গত দশ বছরে বিরোধীদের চাপ ও জনতার আন্দোলনে প্রধানমন্ত্রী একবারই মাথা নুইয়েছিলেন– কৃষি আইন প্রত্যাহার করে। সেই তিনি জুন মাসের পর সম্পূর্ণ অন্য চরিত্র যেন! একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, চাপে পড়ে পিছিয়ে আসছেন। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়।
হরিয়ানা ও জম্মু-কাশ্মীরে নির্বাচনী প্রচারে গিয়ে রাহুল গান্ধী মশকরা করে একটা কথা বেশ কয়েকবার বলেছেন। অনেক দিন ধরেই তঁার রাজনৈতিক আক্রমণের লক্ষ্য একজনই। নরেন্দ্র মোদি। তঁার নাম করে ভঙ্গি-সহকারে তিনি বলেছেন, ‘আগে প্রধানমন্ত্রী বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করতেন। কিন্তু জুন মাস থেকেই চুপসে গিয়েছেন। ঝুঁকে পড়েছেন। সেই দর্প ও দাপাদাপি আর দেখা যাচ্ছে না। এই পরিবর্তন ঘটিয়েছেন আপনারা। আপনাদের রায়।’
রাজনীতিকরা নিজের মতো আচরণ করবেন। প্রধানমন্ত্রীর চলাফেরা, দাপাদাপি, আত্মবিশ্বাস ইত্যাদি নিয়ে তঁারা তঁাদের মতো ব্যাখ্যা করবেন। এ নিয়ে বলার কিছু নেই। আমি দেখছি অন্য এক পরিবর্তন!
‘গোদি মিডিয়া’ নামে যারা পরিচিত, প্রধানমন্ত্রী যা-ই করুন, যা-ই বলুন, নির্দ্বিধায় যারা তা এতদিন প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে ছাপাত, তারা তঁার প্রচারে ইদানীং কিছুটা হলেও রাশ টেনেছে। রাহুল, কংগ্রেস দল ও অন্য বিরোধীদের আগের তুলনায় কিছুটা বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। সরকারের কিছু কিছু সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সম্পাদকীয় নিবন্ধও লিখছে। মনে হচ্ছে, শিরদঁাড়া খুঁজে পাওয়ার একটা চেষ্টা, প্রবলভাবে না হলেও, যেন শুরু হয়েছে। মিডিয়ার সঙ্গে হাওয়া মোরগের খুব একটা ফারাক নেই। রাজনৈতিক হাওয়ার গতিপ্রকৃতি মিডিয়া ভালোই ধরতে পারে। বঁাচার পথ তারাও খুলে রাখতে চায়।
প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আস্থার অভাবও ভালোই দেখা যাচ্ছে। গত দশ বছরে বিরোধীদের চাপ ও জনতার আন্দোলনে তিনি একবারই মাত্র মাথা নুইয়েছিলেন। কৃষি আইন প্রত্যাহার করেছিলেন। এর বাইরে থমকে গিয়েছিলেন ‘সিএএ’ আইন চালু করার ক্ষেত্রে। নানা ছুতোয় প্রায় পঁাচ বছর কাটিয়ে শেষমেশ এবার লোকসভা ভোটের আগে তা চালু করেন। যদিও তাতে রাজনৈতিক ফায়দা বিশেষ একটা হয়নি। সেই প্রধানমন্ত্রী জুন মাসের পর সম্পূর্ণ অন্য চরিত্র যেন! একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন, কিন্তু চাপে পড়ে পিছিয়ে আসছেন। একটি নয়, দুটি নয়, পঁাচ-ছটি নমুনা জ্বলজ্বল করছে।
[আরও পড়ুন: ‘যার কাছে মহিলারা নিরাপদ…’, অস্থির সময়ে স্বামী স্বর্ণেন্দুকে নিয়ে গর্বিত শ্রুতি]
যেমন, বাজেটে বাড়ি কেনাবেচার মূলধনী লাভের উপর ঘুরিয়ে কর বাড়ানোর প্রস্তাব রেখেও পিছিয়ে এসেছেন। পুরনো পেনশন প্রথা তুলে দিয়ে চালু করেছিলেন নতুন পেনশন ব্যবস্থা। চাপে পড়ে চালু করলেন নতুন ন্যূনতম পেনশন। তাতে সরকারি কর্মীদের ক্ষোভ যদিও কমেনি। সম্প্রচার বিলের খসড়া পেশ করেছিলেন, কিন্তু বিরোধীদের আপত্তিতে সরে এসেছেন। ওয়াকফ বিলের সংশোধনী যৌথ সংসদীয় কমিটিতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন বিরোধীদের সঙ্গে শরিকরাও গলা মেলানোয়। বাতিল করেছেন আমলাশাহিতে ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’ বা সরাসরি নিযুক্তির সিদ্ধান্ত। জীবন ও চিকিৎসা বিমার উপর চড়া হারে জিএসটি চাপানোর সিদ্ধান্তও আজ অথবা কাল প্রত্যাহৃত হতে পারে। ভোটের পর ‘অভিন্ন দেওয়ানি বিধি’ নিয়ে সরকার স্পিকটি নট। শোনা যাচ্ছে ‘অগ্নিবীর’ প্রকল্পেও সংশোধন আনার কথা। প্রতিরক্ষামন্ত্রী নিজেই সেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। বিরোধীরা ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি না করলে এবং প্রধানমন্ত্রী দুর্বল না হলে এগুলো কি হত? প্রথম দশ বছরের ছবিটা মনে মনে একটু এঁকে দেখুন তো?
