সাহিত্যচর্চা, জ্ঞানার্জনে পারস্পরিক সহযোগিতা, নির্মল আনন্দ, খেলাধুলো ইত্যাদির জন্য জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ‘ভাই বোন সমিতি’ নামে ক্লাবের সূচনা হয়েছিল। এর উদ্যোক্তা কে? লিখছেন পূর্ণেন্দুবিকাশ সরকার।
উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলার সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জগতে যে তুমুল আলোড়ন উঠেছিল, পুরনো আদর্শ আর ধ্যানধারণাকে পিছনে ফেলে নবজাগরণের যে জোয়ার এসেছিল– তার উৎসকেন্দ্র ছিল জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ি। ১৮৩৩ সালে রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পরে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘আত্মীয়সভা’ এবং ‘ব্রাহ্মসমাজ’-এর ব্যাটন হাতে তুলে নিয়েছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। বলা যায়, তিনিই বাংলার সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির বিশিষ্ট স্থান-অধিকারের ভিত্তি স্থাপন করে গিয়েছেন। ১৮৪৩ সালে ব্রাহ্ম ধর্ম গ্রহণ করে দ্বারকানাথের সুযোগ্য পুত্র দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই ধারাকে সঞ্চারিত করেছিলেন তাঁর উত্তরাধিকারীদের মধ্যে। দেবেন্দ্রনাথের ছেলে-মেয়েরা, তাঁর বিশাল নাতি-নাতনি বাহিনী, গুণেন্দ্রনাথের বংশধররা, এমনকী, গৃহবধূরাও সম্মিলিতভাবে যে অভূতপূর্ব সাংস্কৃতিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন, তার তুলনা বিশ্ব ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের নিরন্তর লেখালিখি, আলোচনা, প্রবন্ধ পাঠ, গান-রচনা, সংগীতচর্চা, অভিনয় ইত্যাদি কর্মকাণ্ডে অনুঘটকের কাজ করেছিল তাঁদের প্রতিষ্ঠিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর নানা ধরনের মিলনসভা। ‘বিদ্বজ্জন সমাবেশ সভা’, ‘সখি সমিতি’, ‘খামখেয়ালি সভা’, ‘জোড়াসাঁকো নাট্যশালা’, ‘সারস্বত সমাজ’ ইত্যাদি সমিতিগুলি গড়ে উঠেছিল এক-একটি বিশেষ প্রয়োজনে। এসব সংস্থার উদ্দেশ্য আর কাজকর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল থাকলেও ‘ভাই বোন সমিতি’ সম্বন্ধে যথেষ্ট তথ্য আমাদের জানা নেই।
১২৯৩ বঙ্গাব্দে, রবীন্দ্রনাথের বয়স যখন ২৬ বছর, নীতেন্দ্র, সুরেন্দ্র, ইন্দিরা, কৃতিন্দ্র, বলেন্দ্র, জ্যোৎস্না, সরলা, প্রতিভা, সত্যপ্রসাদ, হিরণ্ময়ী-সহ একগুচ্ছ বালক-বালিকায় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি জমজমাট হয়ে রয়েছে। কিছুদিন আগেই জ্ঞানদানন্দিনীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে পারিবারিক পত্রিকা ‘বালক’। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘বালকদের পাঠ্য একটি সচিত্র কাগজ বাহির করিবার জন্য মেজবউঠাকুরানীর বিশেষ আগ্রহ জন্মিয়াছিল। তাঁহার ইচ্ছা ছিল সুধীন্দ্র, বলেন্দ্র প্রভৃতি আমাদের বাড়ির বালকগণ এই কাগজে আপন আপন রচনা প্রকাশ করে। কিন্তু শুধুমাত্র তাহাদের লেখায় কাগজ চলিতে লপারে না জানিয়া তিনি সম্পাদক
হইয়া আমাকেও রচনার ভার গ্রহণ করিতে বলিলেন।’ বস্তুত ‘বালক’ পত্রিকার সম্পাদনা ও লেখালিখির প্রায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব রবীন্দ্রনাথকেই সামলাতে হয়েছিল।
