বোরিয়া মজুমদার: স্বাধীনতার ৭৪ বছর পূর্ণ হল রবিবার। আমরা যখন স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছি, তখন মনে একটাই প্রশ্ন জাগছে– আমাদের কাছে ‘স্বাধীনতা’ কথাটার আসল অর্থ কী? এককথায়, স্বাধীনতা এমন এক সমাজের ধারক, যা সংবেদনশীল, বিবেকবোধসম্পন্ন ও সহানুভূতিময়। আর, যে-সমাজ একইসঙ্গে যত্নশীল। ব্যক্তিগতভাবে বলতে পারি, খেলাধুলো নিয়ে চর্চা করার দরুন, সমাজকে আমি দেখতে চাই খেলাধুলোর বহুমাত্রিক প্রিজমের মধ্য দিয়ে।
টোকিও অলিম্পিকের (Tokyo Olympics) কথা ধরা যাক। এই প্রথম ভারত ১২৬ জন অ্যাথলিটের একটি ক্রীড়াব্যুহ অলিম্পিকে পাঠিয়েছিল। এটি প্রগতিরই পরিচায়ক। এই ক্রীড়াবিদদের প্রত্যেকেই কঠোর পরিশ্রম করে অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। সে-ই কৃতিত্বও নেহাত কম নয়। এঁদের মধ্যে ৬ জন ব্যক্তিগত স্তরে পদক জিতেছেন। ভারতের পুরুষ হকি দলও ব্রোঞ্জ পদক জিতেছে, যেখানে আরও ১৬ জন খেলোয়াড় রয়েছেন। পদক অধরা থাকলেও এই তালিকায় গলফার অদিতি অশোক এবং মহিলা হকি দলের ১৬ জনকেও শামিল করা উচিত, কারণ তাঁদের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে দেশ গর্বিত। সুতরাং, ১২৬ জন ক্রীড়াবিদের প্রায় ৪০ জন এখনও রয়েছেন সংবাদপত্রের শিরোনামে। তাঁরা প্রশংসিত ও সম্মানিত হচ্ছেন।
এখন প্রশ্ন হল, বাকি ৮৬ জন, যাঁরা আশানুরূপ ফল করতে না পারায় স্বীকৃতির আলো থেকে সাময়িকভাবে বঞ্চিত, তাঁদের কথা কি কারও মনে আছে? তাঁরা এখন কোথায়? কীভাবে ব্যর্থতার মোকাবিলা করছেন তাঁরা? তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্য, হতাশার খোঁজ কি কেউ নিয়েছে? সিমোন বাইলস মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে চেয়েছেন, সেই সিদ্ধান্তকে আমরা সাদরে মেনে নিয়েছি, সেই একই গ্রহণযোগ্যতা ও সমর্থন আমরা নিজের দেশের ক্রীড়াবিদদের প্রতি কি দেখাতে পারি না?
[আরও পড়ুন: শুধু ভারত নয়, Neeraj-এর সোনা জয়ে উচ্ছ্বসিত কয়েক হাজার মাইল দূরের জার্মান গ্রামও]
১৯ বছর বয়সি মানু ভাকের-এর কথাই ধরুন। পদক জিততে না পারায় তাঁকে নিষ্ঠুরভাবে ট্রোল করা হল। প্রথমত, তিনি তাঁর নিজের যোগ্যতায় অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তিনি কারও কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন না যে, একটি পদক তিনি নিশ্চিত করবেন। পদক জিততে না পারায় প্রশ্নাতীতভাবে সবচেয়ে বেশি হতাশ তিনিই। আমরা কি জানার চেষ্টা করেছি, মানু ভাকের কতটা মনোকষ্টে রয়েছেন? এই কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে তিনি কীভাবে যুঝছেন? তিনি কি বিষণ্ণ ও অবসাদগ্রস্ত?
