কুণাল ঘোষ: সময়টা সম্ভবত ১৯৯৩, আমি তখন ‘আজকাল’-এ। প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির ফোন, পরদিন সকালে একটি কর্মসূচি। কভার করতে হবে, তার চেয়েও বড় কথা, নিজে গিয়ে দেখে লিখতে হবে। কী কর্মসূচি? রাজারহাটে সিপিএম সরকার জমিদখল করছে। তার প্রতিবাদে কৃষক, জমির মালিক, বাসিন্দা, শ্রমজীবীদের নিয়ে পদযাত্রা। প্রিয়দার উদ্যোগে। নেতৃত্বে ডঃ মনমোহন সিং, প্রিয়দার আমন্ত্রণে আসছেন।
মনমোহন সিং! তখন নরসিংহ রাও সরকারের অর্থমন্ত্রী, উদারনীতির আবাহন শুরু হয়েছে, যুগপৎ প্রশংসা ও তীব্র বিতর্ক। ডঃ সিং খবরে, কিন্তু তিনি কোনওমতেই রাজনীতির তথাকথিত গ্ল্যামারবয় বা পাওয়ার হাউস নন। রাজনৈতিক কর্মসূচিতে তাঁকে প্রায় দেখাই যায় না। সেই মনমোহন সিং দিল্লি ছেড়ে রাজারহাটে কংগ্রেসের মিছিলে হাঁটবেন!
প্রিয়দার কীর্তি। হাঁটলেন, মৃদু স্বরে সংক্ষিপ্ততম সংলাপে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিলেন। মিছিলে যতবার প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি জিন্দাবাদ স্লোগান উঠল, তার একভাগও মনমোহনের নামে উঠল না। কিন্তু প্রিয়দা তাঁকে যারপরনাই সম্মান দিলেন।
আলাদা করে জিজ্ঞেস করেছিলাম প্রিয়দাকে। দিল্লির এত ওজনদার নেতা থাকতে হঠাৎ রাজনীতিতে নবাগত মনমোহন সিংকে আনলেন কেন? প্রিয়দার সেই জবাব আমি আগেও লিখেছি, আবার লিখছি। প্রিয়দা বলেছিলেন, “লিখে রেখে দে, মানুষটা একদিন দেশ চালাবেন, প্রধানমন্ত্রী হবেন।” অর্থাৎ দূরদর্শী প্রিয়বাবু আগাম হিসাব কষে সুসম্পর্ক বাড়াচ্ছেন। নির্ভুল হিসাব। এর দশ বছর পর, যখন মনমোহন সত্যিই প্রধানমন্ত্রী, দিল্লিতে রাতের আড্ডায় প্রিয়দাকে সেই রাজারহাটের কথা তুলে জিজ্ঞেস করেছিলাম, অনুমান করেছিলেন কী করে? প্রিয়দার সিরিয়াস উত্তর ছিল, “মন বলছিল। ডঃ সিং অর্থনীতি দিয়ে দেশের হাল ধরার ক্ষমতা রাখেন। পণ্ডিত মানুষ। রাজনীতিতে অজাতশত্রু। মার্কিন লবি ওঁকে চাইবে। আর সব চেয়ে বড় কথা, আগামী কোনও সময়ে যদি কংগ্রেসকে সরকার গড়তে হয়, তখন বিদেশিনি ইস্যুতে ম্যাডামকে সরে থাকতে হলে উনি মনমোহনজিকেই চাইবেন। কোনও পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদকে গান্ধী পরিবার প্রধানমন্ত্রী পদে চাইবে না। দেখ, সেটাই হল।”
প্রিয়দার অঙ্ক মিলে গিয়েছিল। ২০০৪-এ যখন সোনিয়াজি প্রধানমন্ত্রিত্ব নিলেন না, প্রণববাবুই হবেন বলে সর্বত্র খবর, তখন ১০ নম্বর জনপথের নির্বাচিত নাম এসেছিল ডঃ মনমোহন সিং। প্রণববাবু সেই রাতে মানসিকভাবে আহত ছিলেন, অস্থির পায়চারির সাক্ষী ছিল তাঁর ১৩ নম্বর তালকাটোরা রোডের বাসভবন। একটা সময় প্রণববাবু ছিলেন দেশের অর্থমন্ত্রী এবং নাম্বার টু। তাঁর অধীনে চাকরি করেছেন অর্থনীতিবিদ মনমোহন। প্রণববাবুকে বলতেন ‘স্যর’। কালের নিয়মে মনমোহন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর অধীনে মন্ত্রী এবং নাম্বার টু প্রণববাবু। তবে প্রোটোকলে যাই থাক, প্রণববাবুকে ‘স্যর’ বলতে দেননি মনমোহন। মনেপ্রাণে মানতেন প্রণববাবুর প্রাপ্য চেয়ার ‘অ্যাক্সিডেন্টালি’ পেয়েছেন তিনি। দুজনের সম্পর্ক ছিল ভালো। প্রণববাবু প্রধানমন্ত্রীকে ‘ডঃ সিং’ বলে সম্বোধন করতেন। উলটে মনমোহন বলতেন, ‘স্যর’, প্রণববাবু বাধা দিলে ক্বচিৎ কখনও ‘প্রণবজি’। আবার, ২০১২-তে আরেক নাটকীয় মোড়। মনমোহন মন্ত্রিসভার মন্ত্রী বা নাম্বার টু থেকে প্রণববাবু হয়ে গেলেন রাষ্ট্রপতি। তখন মনমোহনের ‘স্যর’ সম্বোধনে বাধা থাকল না।