এসবের বাইরে রয়েছে জাতগণনার প্রশ্ন। রাহুলের পাশাপাশি বিরোধীরা একযোগে সরব হওয়ার পর সরকারের শরিকদের মধ্যেও দোলাচল শুরু হয়েছে। জেডিইউ আগেই এই দাবি জানিয়েছিল। সেখান থেকে এখন তাদের সরে আসা কঠিন। আরএলডি, এলজেপি, নিষাদ পার্টি ও আপনা দলে গুঞ্জন শুরু হয়েছে। টিডিপির চন্দ্রবাবু নাইডু কী করবেন জানা নেই। হাতের তাস তিনি এখনও দেখাননি। এই অবস্থায় চাপ বাড়িয়েছে আরএসএস। জানিয়েছে, জাতগণনা হতেই পারে, তবে তা নিয়ে রাজনীতি করা অন্যায়। বেশ বোঝা যাচ্ছে, মোদির কাছে জাতগণনাও হতে চলেছে ‘দো ধারি তলোয়ার’।
[আরও পড়ুন: নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী-ঋতাভরী সাক্ষাৎ, টলিউডের যৌন হেনস্তার তদন্তে এবার অরাজনৈতিক কমিটি!]
এই অবস্থায় কুঁজো হয়ে ঝুঁকে পড়া ছাড়া মোদির কী উপায় আছে? রাজনীতির মজা হল, চাকা যতদিন গড়গড়িয়ে গড়াচ্ছে, ততদিন ‘সব ঠিক হ্যায়’। কোথাও কোনও ফঁাকফোকর বা ছিদ্র নজরে পড়বে না। হোঁচট খেলে কিংবা বিজয়রথের চাকা গাড্ডায় পড়লে একে একে সহস্র ছিদ্র চোখে পড়ে। ‘চারশো পার’-এর জায়গায় ২৪০ হয়েছে কি হয়নি, জুন মাস থেকেই প্রধানমন্ত্রীর মাথায় ছোট ছোট আকাশ ভাঙতে শুরু করেছে। সেসবও ঠেকানো যেত উত্তরপ্রদেশ বিমুখ না হলে। কিন্তু বৃহত্তম রাজ্য গলার কঁাটা হয়ে খচখচ করছেই। রাজ্যপাট ঠিক রাখতে মোদি চেষ্টার অন্ত রাখছেন না। যদিও বেসুরো গাইতে শুরু করেছে হরিয়ানা। কিছুটা জম্মুর নেতারাও। বিক্ষোভে দলটা জেরবার। হরিয়ানায় তো সম্ভাব্য হয়রানির দেওয়াল লিখন স্পষ্ট। বিজেপি নিশ্চিত নয় জম্মু-কাশ্মীরকে প্রথম হিন্দু মুখ্যমন্ত্রী উপহার দিতে পারবে কি না, তা নিয়েও।
অক্টোবরের বিপর্যয়ের ক্ষতে মহারাষ্ট্র ও ঝাড়খণ্ড যে নভেম্বরে প্রলেপ লাগাবে, বুক ঠুকে সেই অভয় কেউ দিতে পারছে না। উচ্চ শির মোদি বৎসরান্তে আরও ঝুঁকে পড়লে আগামী ফেব্রুয়ারিতে দিল্লি ও নভেম্বরে বিহারের ভোট তঁাকে সোজা করতে পারবে কি? সন্দেহ প্রবল। কারণ, মুখ্যমন্ত্রী থাকা ইস্তক বা প্রধানমন্ত্রিত্বের দশটা বছর তঁাকে কাউকে বাবা-বাছা করতে হয়নি। কারও মন জুগিয়ে চলতে হয়নি। সরকার টিকিয়ে রাখার আতঙ্কে দিবারাত্র তটস্থ থাকতে হয়নি। ‘কোয়ালিশন পলিটিক্স’ যে কী বিষম বস্তু, তা তঁার জানা নেই। এই বয়সে এসে আড় ভাঙানোও অসম্ভব। তিন মাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ তিনি রাখছেন।
