জীবিকার প্রয়োজন আর জীবনের আহ্বান অল্প বয়স থেকেই বোধহয় আলাদা করে বুঝতে পেরেছিলেন, শুনতে পেয়েছিলেন। আর, তাই জীবিকা যাই হোক, তার থেকে তিনি টিকে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, তার বেশি কখনওই গ্রহণ করেননি। গানকে বরং সঁপেছেন জীবন। লিখছেন অনুপ বন্দ্যোপাধ্যায়।

একজন সাধারণ শ্রমিক বা কৃষক প্রথাগত প্রশিক্ষণ ছাড়াই জীবনযুদ্ধে নেমে যায়। তার শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়, রক্ত ঝরে। তারপর ওই কাজের ধারাবাহিক তীব্রতাই তাকে প্রশিক্ষিত করে তোলে। প্রতুল মুখোপাধ্যায়ের গান-জীবনও যেন ঠিক এরকম। তাঁর কথায়– ‘আসলে
খেটে খাওয়া মানুষের মতো গানের ক্ষেত্রে আমি আদ্যোপান্ত খেটে গাওয়া মানুষ। আমার সব গানই খেটে তৈরি করা। আমি কান খাটাই, গলা খাটাই, মন খাটাই, বুদ্ধি খাটাই। এই শ্রমই আমার আনন্দ, আমার অবকাশ।’ আর, গানের প্রথাগত প্রশিক্ষণের কথাতে বলেছেন– ‘গান আমাদের কাছে এসেছে নদীর জলের মতো, হাওয়ার মতো, রোদের মতো, বৃষ্টির ধারার মতো, চাঁদের আলোর মতো, বড় কচুপাতায় টলমল করা জলের মতো, পাখির ডাকের মতো, ফেরিওয়ালার হাঁকের মতো। সারা প্রাণ জুড়েই যেন ছিল গান। ফুঁ দিলেই শাঁখের মতো বেজে উঠত।’
একদিকে প্রবল দক্ষতা, অন্যদিকে সহজ-সরল জীবনদর্শন। একদিকে ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া হেড অফিসের ‘স্ট্যাটিসটিকস অ্যান্ড লং রেঞ্জ প্ল্যানিং’ ডিপার্টমেন্টের চিফ ম্যানেজারের মোটা মাইনের চাকরি, অন্যদিকে সমাজ পরিবর্তনের ডাক– ‘লড়াই করো, লড়াই করো, লড়াই করো, লড়াই / যতদিন না বিজয়ী হও/ যদি একবার হারো বারবার লড়ো, বারবার লড়ো, বারবার/ যতদিন না বিজয়ী হও/ কিসের ভয়, হবেই জয়, দূর করে ফেলো যত সংশয়/ আবার তৈরি হও।’ দ্বিবিধ প্রবণতার মিশ্রণেই তিনি অনন্য।
এই গানটি ১৯৬৯ সালে লেখা। ‘হুনান অভ্যুত্থান’ নিয়ে মাও ৎসে-তুংয়ের প্রবন্ধের অনুপ্রেরণায় ওই সময়েই লেখেন– ‘চেয়ে দেখো আজ/ ভারতের গ্রামে গ্রামে মুক্তির সংগ্রামে/ লাখো লাখো কিষান আসছে/ ঝড় আসছে, ঝড় আসছে।’ মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা– ‘আমরা ধান কাটার গান গাই,/ আমরা লোহা পেটার গান গাই,/ আমরা গান গাই’-তে সুর দিয়েছিলেন সেই ১৯৫৪ সালে– ৭০ বছর আগে। তখন বয়স? তখন মাত্র ১২। আসলে, জীবিকার প্রয়োজন আর জীবনের আহ্বান এই বয়স থেকেই বোধহয় তিনি আলাদা করে বুঝতে পেরেছিলেন, শুনতে পেয়েছিলেন। আর, তাই জীবিকা যাই হোক, তার থেকে তিনি টিকে থাকার জন্য যেটুকু প্রয়োজন, তার বেশি কখনওই গ্রহণ করেননি।
