কিংশুক প্রামাণিক: প্রাণপণে জীবন ও মৃত্যুর মহাসংগ্রামের মধ্যে আজ স্বামীজিকে স্মরণের দিন। দু’-দণ্ড গর্বের দিন। ১৮৬৩ সালের ১২ জানুয়ারি যুগপুরুষের জন্ম। ১৬০তম জন্মদিনে পদার্পণ করলেন আজ।
বড় পবিত্র এক অধ্যায়। হ্যারি পটার থেকে ‘হইচই’, স্মার্টফোন থেকে সিআরসেভেন-এ মত্ত আজকের প্রজন্মের কাছে জানি না বিবেকানন্দর (Swmi Vivekananda) গুরুত্ব কতটা। বাস্তব হল, কর্ম ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৩৯ বছর বয়সি এক তরুণের মানব থেকে ঈশ্বরত্ব প্রাপ্তি, অধ্যাত্মবাদের মহান ইতিহাস।
মুক্তকণ্ঠে বাঙালি তাই বলেই যেতে পারে, বিবেকানন্দ আমাদের আত্মা, আমাদের পরিচয়, আমাদের গৌরব। এই ঘোষণায় সংবেদনশীল বিশ্ব কুর্নিশ করবে। কারণ, সবাই তো আর প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের (Donald Trump) মতো ‘অশিক্ষিত’ নন, যিনি ‘বিবেকানন্দ’ উচ্চারণ না শিখেই ভারতে পা দিয়েছিলেন।
যত দিন বাঙালি জাতি থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে, তত দিন স্বামী বিবেকানন্দ অমর। শুধু বাংলা কেন, সনাতন ভারতীয়ত্বকে বিশ্বের দরবারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এই বীর সন্ন্যাসী। শিকাগোর ধর্মসভায় আমেরিকার মানুষকে ‘ভাই’ বলে বুকে জড়িয়ে ধরার মধ্য দিয়ে তিনি বুঝিয়েছিলেন বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও মহামানবের জন্ম দেয় তুষার হিমালয় থেকে সুনীল সাগরে উদ্ভাসিত ভূখণ্ড ভারত।
[আরও পড়ুন: Swami Vivekananda: মার্কিন তরুণীর বিয়ের প্রস্তাবে কী বলেছিলেন বিবেকানন্দ? ফিরে দেখা মহাজীবনের এক ঝলক]
সর্বত্যাগী ঋষিকল্প এই যুগপুরুষের জীবনাদর্শ ছিল সেবা ও মানবতায় সম্পূর্ণ। পূর্বাশ্রমে তিনি নরেন্দ্রনাথ দত্ত। খুব ছোট থেকেই ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়তেন। রাম-সীতা-হনুমানের সামনে নতজানু হতে দেখা যেত। হয়তো সেই কারণে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক শক্তি স্বামীজির ছবিটি নিজেদের অনুষ্ঠানে টাঙিয়ে তাদের ‘প্রাণপুরুষ’ বলে আহ্লাদিত হয়। বাস্তবে, বিবেকানন্দর সঙ্গে ওরা বড্ড বেমানান।
স্বামীজি ছিলেন মানবতার পূজারি। হিন্দু ধর্মের যথার্থ পুরুষ। জীবে প্রেম ছিল তাঁর পথ। জীবের জাত-ধর্ম বিচার করতেন না। সর্বধর্মের শ্রেষ্ঠ উপায় একটি ছোট্ট কথায়– জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর। মারীক্লিষ্ট দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘আগে মানুষকে বাঁচাতে হবে। প্রথমে তাদের অন্নের ব্যবস্থা করো, তারপর ধর্ম কী তার বিচার হবে।’
স্নাতক তরুণ শুরু থেকেই চরম যুক্তিবাদী। অধ্যাত্মবাদ জাগরিত হল শ্রীরামকৃষ্ণর সাহচর্যে। নরেন হলেন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোয় সেই ঐতিহাসিক বক্তৃতা। পরের বছর নিউ ইয়র্কে ‘বেদান্ত সোসাইটি’ গঠন। ১৮৯৭ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রতিষ্ঠা। ১৯০২ সালে ৪ জুলাই মৃতু্য। মাত্র ৩৯ বছরে শেষ এক মহান জীবন। স্বল্প সময়ে যা রেখে গেলেন, তা জাতির অাশ্রয়, অবলম্বন, ভবিষ্যৎ।
সর্বগ্রাসী করোনা মহামারীর মধে্য স্বামীজির জন্মতিথি ফেরাল অতীতকে। ‘সেবা’ ও ‘মানবতা’ শব্দ দু’টি যখন অামাদের জীবনে জরুরি হয়ে উঠেছে, তখন এল ‘যুব দিবস’। মহামারী রুখতে একদা স্বামীজি নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কালাজ্বর, কলেরার আঘাত আজকের করোনার চেয়েও ছিল ভয়ংকর। গ্রাম—গ্রামান্তর এমনকী, কলকাতা ছারখার হয়ে গিয়েছিল মহামারীর হানায়। তখন বিজ্ঞানের এত উন্নতি হয়নি। যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব অাসেনি। সব খবর সবসময় সবার কাছে থাকত না, এখন যেমন প্রতিদিনই করোনা আপডেট আসে। কোন দেশে কত সংক্রমণ, কোথায় বাড়ছে, কোথায় কমছে, কী নতুন ওষুধ অাসছে, ভ্যাকসিন কীভাবে পাওয়া যাবে– সবই মানুষ এক মুহূর্তে জানতে পারে। বড় বড় হাসপাতাল, চিকিৎসাব্যবস্থার অামূল বদল এনে দিয়েছে। কিন্তু সেকালে এসব ছিল না। ফলে কিছু বোঝার আগে সংক্রামক ব্যাধি সমাজকে শ্মশান বানিয়ে দিত।
