সুমন ভট্টাচার্য: ঠিক যখন আফগানিস্তান শরিয়া আইন মোতাবেক সে-দেশটি চালানোর কথা সদম্ভে বলছে, তখন বাংলাদেশ (Bangladesh) যদি ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসাবে ইসলামকে বাদ দিতে পারে, তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতে কতটা আলোড়ন উঠবে? তা-ও আবার, গেল দুর্গাপুজোয় বাংলাদেশে মৌলবাদী তাণ্ডবের পরিপ্রেক্ষিতে দাঁড়িয়ে? শেখ হাসিনার সরকারের এই পদক্ষেপকে কীভাবে দেখা উচিত? শেখ হাসিনা কি এরপর থেকে ইন্দিরা গান্ধীর (Indira Gandhi) মতো ইতিহাসে আলাদা গুরুত্ব পাবেন সাহসী নেত্রী বলে? একটা কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার সরকার যদি এই পথে হাঁটতে পারে, তাহলে সেটা ‘মাস্টারস্ট্রোক’ তো হবেই, সম্ভবত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রাজনীতিতেও নতুন সমীকরণ তৈরি করবে। কারণ, সাম্প্রতিক পুজোমণ্ডপে হাঙ্গামার পরিপ্রেক্ষিতে একদিকে যেমন বাংলাদেশের তথ্য ও সম্প্রচার রাষ্ট্রমন্ত্রী মাসুদ হাসান (Masood Hasan) ‘রাষ্ট্রধর্ম’ থেকে ইসলামকে বাদ দেওয়ার কথা জোর গলায় বলেছেন, তেমনই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টভাবে ভারতকে নিজ-দায়িত্বের কথাও স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছেন, ভারতে যদি সে-দেশের সংখ্যালঘুরা বিদ্বেষ বা নিপীড়নের শিকার হয়, তাহলে সেই কুপ্রভাব সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে পড়তে পারে। অর্থাৎ শেখ হাসিনা খুব সচেতনভাবে ভারতের বর্তমান সরকার এবং শাসক বিজেপি দলকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, ভারতে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার বা জাতিবিদ্বেষ সমগ্র উপমহাদেশে কী ধরনের অশান্তি বা অস্থিরতা তৈরি করতে পারে।
[আরও পড়ুন: বাংলাদশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে তাস খেলার আগে সতর্ক থাকা উচিত বিজেপির]
হাসিনার এই সতর্কবাণী ঠিক সেই সময়ে এল, যখন কাবুলে ইসলামাবাদের বন্ধু তালিবানরা ক্ষমতায় বসেছে, নেপাল ঝুঁকে বেজিংয়ের (Bejing) দিকে, এবং উপমহাদেশে ‘বন্ধু’ খুঁজতে নয়াদিল্লির দূরবিনেও কাজ হচ্ছে না। গত এক দশক ধরে ভারতের বিদেশনীতি যে ওয়াশিংটনের রিপিট টেলিকাস্ট করতে অভ্যস্ত ছিল, তা আফগানিস্তানের রুক্ষ মাটিতে আছড়ে পড়েছে। পুরনো বন্ধু মস্কোর ডাকে তাই ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রকের (MEA) শীর্ষ প্রতিনিধি দল গত সপ্তাহে রাশিয়ায় তালিবানদের সঙ্গে সরাসরি বৈঠকেও বসেছে।
তালিবানদের একেবারে বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকার কী বার্তা দিতে চাইছে? ইসলাম বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ নয়। বাংলাদেশ বরং ‘বঙ্গবন্ধু’-র প্রস্তাবিত ১৯৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাবে, যে সংবিধানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশ নিজেদের ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ বলে ঘোষণা করেছিল। ১৯৭২-এর নিরিখে সেটা যেমন একটা ‘ঐতিহাসিক’ ঘোষণা ছিল, এবং জিন্নার দ্বিজাতি তত্ত্বের বিরুদ্ধে সোচ্চার উচ্চারণ ছিল, তেমনই এই ২০২১ সালেও তা শেখ হাসিনার সাহসী সিদ্ধান্ত ও ‘ঐতিহাসিক’ পদক্ষেপ হতে পারে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি বাদ যায় জেনারেল জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের সময়। আর, বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসাবে ইসলামকে সংসদে অনুমোদন করিয়ে নেন আর-এক সামরিক শাসক হুসেন মহম্মদ এরশাদ, যে এরশাদকে কবি এবং সংস্কৃতিমনস্ক রূপে তুলে ধরতে ওপার বাংলায় তো বটেই, এপার বাংলাতেও কম চেষ্টা হয়নি।
