গণলাঞ্চনা ও গণপিটুনিতে ধরা পড়ে ব্যক্তিগত হতাশা, না-পাওয়া, রাগ ও মেঘলা মনের প্রতিক্রিয়া। মৃত্যু সেই সময় যেন জলভাত।
‘দ্য পুলিশ’। এই নামে বিখ্যাত রক ব্যান্ড গ্রুপটি তৈরি হয়েছিল ১৯৭৭ সালে। সংগীতে ঐতিহাসিকভাবে ‘ব্রিটিশ নিউ ওয়েভ’ বলতে যা বোঝায়, তার অন্যতম পুরোধা বলে বিবেচিত হয় এই ব্যান্ড গ্রুপটি। ১৯৮৩ সালে ‘মার্ডার বাই নাম্বার্স’ গানে তারা তুলে ধরেছিল এমন কয়েকটি পঙ্ক্তি– ‘ওয়ান্স দ্যাট ইউ হ্যাভ ডিসাইডেড অন আ কিলিং/ ফার্স্ট ইউ মেক আ স্টোন অফ ইওর হার্ট/ অ্যান্ড ইফ ইউ ফাইন্ড দ্যাট ইওর হ্যান্ডস আর স্টিল উইলিং/ দেন ইউ ক্যান টার্ন আ মার্ডার ইনটু আর্ট’। মর্মার্থ জলবৎ তরলং। নিজের হৃদয় ও অন্তর সত্তাকে পাথরের মতো কঠিন করে তুলতে না-পারলে টন-টন হিংস্রতা নিয়ে কারও প্রতি ধাবিত হওয়া যায় না, কারও উপর ঝঁাপিয়ে পড়া যায় না। যে এসব পারে, সে খুনকে করে তোলে শিল্পসম্মত। এই কথাটি গণলাঞ্ছনার ক্ষেত্রেও খাটে বইকি।
‘গণপিটুনি’-র নেপথ্যে থাকা মানসিকতার বিশ্লেষণ করতে চেয়ে একটি অনবদ্য গবেষণাপত্র লিখেছেন স্টুয়ার্ট স্টিভেনসন, ২০২১ সালে। শিরোনাম: ‘দ্য সাইকোডায়নামিক্স অফ লিঞ্চ মব্স: গ্রুপিং, গ্যাংগিং অর লিঞ্চিং’। সেখানে মার্কিন সমাজের নিবিড় প্রেক্ষিত থাকলেও মূলগত তত্ত্বভাবনায় এই গবেষণাপত্রের অনেকাংশই হয়তো বৃহত্তর পৃথিবীর নৃশংস বাস্তবের সঙ্গে মিলে যায়। গণলাঞ্ছনা এবং গণপিটুনির ভ্রূণ-কারণটি শনাক্ত করতে চেয়ে তিনি ব্যবহার করেছেন ‘রেসিস্ট ইরাশিওর’ শব্দবন্ধটি। জনসমাজের একটি জনগোষ্ঠীর আধিপত্যবাদী মানসিকতা তুলনায় ‘সংখ্যালঘু’ ও ‘অপর’ বলে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীকে লাঞ্ছিত করতে চায় সবসময়। অস্তিত্বের বিপন্নতার দিকে ঠেলে দেয়। সমরূপ মনোবৃত্তি ক্রিয়াশীল হতে পারে একজন একা মানুষকে গোষ্ঠীগতভাবে লাঞ্ছিত করার বেলাতেও। ক্ষমতার চেনা কাঠামোয় আধিপত্য দঁাত-নখ সহযোগে আক্রমণ হানে দুর্বলের প্রতি। আর, তার সঙ্গে মিশতে থাকে ব্যক্তিমানুষের অচরিতার্থতার স্রোত।
[আরও পড়ুন: ‘চিন্তার কিছু নেই’, শূন্যে বন্দি সুনীতাকে নিয়ে বড় বার্তা ISRO প্রধানের]
বউবাজারের মুচিপাড়ায় সদ্য একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। পুরুষ ছাত্রাবাসের একদঙ্গল ছাত্রের হাতে গণপিটুনিতে মারা গিয়েছেন একজন যুবক। তার বিরুদ্ধে মোবাইল চুরির অভিযোগ ছিল, যা গাঢ় সন্দেহের রঙে পরিবর্তিত হয়, এবং তারই নির্যাস– নিষ্ঠুর মার, ওই যুবক মারা যান সেই জেরে। এখানে গণ-আক্রোশের যে-ছবি আমরা দেখলাম, তা শিউরে ওঠার মতো। কয়েক দিন আগে ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে বারাসতে দু’জনকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছিল। এই গুজবের বাস্তব ভিত্তি থাক, বা না-থাক, সমবেত জনতা প্রথমেই একটি ‘অপর’ নির্মাণের চেষ্টা করে। যার উপর আরোপ করা হয় অপরাধের ছায়া।
[আরও পড়ুন: তৃতীয় বার ক্ষমতায় এসেই প্রথম ‘মন কি বাত’ মোদির, বৃক্ষরোপণে উৎসাহ দিলেন প্রধানমন্ত্রী]
এরপর আসে আইন হাতে তুলে নেওয়ার সহজতম পন্থা– গণপিটুনি। ব্যক্তিগত হতাশা, না-পাওয়া, রাগ ও মেঘলা মনের প্রতিক্রিয়ার ফল তখন হয়ে ওঠে এত বিষময়, যে, মার খেতে খেতে একটি মানুষের মৃত্যু অবধি
ঘটে যায়। মৃত্যু হয়ে ওঠে খেলাধুলোর মতো আনন্দদায়ক।