ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো যথার্থই পছন্দ করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে, কিন্তু কূটনীতির পিচ্ছিল পথে দু’টি দেশের সুসম্পর্ক স্থাপন বরাবরই জটিল প্রক্রিয়া। লিখছেন সুমিত মিত্র।
ডোনাল্ড ট্রাম্প ও নরেন্দ্র মোদি– উভয়ের জন্যই ২০২৪ গুরুত্বপূর্ণ বছর। প্রথমজন ইতিহাস তৈরি করে হোয়াইট হাউসে ফিরেছেন। দ্বিতীয়জন ফের ক্ষমতায় অভিষিক্ত হলেও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনে ব্যর্থ। তবে কূটনীতির পিচ্ছিল পথে দু’টি দেশের সম্পর্কস্থাপন বরাবর এক জটিল প্রক্রিয়া। ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের পরে ডেমোক্র্যাটিক প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের শাসনকালটি ভীষণ দুর্যোগপূর্ণ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া আক্রমণ শুরু করে ইউক্রেন। অচিরেই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ পরিণত হয় ‘বাইডেন বনাম পুতিন’ ছায়াযুদ্ধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পশ্চিম ইউরোপের শক্তিগুলিকে একত্র করে মার্কিন নেতৃত্বে গঠিত হয় ‘ন্যাটো’ (North Atlantic Treaty Organization), যার মূল লক্ষ্য ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রতিহত করা। রাশিয়াকে সামাল দিতে ইউক্রেন প্রার্থনা করেছিল ‘ন্যাটো’-র সদস্যপদ। তারই জবাবে রাশিয়ার তড়িৎ আক্রমণ।
নরেন্দ্র মোদির বিদেশনীতির লক্ষণীয় অপটিক্স হল, ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকুন বা না-থাকুন, তাঁর মতামতকে সর্বদা গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। আবার ভ্লাদিমির পুতিন যেহেতু ট্রাম্পের প্রিয়পাত্র, তাই রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ সম্পর্কেও ভারত নীরব থেকেছে। এমনকী, রাষ্ট্রপুঞ্জের নিন্দাপ্রস্তাবেও থেকেছে বিরত। গত বছর দিল্লিতে ‘জি২০’ শীর্ষ সম্মেলনের প্রস্তাবসূচি থেকে রাশিয়া প্রসঙ্গে ‘আগ্রাসন’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, তা নাকি করা হয়েছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রীর পীড়াপীড়িতেই। এতে, বলা বাহুল্য, বাইডেন-সহ ধনী পশ্চিমি গণতান্ত্রিক দেশসমূহের নেতারা মোটেই খুশি হননি।
আসলে, বাইডেন ও মোদির সম্পর্ক হয়ে পড়েছিল অনেকটা গ্রাম্য কুটুম্বের মতো, বাইরে মধুর সম্ভাষণ, অথচ ভিতরে তৈরি হচ্ছে মোকদ্দমার কাগজপত্র। শুধু আমেরিকা নয়, কানাডার সঙ্গেও ভারতের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। এই বিবাদের শুরু ১৮ জুন ২০২৩ সালে, পশ্চিম প্রান্তের শহর ভ্যাঙ্কুভারের নিকটবর্তী গুরুদ্বারের প্রধান হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা ঘিরে। এর তিন মাস পরে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও-দেশের সংসদে দাঁড়িয়ে অভিযোগ করেন, নিজ্জরের হত্যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রয়েছে ভারতীয় গুপ্ত এজেন্টরা। এরপর ভারতের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে দাদাগিরির অভিযোগ আরও ভয়ানক মোড় নেয়, যখন আমেরিকার তরফে বলা হয়, নিউ ইয়র্ক শহরে ষড়যন্ত্র চলছিল গুরুপতওয়ান্ত সিং পান্নুন বলে একজন খালিস্তানি সমর্থককে হত্যার।
পান্নুন যুগপৎ কানাডা ও আমেরিকার নাগরিক। এই পান্নুন ‘সুপারি হত্যা’ মামলায় মার্কিন নিরাপত্তা বাহিনীর জালে চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগ থেকে ধরা পড়েছে একজন অভিযুক্ত ষড়যন্ত্রকারী, নিখিল গুপ্ত, আপাতত নিউ ইয়র্কে বন্দি। যা ভারতের পক্ষে সবচেয়ে বিব্রতজনক তা হল– এই মামলায় মার্কিন আদালত থেকে সমন জারি করা হয়েছে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর একজন অফিসার, খোদ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল, এবং অবিশ্বাস্যভাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর বিরুদ্ধে।
এ-ই হল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার সঙ্গে ভারতের বর্তমান কূটনৈতিক সম্পর্কের স্বরূপ। প্রশ্ন হল, ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি দায়িত্ব গ্রহণের পরে ডোনাল্ড ট্রাম্প কি সম্পর্কের এত গভীর ফাটল বোজাতে পারবেন?
