shono
Advertisement
Chess

শতরঞ্জের শেষ সুলতান, স্বীকৃতি ছিল না অবিভক্ত ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক দাবাড়ুর

আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন তাঁকে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ খেতাব দেয়নি।
Published By: Kishore GhoshPosted: 04:01 PM May 12, 2024Updated: 04:01 PM May 12, 2024

বিশ্বনাথন আনন্দের বহু আগে, অবিভক্ত ভারতের প্রথম আন্তর্জাতিক দাবাড়ু তিনি। বিংশ শতকের শুরুর দিকে, ইউরোপে ‘গ্রেটেস্ট ন‌্যাচারাল প্লেয়ার অফ মর্ডান টাইমস’ শিরোপা পেয়েছিলেন। তবু, আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন তাঁকে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার’ জাতীয় কোনও খেতাব দেয়নি। লিখছেন তাপস দে

Advertisement

দাবা খেলায় বিশ্বনাথ আনন্দের অনেক আগে ভারত থেকে একজন বিশ্বচাম্পিয়ন হয়েছিলেন। কিন্তু খেলাধুলোর দুনিয়া বিশেষ করে ‘আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন’ (FIDE) তঁাকে প্রাপ‍্য সম্মান ও স্বীকৃতি দেয়নি এবং সুদীর্ঘ কাল মুখ ফিরিয়ে ছিল।

১৯০৩ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের মিঠা তিয়ানা গ্রামে (এখন পাকিস্তানে) পীরবাড়িতে জন্ম হয় ভারতের আদি দাবা প্রতিভা মিয়া সুলতান খানের। বাবা মিয়া নিজাম পিরের উৎসাহে ন’-বছর বয়সি ছোট্ট সুলতান পা রেখেছিলেন ইন্ডিয়ান স্টাইল চেজ গেমে। স্থানীয় নানা প্রতিযোগিতায় খেলতে খেলতে উত্তর-পশ্চিম ভারতের প্রথম সারির খেলোয়াড় হিসাবে দাবা রসিকদের নজরে পড়েন বছর বিশেকের সুলতান মিয়া। তঁাদের মধে‌্য একজন হলেন বিলেত-ফেরত ভূস্বামী জমিদার ও দাবা কুশলী, রিটায়ার্ড মেজর সাহেব উমর তিয়ানা। ক্রমে জহুরি উমর সাহেব ছেলেটির দাবা খেলা দেখে মজলেন এবং ছেলেটির ভরনপোষণ ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিলেন। হয়ে উঠলেন তঁার পৃষ্ঠপোষক বা mentor। উমরের ছত্রছায়ায় নির্ভাবনায় দাবা খেলাই ধ‍্যানজ্ঞান হয়ে উঠল সুলতান মিয়ার। ১৯২৮ সালে উমর সাহেব উদে‌্যাগ নিয়ে প‍্যান ইন্ডিয়ান দাবা প্রতিযোগিতার আয়োজন করলেন। সেখানে সুলতানের মাথাতেই উঠল ভারতীয় দাবা চাম্পিয়নশিপের খেতাব। সেবারে টানা ন’টি ম্যাচে তিনি জিতলেন মাত্র আধপয়েন্ট খুইয়ে।

 

[আরও পড়ুন: ‘এমন জায়গায় জিতব, ভোট পণ্ডিতরাও চমকে যাবেন’, বাংলা নিয়ে বড় ঘোষণা মোদির

এরপর উমর সাহেবের হাত ধরে জাহাজে চড়ে সুলতান পাড়ি দিলেন ইংল‍্যান্ড। উমর সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক দাবার নিয়মকানুনে সড়গড় করে সুলতানের সহজাত প্রতিভাকে ইউরোপিয়ান সমঝদারদের সামনে পেশ করা। বিশ্ব দাবার সঙ্গে ভারতীয় দাবার অনেকটাই তফাত এবং সীমাবদ্ধতা ছিল বোড়ে ও রাজার চালে। ক‍্যাসলিংয়ের নিয়মও ছিল না। উমর সাহেবের সুপারিশে প্রাথমিক পরীক্ষা নিয়ে সুলতানকে মেম্বারশিপ দিল লন্ডনের অভিজাত ইম্পেরিয়াল চেস ক্লাব। মেম্বার হয়েই পরের দিন তঁাকে মোকাবিলা করতে হল সাউথ আফ্রিকার দাবাড়ু ব্রুনো সিংঘমকে। এর দু’দিনের মধ্যে সম্মুখ সমরে বসতে হল চাম্পিয়ন ক‍্যাপাব্লাঙ্কা-র সঙ্গে। প্রথম টুর্নামেন্টে তেমন ভাল র‍্যাঙ্কিং হয়নি সুলতানের। কিন্তু সেখানে ছাইচাপা আগুনের কিছুটা অঁাচ পেয়েছিলেন শীর্ষ দাবাড়ু উইলিয়াম উইন্টার ও ফেদ্রিক গেটস। সাদাসিধা সুলতানকে তঁারা দিয়েছিলেন বেশ কিছু চালবাজি টিপস।

