বাঙালি রাম-ভক্ত ছিল না, এমন ভাবা ভুল। শ্রীরামকৃষ্ণর বাবা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের কুলদেবতা ছিলেন রঘুবীর। কামারপুকুরের সে মন্দিরে এখনও নিত্য পূজা হয়। হাওড়ায় বাড়ি বলে রামরাজাতলার শোভাযাত্রা শৈশব থেকে দেখছি। কিন্তু তিন-চারদিন ধরে এমন সশস্ত্র মিছিল দেখিনি। জাতিসত্তা-ভিত্তিক গণতন্ত্র কায়েমের চেষ্টা করছে বিজেপি। যার সম্বল ঘৃণাভাষণ ও আক্রোশ। লিখলেন জয়ন্ত ঘোষাল
সাতসকালে নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন। প্রাচীন বন্ধু নীলাঞ্জন। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে এখন বেশ কেউকেটা। কী হচ্ছে রে কলকাতায়? ওর গলায় উদ্বেগ। এই বাংলাকে তো আমরা ছোটবেলায় দেখিনি ভায়া। রামনবমীর (Ram Navami) দিন সাম্প্রদায়িক হিংসা? ভেরি ফানি! সামথিং রটেন ইন বেঙ্গল?
বললাম, ওহে নীলু, নিউ ইয়র্কে হাডসন নদী দেখতে দেখতে তোমার চোখে শুধু বাংলাকেই দেখা যাচ্ছে? তোমার দূরবিনটিকে বিহার, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, এমনকী, রাজধানী দিল্লির দিকেও ঘোরাও। সমগ্র দেশ জুড়েই তো রামের জন্মদিনে হিন্দু-মুসলমান সংঘাতের আবহ।
[আরও পড়ুন: ব্যবহৃত হয় সেলফোন থেকে এয়ারক্র্যাফট নির্মাণে, এবার দেশেই মিলল ১৫ ধরনের দুর্লভ খনিজের সন্ধান]
আমরা যখন সাংবাদিকতা শুরু করেছিলাম– তখন আমাদের বলা হত– ‘দাঙ্গা’ শব্দটাই ব্যবহার করা যাবে না। খবরের কাগজে ‘হিন্দু-মুসলমান সংঘর্ষ’-ও লেখা যেত না। আমরা বলতাম, ‘দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে সংঘর্ষ’।
বিশেষত, আমরা বাঙালি জাতি কলকাতা ম্যাসাকারের ভয়াবহ স্মৃতিতে দগ্ধ, পীড়িত আজ-ও। হয়তো সেজন্য আমরা ইংরেজি, হিন্দি সংবাদমাধ্যমের চেয়েও বেশি সংবেদনশীল ছিলাম। আর, এখন তো সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ, সব বাধা-নিষেধ অবলুপ্ত।
কিন্তু মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরে তো শুনলাম, মন্দির ভেঙে এগারোজন ভক্ত মারা গিয়েছে। মন্দিরের মধ্যে একটা কুয়োর মধ্যে তারা পড়ে যায়। সে তো সাম্প্রদায়িক সংঘাতে মৃতু্য নয়। মধ্যপ্রদেশে তো বিজেপি ক্ষমতায়। আর মহারাষ্ট্র-বিহার, পশ্চিমবঙ্গ-দিল্লি এই চার রাজ্যেই তো অ-বিজেপি শাসক দল। নীলুর অকাট্য যুক্তি– ল অ্যান্ড অর্ডার স্টেট সাবজেক্ট।
[আরও পড়ুন: প্রথমবার বিদেশে সামরিক মহড়ায়, ফ্রান্সের ‘ওরিয়নে’ অংশ নেবে ভারতের রাফাল]
বললাম, নীলু আমি মানছি। পশ্চিমবঙ্গে খোদ মুখ্যমন্ত্রীই পুলিশ প্রশাসনের একাংশকে ভর্ৎসনা করেছেন।
আমার নিজের জন্ম হাওড়ার শিবপুরে। রামরাজাতলার শোভাযাত্রা সেই কোন শৈশব থেকে দেখছি! একদিনের ব্যাপার ছিল। কিন্তু তিন-চারদিন ধরে মিছিল? তা-ও আবার সশস্ত্র? এসব আমার ঠাকুরদাও দেখেনি! নীলু, এটা হল ‘মডার্ন ইন্ডিয়া’। কখন ভারত এমন হয়ে গেল, জা(Z)নতি পারোনি বস।