সাহিত্যচর্চা, জ্ঞানার্জনে পারস্পরিক সহযোগিতা, নির্মল আনন্দ, খেলাধুলো ইত্যাদির জন্য ওই বছর জোড়াসাঁকোয় ‘ভাই বোন সমিতি’ নামে একটা ক্লাবের সূচনা হয়েছিল। ক্লাবের উদ্যোক্তা কে ছিলেন, তা সঠিক জানা না-গেলেও জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা একটা চিঠি থেকে আমরা এ-বিষয়ে কিছুটা ধারণা করতে পারি। তিনি সেই সময়ে সাজাদপুরে জমিদারির কাজে ব্যস্ত। লিখেছেন, “তোমরা যে ‘ভাই-বোন-সমিতি’ স্থাপন করেছ, তা-থেকে নানা কথা আমার মনে আসছে। কৈ তোমাদের ঐ বয়সে, ‘ভাই-বোন-সমিতি’-র মত কোনও উচ্চতর কল্পনা তো আমাদের মাথায় আসেনি। সব ভাই-বোন মিলে জ্ঞানের চর্চা করা, বড় ভাই ছোট ভাইয়ের শিক্ষার ভার স্বেচ্ছাক্রমে গ্রহণ করা, পরস্পরের মধ্যে সদ্ভাব বর্ধন করবার চেষ্টা করা, জ্ঞানচর্চা ও কর্তব্য-সাধনের উচ্চতর আনন্দ এবং বিশুদ্ধ সঙ্গীতের বিশুদ্ধ আমোদ বিশুদ্ধভাবে উপভোগ করা, এ প্রকার ভাব, সেকালে আমাদের মনে তো উদয় হয়নি।”
আসলে দাদা হেমেন্দ্রনাথকে লেখা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ এই চিঠির মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে এক ধরনের বিস্ময় আর আন্তরিক মুগ্ধতার। সাজাদপুর থেকে লেখা চিঠিটির তারিখ, বাংলা ১২৯৩ বঙ্গাব্দের ২৯ জ্যৈষ্ঠ। তার কিছুদিন আগে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ কলকাতা থেকে সাজাদপরে এসেছেন। অর্থাৎ, তাঁর আসার পরেই ‘ভাই বোন সমিতি’-র প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। আমরা জানি, জোড়াসাঁকোর বাড়িতে হেমেন্দ্রনাথ স্বনিযুক্ত হয়ে সোমেন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, জ্ঞানদানন্দিনী আর অন্যান্য ছোট সদস্যের শিক্ষার দায়িত্ব নিজের কঁাধে তুলে নিয়েছিলেন। মনে হয়, আলোচ্য ‘ভাই বোন সমিতি’ সম্ভবত হেমেন্দ্রনাথের আদর্শ আর মানসিকতাতেই গড়ে উঠেছিল। এই সমিতির অপেক্ষাকৃত বড় সদস্যরা ছোটদের বিজ্ঞান, সাহিত্য, সংগীত, ব্যায়াম ইত্যাদি চর্চায় উৎসাহ দিতে, পারস্পরিক সহযোগিতায় একে-অপরের চারিত্রিক ও মানসিক বিকাশ আর জ্ঞানবৃদ্ধিতে অকুণ্ঠভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন। অর্থাৎ এই ‘ভাই বোন সমিতি’-কে ঘিরে ঠাকুর পরিবারের মধ্যেই একটি ‘অভ্যন্তরীণ ও সর্বাঙ্গীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান’ গড়ে উঠেছিল।
১২৯৫ বঙ্গাব্দে মাঘোৎসবের সময় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ‘ভাই বোন সমিতি’-র এক সভায় আচার্যর ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল। সদস্যদের প্রয়োজনীয় উপদেশ-ভাষণের পরে এই সমিতি সম্বন্ধে তিনি বলেছিলেন, ‘কারো বা অন্তঃকরণে মনুষ্যত্বের পাতা গজিয়েচে বা গজাচ্চে–বর্তমান সমিতির উদ্যোগী শ্রীমান বাবাজিদিগের অন্তঃকরণে; কে তাঁরা? না যেমন হিতু নীতু ক্ষিতু কৃতু, সুরেন, বিবি, বলু, সুধী, জ্যোৎস্না, সরলা– কি আর বলব সর্বগুণে গুণাম্বুধি।’ অর্থাৎ, তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র-ভ্রাতুষ্পুত্রী-ভাগিনেয় আর অন্যান্যদের নিয়ে ‘ভাই বোন সমিতি’-র আয়তন বাস্তবিকই ছিল এক বিশাল মহীরুহর মতো।বড়দের দেওয়া চাঁদার টাকাতেই সমিতির পরিচালনা আর নানা খাতে খরচ চালানো হত।
চাঁদার হার ছিল সম্ভবত মাসিক এক টাকা। রবীন্দ্রনাথ তখন সাহিত্যগগনে উদীয়মান সূর্য। তাঁর প্রভাবেই ঠাকুরবাড়ির সাহিত্য প্রাঙ্গণ তখন আলোকিত। তিনিও সম্ভবত এই সমিতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তাঁর এই প্রিয় ভাইটির সম্পর্কে লিখেছেন, “ওদিকে আবার আর একটি ‘নব ভানু’ আমাদের পারিবারিক সাহিত্য-আকাশে উদয় হয়েছিল– সেই ভানু এখন পূর্ণ মহিমায় বিরাজ করছে এবং তার প্রদীপ্ত কিরণ এখন আমাদের পারিবারিক গগনকে অতিক্রম করে সমস্ত বঙ্গভূমিকে আলোকিত করচে।”
জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ‘পারিবারিক স্মৃতি পুস্তক’ নামে একটা অদ্ভুত খাতা ছিল, যা ঠাকুর পরিবারের ইতিহাসের একটি মূল্যবান উপাদান। খাতাটি রাখা থাকত ঘরে ঢোকার মুখে, দরজার পাশে। বাড়ির যে কোনও সদস্য যে কোনও বিষয়ে এতে মন্তব্য লিখে রাখতে পারতেন। রবীন্দ্রনাথের ভ্রাতুষ্পুত্র বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘ভাই বোন সমিতি প্রবন্ধপাঠ’ নামে একটি প্রবন্ধ এই খাতায় লিখে রেখেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘অলস বাবুমাত্রেরই জুড়ি গাড়িতে চেপে হাওয়া খাবার ইচ্ছে হয়। সাহিত্যপ্রিয় অলস বাবুরাও সেইরুপ কোন এক সমিতিরূপ জুড়ি গাড়িতে চেপে সাহিত্যক্ষেত্রে বিচরণ করতে ইচ্ছা করেন। আমরাও আর বচ্ছরে বেড়াবার জন্য এইরকম একটী গাড়ী করেছিলুম। সেটা মধ্যে ভেঙে যাওয়াতে আবার সারিয়ে ফেলা গেছে। আমরা হচ্ছি বাবু আমরা বেড়াতে যাব।... সাহিত্য ও সঙ্গীত জুড়ি ঘোঁড়া। স্থায়ী সভাপতি মহাশয়কে বাবুরা চাল ঠিক করেছেন। ঘোড়ার পিছনে যে দুজন্ করে সহিস থাকে তাও এর আছে, সেসব বিষয়ে কোন ত্রুটি নাই তবে যে বাবুরা দানরুপ দানা দেন সেটা একবার দেখা ভাল যে সহিস ঘোড়াকে খাওয়ায় কি না।’
সূচনার সময় ভাবা হয়েছিল, নানা ধরনের কাজে অংশগ্রহণ করে ‘ভাই বোন সমিতি’-র সদস্যরা নিজেদের প্রতিভাকে সবার সামনে মেলে ধরবেন। কিন্তু কার্যত দেখা গেল, তঁাদের কর্মধারা নিছক সাহিত্যচর্চার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। তারই তির্যক মন্তব্য প্রকাশ পেয়েছে বলেন্দ্রনাথের উপরোক্ত প্রবন্ধে। বলেন্দ্রনাথ ছাড়াও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের লেখা পূর্বোক্ত চিঠিটির একটি কপি এই পারিবারিক খাতায়
টুকে রাখা হয়েছিল। প্রসঙ্গত, এই চিঠিটাই ‘ভুক্তভোগীর পত্র’ শিরোনামে ‘ভারতী’ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২০ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল।
‘ভাই বোন সমিতি’-র কার্যকালের মেয়াদ জানা না-গেলেও ১২৯৭ সালের ১৪ বৈশাখ পারিবারিক খাতায় বলেন্দ্রনাথের লেখা থেকে অনুমান করা যায় যে, সমিতিটি তখনও সজীব ছিল। এরপর ছোট-ছোট সদস্য বড় হয়ে ধীরে-ধীরে স্কুল-কলেজ আর অন্যান্য ধরনের সৃষ্টিমূলক কাজে জড়িয়ে পড়লে সমিতি একদিন ঠাকুরবাড়ির জনারণ্যে হারিয়ে গেল।
আরও একটি বহু বছর পরে ঠাকুরবংশে আরও একটি ভাই বোন ক্লাবের খবর জানিয়েছেন চিত্রা দেব তাঁর ‘ঠাকুরবাড়ির অন্দরমহল’ বইটিতে। পাথুরিয়াঘাটার ঠাকুর পরিবারের মেয়েরা ‘ভাই বোন সংঘ’ নামে
একটি সংঘ বা ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। জানা যায়, এটির উদ্যোক্তা ছিলেন গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কন্যা কুমুদিনীর নাতনি মালবীর মেয়ে চম্পার স্বামী নীলেন্দু হালদার। চম্পার কথায়, “আমাদের সবাই মিলে আমরা ছিলাম একুশ ভাইবোন, প্রায় সমবয়সি এবং বন্ধু। কাজেই ছেলেবেলায় মনেই হত না বাইরের সকলের সঙ্গে মেলামেশার অদৃশ্য গণ্ডি আছে না নেই। এর ওপর বাড়িতে রবিবার দেখে মাঝে মাঝে হত গানের জলসা, মা-কাকিমারাও যোগ দিতেন তাতে। ভাইবোনেরা নিজেরাই হতেন কুশীলব। এই পরিবারে নতুন করে স্থাপিত হয়েছিল ‘ভাই বোন-সংঘ’। এখানে ‘নতুন’ করে বলা হচ্ছে– কারণ, বলা বাহুল্য আর-একটির উল্লেখ পাওয়া যাবে জোড়াসঁাকোর ঠাকুরবাড়িতে, যেটির নাম ছিল ‘ভাই বোন সমিতি’।”
(মতামত নিজস্ব)
লেখক চিকিৎসক
pbsarkar@gmail.com