আমার সাংবাদিকতা মূলত কলকাতা, বাংলায়। কিন্তু ১৯৯৬ থেকে বারবার, কয়েকশ’ বার দিল্লিতে কাজ করেছি। ‘সংবাদ প্রতিদিন’, ‘আজকাল’-এর দিল্লি অফিসে। আমার মতে মনমোহন সিং বিরলের মধ্যে বিরলতম রাজনীতিবিদ। বা, আদৌ কোনও রাজনীতিবিদ নন, তিনি অর্থনীতির যুগপুরুষের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ারে বসা এক দূরদর্শী কান্ডারি। উদার অর্থনীতির দরজা খুলে বিশ্বের দরবারে মাথা তোলা থেকে শুরু করে কর্মসংস্থান বাড়াতে একশো দিনের কাজ, বা তথ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকার, খাদ্য সুরক্ষা বা ভারত-মার্কিন পরমাণু চুক্তির শুরুয়াত, ডঃ সিং এক মজবুত কাঠামো তৈরি করার কাজ করেছেন। পণ্ডিত, বিনয়ী, প্রচারবিমুখ, মিত ও মৃদুভাষী ডঃ সিং নিজের মার্কেটিং করতে পারেননি। জননেতা হওয়ারও চেষ্টা করেননি। ফলে বিরোধীদের আক্রমণ, এমনকী, কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ চাপেও ক্ষতবিক্ষত হয়েছেন বারবার।
কিন্তু সময়ে সময়ে তিনি যে জেদি এবং সেই জেদটা করেন জেতার জন্য, পরমাণু চুক্তিপর্বে সেটা প্রমাণিত। বামেরা সমর্থন তুলে নিলেও, অন্তর্ঘাতে কংগ্রেসের একাংশ থাকলেও ডঃ সিং সব চক্রান্ত চুরমার করে সরকার রাখতে সমর্থ হন; উলটে ২০০৯ সালে দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে সরকার গঠন করেন। অন্যদিকে বামেরা লুপ্তপ্রায় প্রবণতায় পা বাড়ায়। জাতীয় রাজনীতিতে, এবং বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে।
একটা বিতর্ক থাকবেই, ২০০৪-এ প্রণববাবুকে কেটে ‘হাতের পুতুল’ মডেলে কংগ্রেসের শীর্ষতম মহল সামনে এনেছিলেন মনমোহনের নাম। সেই কৌশলটা উতরে গিয়েছিল। আবার ২০১৪-তে রাহুল গান্ধীকে প্রোজেক্ট করতে গিয়ে এই মনমোহনকেই যেভাবে বিড়ম্বনায় ফেলা, অপমান করা শুরু হল কংগ্রেস থেকেই, ফল হল আত্মঘাতী। কংগ্রেস ডুবল। মোদির নেতৃত্বে বিজেপি এসে গেল। মনমোহন নেহাত অতি ভদ্রলোক, তাই গান্ধী পরিবার তাঁর তরফ থেকে পালটা কোনও উপহার পায়নি। এ বিষয়ে ডঃ সিংয়ের ঘনিষ্ঠ সঞ্জয় বারুর বইটি, বা ‘দ্য অ্যাক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’ ছবিটি দেখা যেতে পারে।
যাই হোক, আমি যেদিন রাজ্যসভার সাংসদ হিসেবে শপথ নিই, সেদিন প্রধানমন্ত্রী ডঃ সিং সভায় ছিলেন। শপথের ছবির ফ্রেমে তাঁর উপস্থিতি গর্বের। ছ’বছর পর আমার অবসরের সময়ে মোদিজি প্রধানমন্ত্রী, ডঃ সিং বিরোধী আসনে। অবসরের দিন ছয়-সাত আগে ওঁকে বললাম, “আমার শপথের দিন আপনার সঙ্গে ছবি আছে। অবসরের দিনও একটি ছবি তুলতে চাই, যদি অনুমতি দেন।” তিনি হাসলেন, কিছু কথা বললেন এবং তারিখটা জেনে নিলেন। এর পর সেই তারিখের দুদিন আগে আমি সভায় বসে, রাজ্যসভার এক উর্দি পরা কর্মী এসে বললেন, ডঃ সিং আমাকে ডাকছেন। তাকিয়ে দেখি হাত নেড়ে যেতে বলছেন। গেলাম। বললেন, “তোমার অবসর তো দুদিন পর। আমি হয়তো কাল থেকে দু-তিনদিন আসব না। যদি আজ তোমার ছবিটা তুলে দিই, অসুবিধা হবে?” আমি বিস্মিত, অভিভূত। এই হল মানুষের আসল উচ্চতা। এরপর উনি শুধু ছবিটা তোলার জন্য সভাকক্ষ থেকে বেরোলেন। সামনের অলিন্দে ওঁর পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। কেউ তুলে দিলেন। ডঃ সিং বললেন, “খুশি?” প্রণাম করে বললাম, “হ্যাঁ, স্যর।” মনমোহন সিং আস্তে আস্তে আবার সভাকক্ষে ঢুকে গেলেন।