চাইলেই যিনি একটা-দুটো গাড়ি অনায়াসেই রাখতে পারতেন, দামি পোশাক পরতে পারতেন, তারকাসুলভ আচরণ করতে পারতেন, কিন্তু তিনি অতি সাধারণভাবে জীবন কাটিয়ে দিলেন। মনে পড়ে যাচ্ছে, ১৯৯৪ সালে লেখা একটি গানের কথা যেখানে প্রতুলদা নিজেকেই বলছেন– ‘আমি কি গান গাবো যে ভেবে না পাই/ আমি কি গান গাই।’ তখন গান এসে ‘সামনে দাঁড়ায়/ বন্ধুর মতো তার দুহাত বাড়ায়।’ গান প্রতুলদাকে নিয়ে যেতে চায় শহরে, গ্রামে– যেখানে সাধারণ মানুষ দিন-রাত খাটছে, ঘাম ধরাচ্ছে আর প্রতুলদার গান প্রাণ দিয়ে শুনছে। ‘কি করে যাব, সে সময় কোথায়?/ সামনে পড়ে যত জরুরি কাজ/ আমার গান বলে তবে বিদায়/ আমাকে ফিরে যেতে হবেই আজ/ আমি দাঁড়িয়ে থাকি, গান এগিয়ে যায়।’ কত তীব্র যন্ত্রণার কথা কত সরলভাবে বলে যাওয়া!
এ-ই একই উদাহরণ দেওয়া যায় ২০১০ সসালের লেখা গান নিয়েও– যেখানে তিনি দেশভাগের যন্ত্রণাকে একেবারে নেহাতই কথোপকথনের মাধ্যমে প্রকাশ করছেন। লিখছেন– ‘দুই জনাই বাঙালি ছিলাম/ দেখো দেখি কান্ডখান/ তুমি এখন বাংলাদেশী/ আমারে কও ইন্ডিয়ান।’ শুধু গানই-বা কেন? প্রতুলদার ছড়া! সে-ও এক আশ্চর্য সরলতায় ভরা জীবনবোধের গভীর চিহ্ন। আমরা জানি, তর্ক বা বিতর্ক, তা সে যে নামেই ডাকি, এর মধ্যে একটা আধিপত্যবাদের ছোঁয়া থাকেই। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের মতামতের কোনও দুর্বলতা খুঁজে পাই না এবং তাই আমাদের মতামতটাকেই প্রতিষ্ঠা করতে উঠেপড়ে লেগে যাই। অন্যজনে সেটা মানবে কেন! চেঁচামেচি, ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ পর্যন্ত গড়িয়ে শেষ পর্যন্ত মুখ দেখাদেখি বন্ধ। অথচ আমরা সম্পর্ক নিয়ে গভীর সব কথা বলি– ‘লেট আস এগ্রি টু ডিসএগ্রি’ বলি– মতান্তর হোক কিন্তু মনান্তর যেন না হয় বলি। প্রতুলদা লিখলেন– ‘আড়ি নয়, ক্ষমা/ দঁাড়ি নয়, কমা।’ ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। অথবা ধরুন– ‘পাতে ইলিশ মাছের ঝোল/ আলোচনা– আমলাশোল।’
এখন চারিদিকে শুধুই ইলিশ মাছের ঝোল আর আমলাশোলের সংস্কৃতি। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সভাঘরই হোক অথবা মাচা, প্রত্যেক শিল্পীর বাজারদর জানা। হাততালিতে আসর ভরে যায়। সঙ্গে নাচ, লাফানো, আলোর কেরামতি, চিৎকার– সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান জমে ক্ষীর। আর, উল্টোদিকে অনেকে হাততালি দিতে থাকলে প্রতুলদা বলতেন– ‘অত হাততালির দরকার নেই। ১০-১৫ জন দিলেই হবে। আর হাত তুলে অত মাথা দোলাবারও কোনো দরকার নেই। আমার কথাগুলো তো মগজে নিতে হবে! নইলে আর গান করে কী হবে?’