ভুলে গেলে চলবে না, আজ যাঁরা পরাজিত, তাঁরাই হয়তো আগামীর বিজয়ী। মানু ভাকের একজন বিরল প্রতিভাবান ক্রীড়াবিদ, একথাও স্মরণে রাখতে হবে। সমাজের প্রতিনিধি হিসাবে যদি আমরা পরাজিত ক্রীড়াবিদদের প্রতি সহানুভূতিশীল না হতে পারি, তাহলে জাতি হিসাবেও আমাদের উন্নতি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়বে। ভিনেশ ফোগাটের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য, যিনি সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে একটি আবেগপ্রবণ লেখা লিখেছেন, তাঁর মানসিক যন্ত্রণার কথা তুলে ধরেন। ভিনেশের কথায়, পদক জিততে না পারা যেন এক গুরুতর অপরাধ, যার দায়েই এমন তিক্ত আচরণের সম্মুখীন তিনি। এই প্রসঙ্গে আমি অমিত পাঙ্ঘাল এবং দীপক পুনিয়ার কথাও আলোচনার আলোতে আনতে চাইব। আমরা এতদিনে জেনে গিয়েছি, একটি ব্রোঞ্জ পদক আমাদের দেশে বিজয়ীকে ১০ কোটি টাকা সাম্মানিক অর্থের প্রাপক করে তোলে। এই বিপুল সাম্মানিক অর্থরাশি স্বভাবতই তাঁদের ভবিষ্যতের পথ মসৃণ করে।
আমাদের দেশের মাত্র ১ শতাংশ মানুষ তাঁদের সারা জীবনে এই বিরাট অঙ্কের অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম। দীপক পুনিয়ার রেকর্ড ও ব্রোঞ্জ পদক জয়ের ফারাক ছিল মাত্র ১০ সেকেন্ড। ওই সময়েই তিনি এই বিপুল অর্থলাভের পথ নিশ্চিত করে ফেলতে পারতেন। ১০ সেকেন্ড। হ্যাঁ, এতটাই কাছে ছিল লক্ষ্য। দীপক এখন কোথায়, কী করছেন? তাঁর ম্যাচটি খুঁটিয়ে দেখলে আরও কয়েকটা বিষয় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বলা যেতে পারে, দীপকের কপাল সেদিন মন্দ ছিল। ম্যাচের একটা পর্যায়ে তিনি দু’টি মূল্যবান পয়েন্ট প্রায় জিতে গিয়েছিলেন। কিন্তু রেসলিং এবং বক্সিংয়ের মতো আপেক্ষিক খেলার ফলাফল অনেকটাই নির্ভর করে বিচারকদের উপর। দীপকের ‘প্রাপ্য পয়েন্ট’ বিচারকরা নাকচ করে দেন। এরপর ম্যাচের শেষ কয়েক সেকেন্ডে ম্যাচ একেবারেই দীপকের হাত থেকে বেরিয়ে যায়।
[আরও পড়ুন: বিতর্কে ইংল্যান্ডের সমর্থকরা, Lord’s-এ রাহুলকে লক্ষ্য করে ছোঁড়া হল শ্যাম্পেনের ছিপি]
সংক্ষেপে বলতে গেলে, এইভাবে পদক হারানো অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। যখন সারা দেশ মহিলা হকি দলের চতুর্থ স্থান অর্জনের আনন্দে মাতোয়ারা, অদিতি অশোক যখন গলফ দুনিয়ায় বিপ্লব ঘটাচ্ছেন, তখন দীপকের অসহায়ত্বের কথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এতটা পথ অতিক্রম করে পদক জয়ের এত কাছাকাছি এসেও তিনি শেষরক্ষা করতে পারলেন না। যতক্ষণ না আমরা তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল হতে পারছি, তাঁকে সসম্মানে লড়াইয়ের মঞ্চে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হচ্ছি, ততক্ষণ আমাদের সমাজ সর্বৈব ব্যর্থ। এবার আসব অমিত পাঙ্ঘালের কথায়। অলিম্পিকে