প্লেগ আ্ররও কালান্তক। উনিশ শতকের শেষ থেকে বিশ শতকের শুরু, মানে প্রায় ১২৫ বছর অাগে বাংলাকে কাঁদিয়ে দিয়েছিল প্লেগ। মারা যায় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট্ট মেয়ে। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ মহামারী রুখতে পথে নামেন। আর্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান স্বামী বিবেকানন্দ। স্বামীজির কাছে মানুষের জীবনের মূল্য ছিল অসীম। ত্রাণ জোগাড় করতে বেলুড় মঠ তৈরির জন্য নতুন জমি পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে মনস্থ করেন। যদিও সেই কাজ তাঁকে করতে হয়নি। অথচ, সেই বেলুড় মঠের দরজাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ২০২০ সালে কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময়।
১৮৯৬ সালে মুম্বই শহরে হানা দেয় প্লেগ। করোনাতেও যেমন তিন ঢেউয়ে মাথাব্যথা হয়ে উঠেছিল মহারাষ্ট্র, তেমন সেবারও সংক্রমণ ছড়ায় মারাঠা রাজ্য থেকে। কালক্রমে উত্তর ভারত। শেষে বাংলা। কলকাতায় প্লেগের তাণ্ডব শুরু হয় আরও দু’বছর পর, ১৮৯৮-এ। অনেকে মনে করেন, সেই সময় গঙ্গাসাগর মেলায় উত্তর ভারত থেকে বহু মানুষ এসে সংক্রমণ ছড়ায়। যদিও সেদিনের পরিস্থিতি আর আজকের পরিস্থিতি এক নয়। এই মুহূর্তে কলকাতায় সংক্রমণ প্রায় চূড়ায় উঠেছে। সাগরে মকরস্নানকে যথাসম্ভব সুরক্ষিত রাখার জন্য প্রশাসনের প্রবল তৎপরতা।
[আরও পড়ুন: জন্মজয়ন্তীতে স্বামী বিবেকানন্দের স্বপ্ন সত্যি করার সংকল্প প্রধানমন্ত্রীর, শ্রদ্ধা জানালেন মুখ্যমন্ত্রীও]
সেদিন পরিস্থিতি এরকম ছিল না। সবাই অসহায়। মৃত্যিমিছিল। প্লেগাক্রান্ত মানুষের পাশে দেখা গেল এক বিদেশিনীকে। স্বামীজির আহ্বানেই মানবসেবায় এগিয়ে এলেন অ্যাংলো-আইরিশ বংশোদ্ভূত মার্গারেট এলিজাবেথ নোবেল। মান, যশ, পাশ্চাত্যের বৈভব সব কিছু ছেড়ে দেওয়া সেই মানুষটিই ‘ভগিনী নিবেদিতা’।
সমাজে হাহাকার। লাখ লাখ মানুষ রাস্তায়-ঘরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। মহারানি ভিক্টোরিয়া চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ। প্লেগ কমিশন ও ব্রিটিশ সেনাদের নামিয়ে সফল হননি। নানা কুসংস্কার, অস্পৃশ্যতা, গোঁড়ামিতে ঢাকা মানুষও বিশ্বাস করেনি ব্রিটিশ সেনাদের।
সেদিন সবার অাশা হয়ে ওঠেন স্বামীজি। ১৮৯৮ সালের ৩ মে ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করলেন। বলা হয়, রামকৃষ্ণ মিশন যতটা সম্ভব সংক্রমণ রোখারও চেষ্টা করবে। কিন্তু টাকা? স্বামীজি বলেছিলেন, ‘দরকার হলে নতুন মঠের জমি বিক্রি করে দেব! আমরা ফকির, ভিক্ষা করে গাছতলায় শুয়েও দিন কাটাতে পারি। জমি বিক্রি করলে যদি হাজার হাজার লোকের প্রাণ বাঁচানো যায় তবে কিসের জায়গা? কিসের জমি?’ মানুষের জীবন রক্ষায় এভাবে নিজের স্বপ্ন চূর্ণ করতেও পিছপা হননি স্বামী বিবেকানন্দ। বলেছিলেন, ‘চোখ আমাদের পিছনের দিকে নয়, সামনের দিকে। অতএব সামনের দিকে অগ্রসর হও। মানুষকে বাঁচাতে হবে।’
যোগ্য সঙ্গত দিয়েছিলেন নিবেদিতা। ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন প্লেগ আক্রান্তদের মধে্য। মৃতু্যভয় পাননি। নিজের সুস্থতার কথা ভাবেননি। বস্তিতে, রাস্তায় রাতের পর রাত কেটেছে। সংক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে কী কী করতে হবে, বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে বুঝিয়েছিলেন।
ডা. রাধাগোবিন্দ কর, যাঁর নামে ‘আর. জি. কর হাসপাতাল’, তিনি লিখে গিয়েছিলেন নিবেদিতার সেবার কথা। এক শিশু প্লেগে আক্রান্ত। তার মা মারা গিয়েছে। অস্বাস্থ্যকর পল্লিতে গিয়ে সেই রোগগ্রস্তকে কোলে তুলে বসে ছিলেন বিজাতীয় মার্গারেট। শিশু হয়তো বাঁচেনি, কিন্তু শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত মাতৃস্নেহ থেকে সে বঞ্চিত হয়নি। গোটা দেশ সেই দৃশ্যে মুক্তির আলো খুঁজেছিল। এই ছিল বিবেকানন্দর শিক্ষা।