পারতেই হবে তঁাকে। কারণ, বিদায়বেলায় জো বাইডেন তীক্ষ্ণ ক্ষত রেখে গেলেন এই উপমহাদেশের সর্বত্র। এই বছরের আগস্ট মাসে বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের অন্তরালে অবশ্যই ছিল মার্কিন সম্মতি ও প্রভাব। তথ্যাভিজ্ঞ মহল জানে, ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে, হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনী তহবিলে গ্রামীণ ব্যাঙ্কের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট যে-অর্থসাহায্য করেছিলেন, সেজন্য ডোনাল্ড
ট্রাম্প একাধিকবার সর্বসমক্ষে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। ট্রাম্পের বাংলাদেশ নীতিতে কি এবার লক্ষণীয় কোনও বদল আসবে?
পাকিস্তানকে ওয়াশিংটন দিয়েছে ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ, পুরনো ‘এফ ১৬’ যুদ্ধবিমানের আধুনিকীকরণের জন্য। অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমানের প্রয়োজন তো ভারতীয় বিমান বাহিনীরও রয়েছে। ভারতের প্রার্থনা, ‘হ্যাল’ তার ‘তেজস’ ফাইটারের জন্য মার্কিন বহুজাতিক ‘জেনেরাল ইলেকট্রিক’-এর কাছে ইঞ্জিন কিনতে চায়, তার জন্য ছাড়পত্র দেওয়া হোক। শোনা যায়, ছাড়পত্র এসেছে, কিন্তু নানা প্রশাসনিক টালবাহানায় তা কবে বাস্তবায়িত হবে– তা অজানা।
ডোনাল্ড ট্রাম্প হয়তো যথার্থই নরেন্দ্র মোদির অনুরাগী– বিশেষ করে ২০২০ সালে টেক্সাসে ‘হাউডি মোদি’ সমাবেশে যেভাবে ট্রাম্পের অকুণ্ঠ প্রচার (‘অগলিবার, ট্রাম্প সরকার’) করেছিলেন তিনি, তার জন্য। কিন্তু মার্কিন দেশটি এখনও প্রজাতান্ত্রিক, আর সেখানে আইনের শাসন দস্তুরমতো বলবৎ রয়েছে। সম্মানরক্ষার জন্য মোদি সরকারের যা প্রয়োজন তা হল, মার্কিন আদালত থেকে তঁার উপর চাপানো যাবতীয় মামলার প্রত্যাহার। কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে আদালতে বিচারাধীন মামলায় নাক গলানো সম্ভবপর হবে?
ট্রাম্প-শাসিত আমেরিকার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্কের পথে আর-একটি গেরো হল, ইতোমধ্যে ঘোষিত আমদানি শুল্ক, যা নাকি হবে সাধারণভাবে ২০ শতাংশ, এবং চিনের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ, কারণ চিনকে তিনি
পূর্বকর্মের জন্য শাস্তি দিতে চান। বলা বাহুল্য, এর অনেকটাই ট্রাম্পের পরিচিত বাগাড়ম্বর।
কিন্তু আমেরিকার বাজারে প্রবেশমূল্য সহসা বৃদ্ধি পেলে– বিপুল ক্ষতিগ্রস্ত হবে তথ্যপ্রযুক্তি, ওষুধ ও বস্ত্রশিল্প। তার উপর ট্রাম্পের এখন সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ অনুরাগী হলেন ইলন মাস্ক, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনার্ঢ্য ব্যক্তি। তা, তিনি নাকি চেয়েছেন ভারত সংলগ্ন হোক তঁার ‘স্টারলিঙ্ক’ টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থায়, যেখানে প্রয়োজন ফুরবে বাড়ির ছাদে গ্রথিত টাওয়ারের; কারণ মহাকাশের কক্ষে ভূ-প্রদক্ষিণরত মাস্কের ৬,৩৭১টি স্যাটেলাইট কলকাতা থেকে বেতার তরঙ্গ আহরণ করে চোখের পলকে পৌঁছে দিতে পারে ক্যালিফোর্নিয়ায়। কী হবে তখন– গুজরাতের সিংহ আম্বানি ও তঁার টেলিকম স্বপ্নের?
(মতামত নিজস্ব)
লেখক সাংবাদিক
onlysumit@gmail.com