সেই সময়ে দাবা খেলা ছিল পয়সাওয়ালাদের একচেটিয়া। কারণ, বড় অঙ্কের মেম্বারশিপ ফি ও টুর্নামেন্টের অ‍্যাপিয়ারেন্স মূল‌্য। সুলতান খান লেখাপড়া তেমন জানতেন না। ইঙ্গিত সংকেতে সবকিছু রপ্ত করতেন। তঁার মাথাটি ছিল সাফ আর তেমনই সবকিছু মনে রাখার ক্ষমতা। এবার দাবার দুনিয়ায় তঁার প্রকৃত সুলতানি শুরু হল। প্রথমে ১৯২৯ এবং তারপর ১৯৩২, ’৩৩ দু’বছর ধরে সাহেব দাবাড়ুদের হারিয়ে জয় করলেন ব্রিটিশ চেজ চাম্পিয়নশিপ। তঁার প্রতিভার কাছে একে-একে হার মানলেন গ্র্যান্ডমাস্টার আকিবা রুবেনস্টাইন, সোলা ফ্লোর, হোসে রাউল ক্যাপাব্ল্যাঙ্কা, স্যাভিয়েলি তার্তাকোয়ের-দের মতো তারকা দাবাড়ুরা। তারপর দু’বার ব্রিটিশ অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে জয়লাভ। সে-সময়ে সুলতানের ক্রীড়াশৈলীর বৈশিষ্ট‌্য ছিল দ্রুত এন্ডগেম ফিনিশ করার দক্ষতা।

 

[আরও পড়ুন: এবার মল্লিকার্জুন খাড়গের চপারে তল্লাশি! ‘শুধু কি বিরোধীরাই নিশানায়’, প্রশ্ন কংগ্রেসের

এবার ট্রাজেডির কথা! এত কিছু করার পরও আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশন তঁাকে ‘গ্র্যান্ডমাস্টার’ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল মাস্টার’ জাতীয় কোনও খেতাব দেয়নি। কিন্তু, তত দিনে তিনি ইউরোপীয় বিশেষজ্ঞ সমঝদারদের থেকে ‘গ্রেটেস্ট ন‌্যাচারাল প্লেয়ার অফ মর্ডান টাইমস’ শিরোপা পেয়ে গিয়েছেন। কেন এই ট্রাজেডি? আসলে মাত্র পঁাচ বছরের মেয়াদ ছিল সুলতানের আন্তর্জাতিক দাবা কেরিয়ারের। কারণ, ১৯৪১ সালে মেজর উমর তিয়ানার অকালপ্রয়াণ। তখন ভাষা যোগাযোগ ও আর্থিক সমস্যার জন্য নিরক্ষর সুলতান বিলেতের পাট চুকিয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হন। এভাবেই তঁার মতো সেকালের অনেক খেলোয়াড়ের জীবনে নেমে এসেছিল করুণ পরিণতি। কারণ, আজকের মতো সরকারি-বেসরকারি সুযোগসুবিধা ও স্পন্সরশিপ তখন মিলত না।

তারপর ইতিহাসের চাকা ঘুরে দেশভাগ। মিয়া সুলতানের ঠিকানা হল পাকিস্তান। কিন্তু সেখানে কোনও দিন আর দাবার বোর্ড ধরেননি অভিমানী মিয়া। বিতৃষ্ণায় পরিবারের কাউকে এই খেলা খেলতেও শেখাননি। বদলে অন্য সম্মানজনক পেশাতে যাওয়ার পরামর্শ দিতেন তিনি। নিজের বাকি জীবন কাটিয়ে ছিলেন পারিবারিক ব্যবসা ও জমিজিরেতের দেখভাল করে। এভাবেই অনাদরে-উপেক্ষায় অপচয় হয়ে গেল এক প্রতিভা ও প্রতিশ্রুতির, যা হতে পারত ভাবীকালের দৃষ্টান্ত। ১৯৬৬ সালের ২৫ এপ্রিল সরগোদায় দেশের বাড়িতে তঁার জীবনাবসান হয়েছিল।

 

[আরও পডুন: শাহজাদার বয়েসের চেয়েও কম আসন পাবে কংগ্রেস: বঙ্গে প্রচারে এসেও মোদির নিশানায় রাহুল]

বিশ্ব‌চ‌্যাম্পিয়ন বিশ্বনাথন আনন্দ এই কিংবদন্তি পথপ্রদর্শক ক্রীড়াবিদকে শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছিলেন– সুলতান খান ছিলেন প্রথম এশিয়ান বিশ্বচ‌্যা‌ম্পিয়ন, যিনি উচ্চকোটির দাবা খেলাকে সর্বসাধারণের আঙিনায় আনতে সফল হয়েছিলেন। ২০২০ সালে ব্রিটিশ গ্র‍্যান্ডমাস্টার ড‍্যানিয়েল কিং বিস্মৃত সুলতান মিয়ার উপর একটি বই লিখে সোচ্চার হন এরকম অসাধারণ প্রতিভার যোগ‍্য স্বীকৃতির জন‍্য। অবশেষে ধর্মের কল বাতাসে নড়ল প্রায় একশো বছর পর। আন্তর্জাতিক দাবা ফেডারেশনের প্রধান

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসের দু’তারিখে সুলতান খানকে মরণোত্তর গ্রান্ডমাস্টার শিরোপা প্রদান করলেন। তবে, রাজনীতি আর দেশভাগের কারণে সেই পুরস্কার সম্মান জুটল পাকিস্তানের কপালে, যেখানে এই সিংহহৃদয় চাম্পিয়ন শেষ জীবন কাটিয়েছিলেন।

(মতামত নিজস্ব)
লেখক প্রাবন্ধিক
tapask_de@yahoo.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • ১৯০৩ সালে পাঞ্জাব প্রদেশের মিঠা তিয়ানা গ্রামে (এখন পাকিস্তানে) পীরবাড়িতে জন্ম হয় ভারতের আদি দাবা প্রতিভা মিয়া সুলতান খানের।
  • মিয়া সুলতানের ঠিকানা হল পাকিস্তান। কিন্তু সেখানে কোনও দিন আর দাবার বোর্ড ধরেননি অভিমানী মিয়া।
Advertisement