সুখের কথা, এই দুই সামরিক শাসক বাংলাদেশকে যে-পথে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন, ’৯০-উত্তর, প্রতিবেশী দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসার পরে, সেখানকার নাগরিক সমাজ-ই তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, আদালতে গিয়েছে। তাই জিয়াউর রহমানের সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি বাদ দেওয়ার উদ্যোগ ও সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টেই খারিজ হয়ে গিয়েছে। এবার শেখ হাসিনা যদি আরও এক কদম এগিয়ে ১৯৭২-এর সংবিধানে ফেরত যান, এবং ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসাবে ইসলামকেই বাদ দেন, তাহলে সেটাকে তো বাংলাদেশে মৌলবাদের বিরুদ্ধে জোরালো ধাক্কা হিসাবেই দেখতে হবে। বিশেষ করে এই পুজোয় কুমিল্লায় কোরান শরিফের অবমাননার অভিযোগ তুলে বিভিন্ন শহরে যেভাবে পুজো মণ্ডপে হামলা হল, তৌহিদি জামাতের নামে জমায়েত করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর যেরকম আক্রমণ হল, তার পরিপ্রেক্ষিতে হাসিনার (Saikh Haseena) সিদ্ধান্ত বৈপ্লবিক সাব্যস্ত হতে পারে।
মৌলবাদীদের ফ্রন্টফুটে গিয়ে মোকাবিলা করে একই সঙ্গে বোধহয় শেখ হাসিনা ভারতের জন্য, ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদের জন্য, এবং ত্রাস ছড়িয়ে দিতে চাওয়া রাজনৈতিক দলগুলির জন্য বড় প্রশ্নচিহ্ন ছুড়ে দিলেন। ভারতের সংখ্যাগুরুরা এবার সংখ্যালঘুদের কী চোখে দেখবেন? রাজনৈতিক দলগুলি ভোটকেই ‘পাখির চোখ’ করবে, না দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে নজর দেবে? মাথাপিছু গড় জিডিপি (GDP) এবং ক্ষুধার সূচকে ভারতকে টপকে যাওয়ার পর বাংলাদেশের নেত্রী হিসাবে শেখ হাসিনার এই প্রশ্ন তোলার হকও রয়েছে।
[আরও পড়ুন: কাশ্মীরে হঠাৎ আলোর ঝলকানি? অরুণ মিশ্রর শাহ-বন্দনা কতটা যুক্তিযুক্ত]
শেখ হাসিনার এই প্রশ্নটিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয় যে, একটি টায়ার কোম্পানি যদি এদেশে আমির খানকে দিয়ে দীপাবলিতে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে বাজি ফাটানোর বিজ্ঞাপন করায়, তাহলে তাও কি হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদের আওতায় পড়ে? বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা সেই বিজ্ঞাপনকেও বয়কটের ডাক দেন, ঠিক যেমনভাবে কোনও পোশাকের ব্র্যান্ডকে সোশ্যাল মিডিয়ায় আক্রমণের মুখোমুখি হতে হয় ‘উর্দু’ শব্দ ব্যবহারের জন্য। না, আমি সেই বহু পুরনো এবং ক্লিশে ‘গুড মুসলিম’ আর ‘ব্যাড মুসলিম’-এর প্রতর্কে ঢুকছি না। কিন্তু শেখ হাসিনা তাঁর হাতের তাসটা সযত্নে টেবিলের উপর রেখেছেন। কাবুলে শরিয়া শাসনের বিপরীতে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশে ‘রাষ্ট্রধর্ম’ হিসাবে ইসলামকে সরিয়ে দেওয়ার কথা বলে। আমাদের, মানে নয়াদিল্লি এবং ভারতের সংখ্যাগুরুদের, তাই এবার সিদ্ধান্ত নিতে হবে: আমরা প্রতিবেশীকে কীভাবে দেখতে চাইব? তেজস্বী সূর্যদের পথে ভারত হাঁটলে বেজিং খুশিই হবে, আর মৌলবাদও জিতে যাবে।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
suman09bhattacharyya@gmail.com