shono
Advertisement
Manmohan Singh

মনমোহনের সাফল্য, নেপথ্যের দুই কারিগর

মনমোহন সিংয়ের পাশাপাশি দুই নেতার বিচক্ষণতাও রয়েছে ভারতের আর্থিক সংস্কারের সাফল্যে।
Published By: Kishore GhoshPosted: 04:06 PM Jan 02, 2025Updated: 04:06 PM Jan 02, 2025

মনমোহন সিংয়ের মূল্যায়ন করতে গেলে, তাঁর দূরদৃষ্টি ও বিচক্ষণতার কথা যেমন চলে আসে, তেমনই অবধারিতভাবে উচ্চারিত হয় আরও দু’টি নাম, যাঁদের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সাহচর্য ছাড়া তিনি স্ফূর্তিতে কাজ করতেই পারতেন না হয়তো। তাঁদের একজন নরসিংহ রাও, অন্যজন সোনিয়া গান্ধী। কী অবদান এঁদের? লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

মনমোহন সিংয়ের বিশ্বাস ছিল, ইতিহাস তঁার প্রতি সদয় হবে। নিজের প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল বলেই ইতিহাস-রচয়িতাদের উপর এই ভরসা তিনি রাখতে পেরেছিলেন। ইতিহাস তো জনতাই গড়ে। জনতা কখনও তঁার প্রতি নির্দয় হয়নি। নির্দয় ছিল সমকালীন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যারা স্বল্প ও মৃদুভাষী মানুষটিকে দুর্বল ও দুনীতিগ্রস্ত বলে চিহ্নিত করেছে। দুর্নীতির প্রশ্রয়কারী বলে দাগিয়ে দিয়েছে। কিন্তু সেই বিরুদ্ধ-প্রচার তঁার সযত্নলালিত শ্বেতশুভ্র ভাবমূর্তিতে বিন্দুমাত্র কালি ছেটাতে পারেনি। মনমোহন সিংয়ের মৃত্যুর পর দেশ-বিদেশের খবরের কাগজ ও সামাজিক মাধ্যমের প্রতিক্রিয়া এবং পণ্ডিতি ভাষ্য তারই প্রমাণ।

নতুন বছরের প্রথম দিনে লিখিতভাবে এটাই জানাতে চাই, সর্বার্থে শিক্ষিত, সুশীল, ভদ্র, স্বচ্ছ, নির্লোভ, সৎ ও দক্ষ রাজনীতিকরা বিরল প্রজাতির প্রজাপতির মতো দ্রুত বিলীয়মান। ওই তালিকায় মনমোহন সিংয়ের পর ওই মাপের আর কোনও নাম সংযোজিত হওয়ার সম্ভাবনা চোখে পড়ছে না। মনমোহনই আপাতত শেষ মাইল ফলক।

মৃত্যুর পর বিরূপ সমালোচনা না-করাই শালীনতা। মৃত ব্যক্তির ইতিবাচক দিকগুলিই সাধারণত স্মরণ করা হয়। মনমোহন সিং এক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম। তঁার মৃত্যুর পর ক’দিন ধরে গণমাধ্যমে যা-যা লেখা হয়েছে ও হচ্ছে, যেভাবে তঁার মূল্যায়ন হচ্ছে, সেই ভাষ্য শালীনতা রক্ষার চেষ্টায় নয়। জীবদ্দশাতেই ওই মূল্যায়ন সম্পর্কে তিনি অবহিত। নীতিপঙ্গুত্বের অভিযোগ ছাড়া আর যে-যে বিষয়ে প্রতিপক্ষ তঁার প্রতি উষ্মা প্রকাশ করেছে, সমালোচনার নামে আক্রমণাত্মক হয়েছে– সবই আরোপিত। জীবিত অবস্থাতেই তিনি ভূষিত হয়েছেন আধুনিক ভারতের অর্থনৈতিক বিকাশের রূপকার হিসাবে। সেই সম্মান ও শ্রদ্ধা তিনি অর্জন করেছেন দূরদৃষ্টি, দেশপ্রেম, অর্থনৈতিক প্রজ্ঞা, দৃঢ়চেতা ও নির্লোভ-নিষ্কলুষ জীবনযাপনের জন্য। তঁার সঙ্গে অন্যদের ফারাক কোথায় ও কতখানি, মৃত্যুর পর তা আরও বেশি প্রকট।

সংগত কারণেই এখন সর্বত্র তিনি নন্দিত ও বন্দিত। কিন্তু অর্থনীতিবিদ থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠার সোপানগুলি তিনি এত সহজে ও স্বচ্ছন্দে আরোহণ করতে পারতেন না দু’জনের অকুণ্ঠ সমর্থন না পেলে। এই উপুড় করা শ্রদ্ধাঞ্জলি পর্বে সেই দু’জনের মূল্যায়নও জরুরি যাতে তঁাদের অবদান ফিকে মনে না হয়।প্রথমজন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও, দ্বিতীয়জন সোনিয়া গান্ধী, প্রধানমন্ত্রিত্ব অর্পণ করা সত্ত্বেও যিনি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