বাঙালি রাম-ভক্ত ছিল না, এমন ভাবা ভুল। তবে এভাবে হনুমান জয়ন্তী পালন বাঙালিকে করতে দেখিনি আগে। নরেন্দ্রপুরে রামকৃষ্ণ মিশনে নিয়মিত শ্রীরাম নামসংকীর্তন হত। ‘শুদ্ধ ব্রহ্মপরাৎপর-রাম, কালাত্মক পরমেশ্বর-রাম’। অর্থাৎ, হে রাম, তুমি শুদ্ধ ব্রহ্মস্বরূপ এবং শ্রেষ্ঠ হইতেও শ্রেষ্ঠ। তুমি কালরূপী পরমেশ্বর। ভুললে চলবে না, শ্রীরামকৃষ্ণর বাবা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায়ের কুলদেবতা ছিলেন রঘুবীর। রঘুবীরের পৃথক মন্দিরটিতে কামারপুকুরে আজও নিত্য পূজা হয়।
একবার বলরাম বসুর বাগবাজারের বাড়িতে শ্রীরামকৃষ্ণ গাইছেন কীভাবে লব-কুশ হনুমানকে ধরে সীতার কাছে এনেছে। স্বামী তুরীয়ানন্দ সিঁড়ি দিয়ে উঠছেন, আর শুনছেন ঠাকুর কঁাদতে কঁাদতে গাইছেন, হনুমান বলছে আমি নিজেই ধরা দিয়েছি। লব-কুশ তোরা শিশু, তাই ভাবছিস তোদের এত শক্তি যে এত বড় একটা হনুমানকে ধরে এনেছিস! এদিকে স্বামী তুরীয়ানন্দ ভাবছেন, ঠাকুর আমার উদ্দেশেই গাইছেন কি? আমার অহংকার চূর্ণ করার জন্য। আমরা কি লব-কুশের মতো শিশু? হায়, আমরা ভাবছি এ আমাদের সাধনার শক্তি!
লম্বা গল্পটি নীলুকে শোনালাম। নীলু ঘোষিত নাস্তিক। ঘোষিত কমিউনিস্ট। আমেরিকায় সফল এনআরআই। আমি বলি, তুই পুঁজিবাদী-মার্কসবাদী। বলি, তোদের ভারতীয় ধর্মের প্রতি অবজ্ঞার জন্যই আজ বিজেপির এই বাড়বাড়ন্ত। বলা বাহুল্য, এত কিছু বলতে পারা যায় বন্ধুত্বের ঘেরাটোপেই।
যা হোক। কাজের কথায় ফিরি। পশ্চিমবঙ্গে শিবপুরের ঘটনাকে বিচ্ছিন্নভাবে দেখা উচিত নয়। ২০২৪ ভোট আসছে, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি চাইছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘বেগম’ আখ্যা দিয়ে শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ হিন্দু-ভোটের একচেটিয়া মালিকানা দখল করতে। প্রমাণ করতে, হিন্দুত্বর তারা-ই খুচরো ও পাইকারি বিক্রেতা। তাদের কোনও শাখা নেই। আর মমতা চাইছেন, শতকরা ৩০ ভাগ মুসলিম তো বটেই– এমনকী, বাকি হিন্দু ভোটের নানা স্তর, নানা বর্গ, নানা বর্ণের মানুষের মন জয় করতে। তার জন্য তাঁর প্রধান অস্ত্র ‘ওয়েলফেয়ারইজম’। জনকল্যাণবোধ ও বাঙালি মনন। কিন্তু সেই সংকীর্ণ রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে এসে দেশের চালচিত্রটা দেখা প্রয়োজন। গত দশ বছরে ভারতে তিলতিল করে সংখ্যাগরিষ্ঠের জাতীয়তাবাদ তৈরি হচ্ছে।
