পৃথিবীর জনসংখ্যার ১৭% মানুষ এ-দেশে বাস করে, মিষ্টি পানীয় জলভাণ্ডারের মাত্র ৪% পুঁজি নিয়ে। আবার, এ-দেশের দৈনিক দূষিত জলের মাত্র ২৮% শোধন করা হয় প্রযুক্তিনির্ভর উপায়ে। এমন প্রেক্ষিতে শোধিত জল থেকেই শহরে ব্যবহার্য জলের অন্তত ২০% এবং শিল্পচাহিদার ৪০% পূরণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। লিখছেন পার্থপ্রতিম বিশ্বাস।
বাঙালির পরিচিত বাক্য– ‘জলের অপর নাম জীবন’। কিন্তু এমন বাক্যটি মুখস্থ হলেও এর গভীরতর উপলব্ধি ধাতস্থ হয়নি অনেকেরই! ভূপৃষ্ঠের তিনভাগ জলে ঢাকা হলেও সেই জলের মধ্যে পানীয় জলের পরিমাণ মাত্র ২.৫%, বাকি জল পানের অযোগ্য। ফলে জলময় এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জল খুঁজতে গিয়ে মানুষের এখন চোখের জলে-নাকের জলে অবস্থা!
পৃথিবীর জনসংখ্যার ১৭% মানুষ এ-দেশে বাস করে, মিষ্টি পানীয় জলের ভাণ্ডারের মাত্র ৪% পুঁজি নিয়ে। ঐকিক নিয়মেই এটা স্পষ্ট যে, জনসংখ্যার নিরিখে এ-দেশের জলের ভঁাড়ার অপ্রতুল। জলের জোগান যে কোনও অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করলেও– চাহিদা নির্ভর করে মূলত জনসংখ্যার উপর। তাই অনুমান, বিপুল জনসংখ্যার দাপটে জলের চাহিদা ও জোগানের ভারসাম্যের সংকটে পড়তে চলেছে এই দেশ।
আমাদের দেশের জনঘনত্ব সর্বত্র সমান নয়। গ্রামের তুলনায় শহরের জনঘনত্ব অনেক বেশি। হাল আমলে কার্যত দেশের অর্থনীতির এপিসেন্টার হয়ে উঠছে শহর। আর, ক্রমবর্ধমান জনঘনত্বের ধাক্কায় শহরের বাস্তুতন্ত্রে আসতে চলেছে জলের তীব্র সংকট। পৃথিবীর আর্থিক বৃদ্ধির মডেলের সঙ্গে সংগতি রেখেই এ-দেশেও দ্রুত বেড়ে চলেছে নগরায়নের গতি। আগামী ২০৪৭ সালে যখন দেশের স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তি হবে, তখনও এ-দেশের অর্ধেক মানুষ থাকবে শহরের সীমানায়। দেশের ৭৮তম জাতীয় নমুনা সমীক্ষা রিপোর্ট অনুযায়ী, এ-দেশের শহরাঞ্চলের ৪২% বাড়িতে নলবাহিত পানীয় জলের সংযোগ নেই। এমন প্রেক্ষিতে অদূর ভবিষ্যতেই এ-দেশের ৩০টি শহরে জল সংকট তীব্রতম হবে বলেই আশঙ্কা।
এমন প্রেক্ষিতে জল যদি জীবনের ভিত্তি হয়, তবে মানুষের বেঁচে থাকার আর-পঁাচটা সাংবিধানিক অধিকারের মতোই বিশুদ্ধ জলের অধিকারও সেই তালিকাভুক্ত হবে বইকি। ইতিমধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার সরকার নগরায়নের গ্রাসে পড়া বিভিন্ন শহরের জল সংকটের প্রেক্ষিতে সে-দেশে জলের অধিকারকে নাগরিকদের ‘সাংবিধানিক অধিকার’ হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই দেশের সংবিধানে মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনি মামলায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত বিশুদ্ধ জলের অধিকারকে নাগরিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হিসাবে চিহ্নিত করলেও, এ-দেশে মানুষের জীবনে জলের অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি মেলেনি। কিন্তু জল এবং জীবন সমার্থক বলেই আখেরে বিশুদ্ধ জলের অধিকার আমাদের অন্যতম জরুরি মানবাধিকার হয়ে উঠেছে।