নরসিংহ রাও-ই মনমোহনকে বাধ্য করেছিলেন অর্থমন্ত্রকের দায়িত্ব নিতে। কীভাবে, সেই গল্প শুনিয়েছেন মনমোহনের কন্যা দামন সিং। তাঁর লেখা ‘স্ট্রিকলি পার্সোনাল : মনমোহন অ্যান্ড গুরশরণ’ অনুযায়ী– ১৯৯১ সালের জুন মাসে নেদারল্যান্ডসে এক সম্মেলনে যোগ দিয়ে বাড়ি ফিরে ঘুমিয়ে পড়েছেন তাঁর বাবা। তখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান।

গভীর রাতে ফোন বাজল। ধরলেন দামনের স্বামী বিজয় তনখা। অন্যপ্রান্তে পি. সি. আলেকজান্ডার। ঘুম থেকে ডেকে তোলা মনমোহনকে তিনি বললেন, পরদিন রাষ্ট্রপতি ভবনে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণে উপস্থিত থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ। সেই শুরু। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে জহুরি নরসিংহ রাও ওই গুরুদায়িত্ব পালনে মনমোহনকে পছন্দ করেছিলেন, এখন এত দিন পর অনেকেরই হয়তো তা মনে নেই। সোনা গচ্ছিত রেখে ২.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়ে পদত্যাগ করেছেন প্রধানমন্ত্রী চন্দ্রশেখর।

বৈদেশিক মুদ্রার ভঁাড়ারে জমা মাত্র ১.২ বিলিয়ন ডলার। তা দিয়ে বড়জোর দু’-সপ্তাহের আমদানি বিল মেটানো যাবে। চড়চড় করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। মুদ্রাস্ফীতি দুই অঙ্কে পৌঁছে গিয়েছে। কোনও বৈশ্বিক ব্যাঙ্ক ভারত সরকারকে ঋণ দিতে চাইছে না। হাল ফেরাতে যা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন, সেই পদক্ষেপ করতে মনমোহনকে ‘গ্রিন সিগনাল’ দিয়েছিলেন নরসিংহ রাও। দুই খেপে টাকার অবমূল্যায়নের পাশাপাশি লাইসেন্স-পারমিটরাজ খতম করে অর্থনৈতিক উদারীকরণের পথে হঁাটার যে-সাহস মনমোহন প্রথম বাজেটেই দেখান, যেভাবে সংস্কারের পথে হেঁটেছিলেন, নরসিংহ রাওয়ের ঢালাও সমর্থন ও বিশ্বাস ছাড়া তা সম্ভবপর হত না।

মনে রাখতে হবে– সরকারি আনুকূল্য, পৃষ্ঠপোষকতা ও দাক্ষিণ্যভোগী সেই সময়কার শিল্পপতিরা, ‘বম্বে গ্রুপ’ নামে যঁারা পরিচিত ছিলেন, নরসিংহ রাওয়ের উপর কম চাপ সৃষ্টি করেননি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পিছু হটেননি। পূর্ণ সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন অর্থমন্ত্রীকে।
নিজের প্রতি মনমোহনের বিশ্বাস ছিল ষোলো আনা, মনমোহনের প্রতি নরসিংহ রাওয়ের
বিশ্বাস ছিল আঠারো আনা। মুশকিল আসান সেই যুগলবন্দিতে।

হাকুচ হতাশা কাটিয়ে ঘুরে দঁাড়িয়েছিল ভারতীয় অর্থনীতি। ১০০ কোটি ২০ লাখ ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার ভাণ্ডার মাত্র দু’বছরে মনমোহন ১ হাজার কোটিতে নিয়ে গিয়েছিলেন। অর্থমন্ত্রী হিসাবে এবং পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী হয়ে আর যা-যা তিনি করেছেন, সংসদে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ দল দশ বছরেও সেই সাফল্য ছুঁতে পারেনি।

\অর্থমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন সিংয়ের ঈর্ষণীয় সাফলে্যর নেপথ্যে নরসিংহ রাওয়ের অবদান যেমন অনস্বীকার্য, তেমনই প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তঁার মূল্যায়নের সময় সোনিয়া গান্ধীর অবদানের কথাও মনে রাখতে হবে। ২০০৪ সালের নির্বাচনের পর সবাই যখন সোনিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠনের প্রতীক্ষায়, তখন রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন সিংয়ের নামই জানিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন কংগ্রেস সভানেত্রী। এই সত্য সবার জানা। কিন্তু খুব অল্প লোকেরই জানা, ১৯৯৯ সালে এক ভোটে বাজপেয়ী সরকারের পতনের পর সোনিয়া ‘বিকল্প’ সরকার গড়তে উদ্যোগী হয়েছিলেন। সংবাদমাধ্যমকে বলেওছিলেন, ২৭২ জনের সমর্থন তঁাদের আছে। তখনও মনমোহনই ছিলেন সোনিয়ার পছন্দ।

