টল দেওয়ার ঐতিহ্য এখনও সিপিএম নেতারা ধরে রেখেছেন। সেই যুগে পুজোর বইয়ের স্টলে পার্টির পত্র-পত্রিকা ছাড়াও নজর কাড়ত সোভিয়েত ইউনিয়নের বই। অনেকে সস্তায় সোভিয়েত বইয়ের আকর্ষণেই স্টলে ভিড় করতেন। সোভিয়েতের বই চলে যাওয়া যে মার্কসবাদী বইয়ের স্টলগুলিকে অনেকটা বিবর্ণ করেছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
পুজোর বইয়ের স্টলে দলীয় প্রচার পুস্তিকা ও নানা রাজনৈতিক বিষয়ের প্রবন্ধের বই-ই মূলত বিক্রি হয়। সিংহভাগ ক্রেতাই থাকেন দলের নেতা, কর্মী ও সমর্থকরা। পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে সাধারণ সাহিত্যানুরাগীরা খুব অল্পই বই কেনেন। সমাজ মাধ্যমের যুগে সব ধরনের বই পড়াই কমেছে। স্রোতের উলটোপথে হেঁটে পুজোয় বইয়ের স্টলে বিক্রি বাড়বে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। সেটা ঘটছেও না। বামপন্থীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিয়েই বরাবর পুজোয় বুকস্টল করে এসেছেন। এখনও তাই করেন। সরকারে অাসার অাগে পুজোর বইয়ের স্টল তাদের রাজনৈতিক প্রচারের মঞ্চ করে দিত। সরকারে থাকার সময় বইয়ের স্টল ছিল পুজোর উৎসবে শামিল হওয়ার মাধ্যম। স্টলে বসে নেতা-কর্মীরা এলাকায় নজরদারিও রাখতে পারতেন ও সময়ও কাটাতে পারতেন। এখন সংকটের সময়ে পুজোর বইয়ের স্টলকে ঘিরে কমরেডরা ফের জনসংযোগ স্থাপনের চেষ্টায়।
একসময় বামপন্থীদের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমে তৃণমূলও পুজোয় বইয়ের স্টল দেওয়া শুরু করে। যেখানে দলের মুখপত্র ‘জাগো বাংলার’ শারদ সংখ্যা ছাড়া প্রধানত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বই বিক্রি হয়। ক্ষমতায় অাসার পর তৃণমূলের স্টলের সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে। কিন্তু পুজোয় বইয়ের স্টল দেওয়া তৃণমূলের কাছে অানুষ্ঠানিকতা মাত্র। কারণ দলের নেতা-কর্মীরা প্রতিটি পুজো মণ্ডপেই হাজির। এত বড় উৎসবের কেন্দ্রবিন্দুতেই তঁারা। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলি তাদের এলাকাগত রাজনৈতিক শক্তির হাল বুঝে কয়েকটি করে বইয়ের স্টল দেয়। কিন্তু পুজোর বইয়ের স্টলের সংস্কৃতির ধারক বাহক মূলত সিপিএমই। এই সংস্কৃতি অাগামিদিনেও বহমান থাকবে কিনা তা সিপিএমের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের সঙ্গেই ঝুলে থাকবে।