তিনি ছিলেন আমাদের সেরা পদক-প্রত্যাশীদের একজন। এশিয়ান গেমস চ্যাম্পিয়ন এবং বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ পদক-বিজয়ী, বক্সিংয়ের পরিবার থেকে উঠে আসা অমিতের দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা দেশ। টোকিওতে অমিত প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম রাউন্ডে অসাধারণ পারফর্ম করে ৪-১ ফলাফলে জিতে গেলেও পরের দুই রাউন্ডে তিনি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হন। প্রশ্ন উঠছে, এমন কেন হল? তাঁর কোচকে এই প্রশ্ন করায় তিনি জানান, অমিত ক্লান্ত ছিলেন। কথাটা মনঃপুত হল না, তাই তো? বিশ্বের সেরা মঞ্চে আমাদের অন্যতম সেরা বক্সার কেন ৩ মিনিটের মধ্যে ক্লান্ত হয়ে পড়লেন? অমিত পাঙ্ঘালের সঙ্গে সত্যিই কী ঘটেছিল? এমন কি কোনও গল্প রয়েছে আমাদের আড়ালে, যা আমরা জানি না? অমিত কি কখনও খুলে বলবেন, আসলে কোন সমস্যার সম্মুখীন হয়েছিলেন তিনি? জানা গিয়েছে, তাঁর খাদ্যতালিকা অসম্পূর্ণ থাকার কারণেই তাঁর এই দুর্বলতা। প্রশ্ন হল, কেন? কেন ক্রীড়াবিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে তাঁর খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা গেল না? সত্যিই কিছু আমাদের অগোচরে থেকে যাচ্ছে না তো?
আমি যে-বিষয়ে জোর দিতে চাইব, তা হল, এই যে বাকি ৮৬ জন প্রতিযোগী, যাঁদের আমাদের সমাজ প্রায় ভুলতে বসেছে, তাঁদের নিয়ে আলোচনা করার সময় এসেছে এবার। তাঁদেরও পদকজয়ীদের মতো একই সম্মান প্রাপ্য। শুধুমাত্র বিজয়ীদের সম্মান জানানো ও পরাজিতদের যারপরনাই উপেক্ষা করার এই ভয়াবহ ভারতীয় অভ্যাস বন্ধ করার এটাই সঠিক সময়। আমরা যদি এই অভ্যাস ত্যাগ করতে সক্ষম হই, তাহলেই হয়তো একটি বহুমুখী প্রতিভার দেশ হয়ে উঠবে ভারত, যেখানে সবাই খেলাধুলোর প্রতি সমান আগ্রহী। শুধুমাত্র যাঁরা পদকজয়ী, তাঁরা নন, প্রত্যেক অ্যাথলিটই হবেন সম্মানের সমান ভাগীদার। আমাদের এই পক্ষপাতদুষ্ট আচরণের ফলেই অতীতে বহু ক্রীড়াবিদ অনুগ্রহ ও দারিদ্রের জীবন কাটিয়েছেন। দেশের প্রতিনিধিত্বকারী কেউই এই অসম্মানের যোগ্য নন। আজ, স্বাধীনতা দিবসের দিনে, অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে এই ভুলের পুনরাবৃত্তি যাতে না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে হবে। সমাজ হিসাবে আমাদের হয়ে উঠতে হবে আরও শ্রদ্ধাশীল এবং অমায়িক। মানুষকে তার প্রচেষ্টার জন্য সম্মানিত করায় এগিয়ে আসতে হবে আমাদের। শুধুমাত্র যাঁরা সফল, তাঁদের ঘিরেই আমাদের উদযাপন যেন সীমিত না থাকে। এই ভাবমূর্তি আমাদের দেশকে করে তুলবে সর্বাঙ্গীণ রূপে উন্নত। ১৫ আগস্টে আমার চোখে এই স্বপ্নই জেগে থাকে।
[আরও পড়ুন: India vs England: ব্যাটসম্যানদের আউট করেই কেন মুখে আঙুল রেখে সেলিব্রেশন? জানালেন Siraj]