এমন মানবাধিকার রক্ষার তাগিদে সম্প্রতি সরকারি উদ্যোগে গ্রামের প্রতিটি বাড়িতে নলবাহিত বিশুদ্ধ জল পৌঁছে দেওয়ার উদ্যোগ চলেছে ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পের মাধ্যমে। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে গ্রামের প্রায় ৭৪% বাড়িতে জলের কল পৌঁছে দেওয়া গেলেও, সেই জলের নল দিয়ে পর্যাপ্ত জল পাওয়ার নিশ্চয়তা মেলেনি। কারণ যে-হারে জনসংখ্যা বাড়ছে সেই হারে দেশের জলসম্পদ বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। ফলে জলের জোগান নিশ্চিত করতে বৃষ্টির জলে-ভরা নদী, পুকুর, খাল, বিলের জল ছাপিয়ে ভূগর্ভের জলের উপর নির্ভরতা বেড়ে চলেছে উত্তরোত্তর। এই নির্ভরতা গ্রামের কৃষিকাজে যেমন বাড়ছে, সেচের প্রয়োজনে তেমনই শহরাঞ্চলে বেড়ে চলেছে শিল্প-পরিষেবা। এখন এ-দেশের শহরাঞ্চলে জলের ৪৫% জোগান আসে ভূগর্ভের জল থেকে। পৃথিবীর নিরিখে ভূগর্ভের সর্বাধিক জলের ব্যবহার হয় এই দেশেই। কিন্তু মনে রাখা দরকার যে, ভূগর্ভের জমা জলের ভাণ্ডার অফুরন্ত নয়, বরং সীমিত। ফলে সীমিত সেই জলভাণ্ডার থেকে যে পরিমাণ জল টেনে তুলে নেওয়া হচ্ছে– সেই পরিমাণ জল পুনরায় ভূগর্ভে প্রবেশ না-করলে জলের ভঁাড়ারে ঘাটতি অনিবার্য। দিল্লি, বেঙ্গালুরু বা মুম্বইয়ের তুলনায় জলসম্পদের নিরিখে কলকাতা নিরাপদ হলেও, এই শহরের জলস্তর ক্রমাগত নেমে চলেছে ভূগর্ভের জলের ব্যবহারের দাপটে। ভূগর্ভের জলস্তর নামার সঙ্গে-সঙ্গে গোটা শহরের মাটিও বসে চলেছে। ফলে, বসতে চলেছে শহরের বাড়ি-ঘর, সড়ক-সেতু, এই শঙ্কা অমূলক নয়।
অপরিকল্পিত নগরায়ন ও নির্মাণ ক্ষেত্রের বৃদ্ধির কারণে শহর জুড়ে বেড়ে চলেছে কংক্রিটের আস্তরণ। কমে চলেছে সবুজ চাদর। ফলে কংক্রিটের আস্তরণে ঢাকা শহরের মাটি চুঁইয়ে বৃষ্টির জলের পাতালপ্রবেশের পথ প্রায় অবরুদ্ধ। আর, বৃষ্টির মিষ্টি জলের পাতাল প্রবেশের পথ অবরুদ্ধ হওয়ায়– সেই জল নদী-খাল পেরিয়ে নোনা জলের সমুদ্রে মিশে নষ্ট হচ্ছে। একদিকে জলের ভূগর্ভে প্রবেশের পথ রুদ্ধ, অন্যদিকে বাড়তি মানুষের জলের জোগান করতে টেনে তুলতে হচ্ছে রোজ ভূগর্ভের জল। এভাবেই নতুন বিপদের আবর্তে পড়েছে জলের বাস্তুতন্ত্র। এমন প্রেক্ষিতে ‘জল ধরো জল ভরো’ জাতীয় প্রকল্পের প্রসার আরও প্রয়োজন– বৃষ্টির জল ধরে রাখা এবং ভূগর্ভে মিষ্টি জল ঠেলে পাঠানোর লক্ষ্যে। প্রয়োজন শহরজুড়ে বাড়ি-বাড়ি বৃষ্টির জল ধরে রাখার বিকল্প পরিকল্পনা। এ-দেশে জলের বিভিন্ন উৎসের ৭০% কম বেশি দূষিত। এই দূষণের সিংহভাগ ঘটছে শিল্প পরিষেবার ক্ষেত্র থেকে। বিশেষত, উৎপাদন ক্ষেত্র এবং কৃষিনির্ভর শিল্পে ব্যবহৃত জলের বর্জ্য পদার্থ হিসাবেই এমন দূষণ ঘটছে সর্বাধিক।
এই নিরিখে শিল্প পরিষেবায় ব্যবহৃত জলের উপর উপযুক্ত মাশুল এবং সরকারি নিয়ন্ত্রণ জরুরি। দূষিত জল অশোধিত অবস্থায় ভূগর্ভে প্রবেশ করলে– জলের ভাণ্ডারকেও দূষিত করে তোলে। এ-দেশের দৈনিক দূষিত জলের মাত্র ২৮% শোধন করা হয় প্রযুক্তিনির্ভর উপায়ে। এমন প্রেক্ষিতে শোধিত জল থেকেই শহরে ব্যবহার্য জলের অন্তত ২০% এবং শিল্পচাহিদার ৪০% পূরণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির হয়েছে। মনে রাখা উচিত, শহরে দূষিত জলশোধনের প্রাকৃতিক উপায় হচ্ছে জলাভূমির সংরক্ষণ। কারণ, জলাভূমি হল শহরের কিডনি। তাই শহরে জলাভূমি রক্ষা জরুরি জলের দূষণ রুখতেই। পাশাপাশি, জলের অপচয় বন্ধেও প্রয়োজন কড়া প্রশাসনিক এবং সামাজিক উদ্যোগ। মনে রাখা উচিত, এই দেশে ৩৮% জল নষ্ট হয় নল-পথ দিয়ে গ্রাহকের বাড়ি পৌঁছনোর আগেই। ফলে বিদ্যুতের মতো জল চুরি রুখতেও প্রয়োজন কাঙ্ক্ষিত প্রশাসনিক কঠোরতা। পরিশেষে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে উত্তরোত্তর এই দেশের শহরাঞ্চলে উষ্ণায়নের প্রভাব বেড়ে চলায় বাড়ছে জলের চাহিদা। ফলে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি জলবায়ু পরিবর্তনের জোড়া ধাক্কায় বেলাগাম হতে পারে জলসংকট।
(মতামত নিজস্ব)