গান গেয়েছেন রাস্তায়, মাঠে, ক্লাবঘরে, গাছতলায়, চণ্ডীমণ্ডপে, বাড়ির উঠোনে, ট্রেনে, বাসে, চায়ের দোকানে, কলকারখানার গেটে, বস্তিতে এমনকী ভাটিখানাতেও গান গেয়েছেন নিজের লেখা মদ্যপানবিরোধী গান। বস্তির খালি-গা বাচ্চাদের গান শুনিয়েছেন। কোনও শীতাতপনিয়ন্ত্রিত সভাকক্ষে টিকিট বিক্রি করে প্রতুলদার গান আমরা শুনিনি। টিকিটঘরের সামনে তাই লম্বা লাইনও দেখিনি। আমরা সবাই যে-যার মতো করে প্রতুলদাকে নিয়ে গিয়েছি যে কোনও জায়গায়। আসলে, প্রতুল মুখোপাধ্যায় তো আমাদের কাছে ‘ফোর ইন ওয়ান’– কোনও বিনিময় অর্থ লাগে না, বক্তব্য শোনা যায়, গান শোনা যায় এবং তার সঙ্গে তারকাসুলভ উষ্ণতাও অনুভব করা যায়। এমনকী, তেমন হলে, কিছু দিন আগে পর্যন্ত, আনতেও যেতে হত না, নিজেই চলে যেতেন। ‘শব্দে শব্দ জুড়ে গড়ব কথা/ সহজ সরল/ যে কথা শিশুরাও বুঝবে/ সেসব কথা হওয়ার মতো পৌঁছে যাবে ঘরে ঘরে/ সেসব কথা লাল গনগনে অঙ্গার হয়ে/ ছড়িয়ে পড়বে কোণে কোণে/ আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষের মনে।’ (জর্জ রেবেলোর
কবিতার ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে, ভাষান্তর ও গীতি রূপান্তর– প্র. মু., মার্চ ১৯৮৩)। ‘শব্দে শব্দ জুড়ে গড়ব কথা’-য় মনে পড়ে যায়, প্রতুলদার শব্দ নিয়ে খেলা করার কথা। প্রতুলদার কবিতা– ‘অভিধানের ছড়া’, ‘শব্দচর্চা’, অথবা ‘নদী-গঙ্গা-শব্দ-ধ্বনি-গান’, ‘বিশ্ববোধ’, ‘মানে না-মানা’, ‘একক আড্ডা–পেঁয়াজ বিষয়ক’ ইত্যাদি নিবন্ধে এই শব্দ নিয়ে খেলার অনেক উদাহরণ রয়েছে। তার কয়েকটা নমুনা দেখা যাক। ‘তালিকা’– ছোট্ট আকারের তালা, তুলনীয় পুস্তিকা। ‘চাপ’– যে চা পান করে, তুলনীয় মধ্যপ, মধুপ। ‘চুপচাপ’– চুপ করে থাকার জন্য বাইরে থেকে চাপ। ‘সম্ভ্রান্ত’– সম্পূর্ণ রূপে ভ্রান্ত ইত্যাদি। আরও দুটো নমুনা না-দিয়ে থামতে ইচ্ছা করছে না। ‘গালাগালি’– গালে গাল ছুঁইয়ে প্রীতিজ্ঞাপন, তুলনীয় কোলাকুলি। ‘মানহানি’– মান কচু আর মধু (হানি) দিয়ে তৈরি খাবার।