উলটোদিকে ‘ইন্ডিয়া’ জোটের হাবভাব বোঝাচ্ছে তারা রক্তের স্বাদ পেয়ে গিয়েছে। লক্ষ করছি, ‘ইন্ডিয়া’-কে অটুট রাখতে রাহুলের আকুতি কী প্রবল! আকুতি আছে বলেই হরিয়ানার রাজ্য নেতাদের কাছে অপ্রিয় হওয়ার ঝুঁকি নিয়েও রাহুল জোটধর্ম পালনের মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। আম আদমি পার্টি (আপ) ও সমাজবাদী পার্টিকে (এসপি)- কয়েকটি আসন ছাড়ার প্রস্তাব তঁারই ছিল। তা বাস্তবায়িত হবে কি না অন্য কথা। কারণ, প্রদেশ কংগ্রেস নেতারা, বিশেষ করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও কংগ্রেসের স্ট্রংম্যান ভূপিন্দর সিং হুডা একেবারেই জোট চান না। তঁাদের মতে, আপ-কে দু-চারটে আসন যা-ই ছাড়া হোক তা জলে যাওয়ার সমান। হয়তো তঁারা ভুল বলছেন না। কারণ, হরিয়ানায় আপ-এর শক্তি ততটাই, বিশ্ব ফুটবলে ভারতের শক্তি যতখানি। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাহুল আপ ও এসপি-কে সঙ্গে রাখতে চাইছিলেন একটাই কারণে। দেশকে এই বার্তা দিতে যে, জোটবদ্ধতাই ভারতকে শক্তিশালী করতে পারে। জোটবদ্ধ ভারতই উন্নয়নের সোপানে চড়তে পারবে। সেই উন্নয়ন যা কিনা প্রকৃত অর্থে ‘ইনক্লুসিভ’। দেশের বহুত্ববাদী চরিত্রও প্রতিফলিত এই জোটবদ্ধতার মধ্যেই।
আরও একটা যুক্তি আছে। অতীতে দেখা গিয়েছে, কেন্দ্রীয় স্তরে বিভিন্ন দল জোটবদ্ধ হয়েছে ভোটে জেতা কিংবা ভোটের পর সরকার গড়ার তাগিদে। সেই জোটে আদর্শ বা নীতি কখনও প্রাধান্য পায়নি। ক্ষুদ্র দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থই বড় হয়ে দেখা দিত। গত দশ বছর ধরে নরেন্দ্র মোদিও তাই সেই ধরনের বিরোধী জোটকে অনৈতিক বলে উপহাস করেছেন। রাহুল চাইছেন, ওই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে ‘ইন্ডিয়া’ জোটকে অন্যভাবে গড়ে তুলতে যা বিজেপি ও সংঘ পরিবারের উগ্র-হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির বিচারধারার লড়াইকে ক্ষুরধার করে তুলবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রাহুল এই রাজনীতির কথাই শোনাচ্ছেন। এ এক পরিণতমনস্ক ভিন্ন রাজনীতি। রাহুল এই রাজনৈতিক সংস্কৃতিই লালন করতে চান।
পারবেন কি না তা বোঝা যাবে এই বছরের শেষেই। হরিয়ানা, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খণ্ড ও উত্তরপ্রদেশের দশ বিধানসভার উপ-নির্বাচন নরেন্দ্র মোদিকে আরও হেঁটমুণ্ড করে দিলে কে বলতে পারে আসছে বছর বিহারের ভোট তঁার কফিনের শেষ পেরেক হয়ে উঠবে কি না!
(মতামত ব্যক্তিগত)