সংঘ পরিবার রাষ্ট্র সরকারের সাহায্য নিয়ে এই ‘ইথোস’-কে সমাজজীবনের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে দিচ্ছে। ক্রিস্টোফ জাফরেলটের মতো চিন্তাবিদ যাকে বলছেন, হিন্দু জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে এক ধরনের জাতিসত্তা-ভিত্তিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া (‘এথনিক ডেমোক্র্যাসি’)। ‘ডিফ্যাক্টো’ হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে এক কর্তৃত্ববাদী, নজরদারি-সর্বস্ব কঠোর রাষ্ট্র তৈরি হবে। নির্বাচিত একনায়কতন্ত্রে মুসলিম সমাজকে ‘ভোটব্যাঙ্ক’ হিসাবে ব্যবহার করা যাবে না।
মুসলিম সমাজে নিরাপত্তার অভাব হবে। সিলেবাস থেকে মুঘল যুগ বাদ যাবে। রামনবমী, হনুমান জয়ন্তীতে ধর্মের সমন্বয় নয়, হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ আধিপত্যকামিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। আর, এই সংস্কৃতিকে গলিতে-গলিতে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য প্রয়োজন ঘৃণাভরা বক্তৃতা (Hate speech)।
এই দুঃসময়ে নিকষ কালো মেঘের গায়ে রুপোলি রেখা এঁকে দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। বিচারপতি কে. এম. জোসেফ ও বি. ভি. নাগারত্নর বেঞ্চ ‘ফ্রিঞ্জ এলিমেন্ট’-দের ঘৃণা-ভাষণ ঠেকাতে না পারার জন্য সরকারকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করেছে। আসলে যতক্ষণ রাজনীতির সঙ্গে ধর্ম জড়িয়ে থাকবে, ততদিন ঘৃণার ভাষণ থাকবে, আর ততদিন এই সাম্প্রদায়িক সংঘাত বহাল থাকবে। বাল ঠাকরে একদা বলেছিলেন, মুসলিম ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতি বন্ধ করার জন্য ভারতীয় মুসলিমদের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হোক। আমি সাম্প্রদায়িক তোষণ ও ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির ঘোরতর বিরোধী। তোষণে যে মুসলিম সমাজের প্রকৃত উন্নয়ন এই দেশে হয়নি ‘সাচার কমিটি’-র রিপোর্ট তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। কিন্তু তা’ বলে এমন তুঙ্গ মুসলিম বিরোধিতা কেন?
এই বঙ্গদেশে মুসলমান জনসমাজের ইতিহাসটি কম দীর্ঘ নয়, কম ঐতিহ্যবাহী নয়। ফজলুল হক আর সুরাবর্দির ইতিহাসও আমরা ভুলিনি। এ-ও মনে আছে ১৯৩৭ সালে ব্রিটিশ যুগে ভারতের প্রাদেশিক নির্বাচনে ‘অল ইন্ডিয়া মুসলিম লিগ’ তুলনামূলকভাবে ভাল ফল করে। বাংলায় কংগ্রেস জিতলেও ১১৭-র মধ্যে ৩৯টি আসন ‘মুসলিম লিগ’ দখল করে। এই শিকড় ভুললে চলবে না। অধ্যাপক সুরঞ্জন দাসের গবেষণা থেকেও দেখা যায়, বঙ্গদেশে মুসলিম-বিচ্ছিন্নতার নেপথ্যে ‘এলিট হিন্দু’ উচ্চবর্ণের ক্ষমতার রাজনীতি ছিল। ১৯০৫-এর ‘বঙ্গভঙ্গ’র সময়ও এই মুসলিম-বিচ্ছিন্নতার শিকড়টি বুঝিয়েছেন ঐতিহাসিক সুমিত সরকার।
তাই রামনবমীতে দেশজুড়ে সমন্বয়ের সাধনা নয়, এক হিন্দু-হিন্দি ‘অখণ্ড ভারত’ গড়ার কুরুক্ষেত্র চলছে। পার্থক্য নিয়ে সমন্বয় হয় না, পার্থক্য মানেই সংঘাত। এ এক নতুন ভারত-নির্মাণ সাধনা।