যে-মানুষটার কাছে ‘গালাগালি’ আর ‘মানহানি’ এই অর্থে ধরা দেয়, তাকেও আমাদের মতো কিছু-কিছু খর্বাকৃতি মানুষ গালাগালি করতে ছাড়েনি। অবশ্য এই খর্বাকৃতি মানুষের করার-ই বা কী আছে! এমন যঁার মেধা, এমন যঁার জীবনদর্শন, যিনি তাঁর জীবনের সব সঞ্চয় দান করে গিয়েছেন হয় কোনও হাসপাতালকে কিংবা কোনও-কোনও সংস্থাকে, তাঁর নিজের বসতবাড়িকেও টেনে নামিয়ে ছোট না করতে পারলে যে আমাদেরই সাধারণ মানুষ খর্বাকৃতি বলে হাসাহাসি করবে। ‘আমি বাংলায় গান গাই, আমি বাংলার গান গাই’– গানটিকেও আমরা ছাড়িনি! রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলামের মতো কবি থাকতে এই গানে কেবলমাত্র জীবনানন্দর নাম উল্লেখ করে প্রতুল মুখোপাধ্যায় একটা মস্ত ভুল করেছেন– এসব কথাও বলেছি। একবারও ভাবিনি এই গানে ‘জীবনানন্দ’ শব্দটি ‘জীবনের আনন্দ’ অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে– কোনওভাবেই কবি জীবনানন্দ দাশকে বোঝানো হয়নি। অবশ্য এমনও হতে পারে, আমরা, খর্বকায় মানুষ, বুঝতে পারিনি– এ-ও একটা ঐতিহাসিক ভুল।
১৯৬৮-’৬৯ সাল। প্রতুলদার তখন ২৬-২৭ বছর বয়স। গেজেটেড অফিসার। সেই সময় প্রতুলদার গানগুলিকে সবাই ‘কমরেড গুনিন’-এর গান বলে জানত। প্রতুলদাকে কেউ চিনত না। তা একদিন বলা হল– “আপনাকে একটা জায়গায় যেতে হবে গান শোনাবার জন্য। আপনি ‘ঐ রাস্তার মোড়ে’ দঁাড়িয়ে থাকবেন– নীল জামা পরা একজন লোক আপনাকে এসে ‘এই কথাটা’ বলে এগিয়ে যাবে– আপনি ওকে অনুসরণ করবেন– একটা গলির মধ্যে ঢুকে বঁাদিকে একটা বাড়ির দরজার দিকে ইঙ্গিত করে ওই লোকটি চলে যাবে– আপনি ভিতরে ঢুকে আবার দরজা ভেজিয়ে দিয়ে সোজা তিনতলায় চলে আসবেন।” এরকমই নির্দেশ আসত কমরেড গুনিনের কাছে, আর এই গুনিন সবকিছু তুচ্ছ জ্ঞান করে সেসব নির্দেশ পালন করতেন এবং গান শোনাতেন। প্রতুলদা সবসময়ই বলতেন যে, উনি ‘গান করেন’ না ‘গান বলেন’– ওঁর মতামত, বিশ্লেষণ কখনও নিজের লেখা গানের মাধ্যমে, কখনও বা অন্যের লেখা কবিতায় সুরারোপ করে।
গত বছর, ৩ অক্টোবর, বাংলা ভাষা ‘ধ্রুপদী ভাষা’-র মর্যাদা পেল আর প্রতুলদাকে কিছু জিজ্ঞাসা করব না তা ও কি হয়? বললাম– এখন তো অনেক ভাষাই ‘ধ্রুপদী ভাষা’-র সম্মান পেল। রাজ্যগুলি যদি তাদের মাতৃভাষাকে নিয়ে নিজের-নিজের ‘ভাষা দিবস’ ঘোষণা করে, তাহলে বোধহয় ‘হিন্দি’-র আগ্রাসনকে সহজেই রুখে দেওয়া যাবে। তিনি উত্তর দিলেন অন্যভাবে– এত সহজেই কি ‘হিন্দি’ ছেড়ে দেবে বলে তোমার মনে হয়? না দিলে অবশ্য আমি নিজেরই গান আবার গাইব– ‘লড়াই করো, লড়াই করো, লড়াই করো, লড়াই/ যত দিন না বিজয়ী হও।’
(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
anupart59@gmail.com