‘দ্য হিন্দুস্তান টাইমস’-এর প্রাক্তন রাজনৈতিক সম্পাদক পঙ্কজ ভোরা সম্প্রতি এক নিবন্ধে লিখেছেন, তৎকালীন রাষ্ট্রপতি কে. আর. নারায়ণনকে সোনিয়া সে-কথা জানিয়েও দিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে সোনিয়া ‘বিকল্প’ সরকার গড়তে পারেননি দলের একাংশের বিরোধিতার দরুন। তঁারই ঘনিষ্ঠ মাধবরাও সিন্ধিয়া মেনে নিতে পারেননি মনমোহনকে। বন্ধু অমর সিং-কে ডেকে বলেছিলেন, মুলায়ম সিং যাদব যেন সরকার গড়তে কংগ্রেসকে সমর্থন না করেন। শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক নড়াচড়া। ভোটগ্রহণ অনিবার্য হয়ে ওঠে। আর, বাজপেয়ীও তৃতীয়বারের জন্য সরকার গড়েন।

১৯৯৯ সালের লোকসভা ভোটে মনমোহনকে দক্ষিণ দিল্লি থেকে প্রার্থী করেছিলেন সোনিয়া। ভেবেছিলেন, বিজেপির বিজয়কুমার মালহোত্রাকে হেলায় হারিয়ে মনমোহন লোকসভার সদস্য হবেন। কিন্তু কংগ্রেস রাজনীতির চোরাবালিতেই মনমোহনকে ডুবতে হয়েছিল। সোনিয়ার সদিচ্ছাও তঁাকে তরাতে পারেনি। ১৯৯৯ সালে ব্যর্থ হলেও সোনিয়া সফল হয়েছিলেন ২০০৪ সালে। মনমোহনকে প্রধানমন্ত্রী করেছিলেন প্রণব মুখোপাধ্যায়, অর্জুন সিং, এন. ডি. তিওয়ারি, পি. চিদাম্বরমের দাবি উপেক্ষা করে।

প্রধানমন্ত্রী হতে যে-দেশের রাজনীতিকরা মুখিয়ে থাকেন, সোনিয়া সেখানে কেন তা হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছিলেন? কংগ্রেস তো বটেই, ইউপিএ-র শরিকরাও তখন সোনিয়াকে প্রধানমন্ত্রী দেখতে ব্যগ্র। দুই দশকে এ নিয়ে অনেক কথা চালাচালি হয়েছে। গান্ধী পরিবারের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ এসেছে। ‘বিদেশিনী’ চরিত্র নিয়ে সোনিয়ার অস্বস্তির কথা শোনা গিয়েছে। আলোচনা হয়েছে হিন্দি নিয়ে, সুবক্তা না-হওয়া নিয়ে। আরও অনেক যুক্তির অবতারণা হয়েছে। কিন্তু আমার বারবার মনে হয়েছে, জীবনের বেশি সময় ভারতে কাটিয়ে মনেপ্রাণে ভারতীয় হয়েও পশ্চিমি মূল্যবোধ তিনি হারিয়ে যেতে দেননি।

সেই মূল্যবোধ প্রথমেই নিজেকে চিনতে শেখায়। যোগ্যতা সম্পর্কে অবহিত করে। কতটা মুখে পুরলে চিবানো যাবে, কতটা এগনো উচিত, কোনখানে থামা প্রয়োজন সেই মাত্রাজ্ঞান ও কাণ্ডজ্ঞান উদয়ে সাহায্য করে। চিরকাল হেঁশেল সামলানো রাবড়ি দেবী মুখ্যমন্ত্রিত্ব গ্রহণে কুণ্ঠিত হননি, অথচ সোনিয়া নৈবেদ্য অস্বীকার করেন ওই পশ্চিমি মূল‌্যবোধের কারণেই। এখানেই অন্যদের চেয়ে তিনি স্বতন্ত্র। অনন্য।

ইতিহাস যে তঁার প্রতি চির সদয় থাকবে, জীবদ্দশাতেই মনমোহন সিং তা জানতেন। কিন্তু অর্থমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে মনমোহন সিংয়ের মূল্যায়নের সময় নরসিংহ রাও ও সোনিয়া গান্ধীর অবদান অনুল্লিখিত বা অনুচ্চারিত থাকলে তা নিশ্চিতই সুবিচারের পর্যায়ভুক্ত হবে না।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • অর্থনীতিবিদ থেকে রাজনীতিক হয়ে ওঠার সোপানগুলি তিনি এত সহজে ও স্বচ্ছন্দে আরোহণ করতে পারতেন না দু’জনের অকুণ্ঠ সমর্থন না পেলে।
  • ধরলেন দামনের স্বামী বিজয় তনখা। অন্যপ্রান্তে পি. সি. আলেকজান্ডার। ঘুম থেকে ডেকে তোলা মনমোহনকে তিনি বললেন, পরদিন রাষ্ট্রপতি ভবনে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণে উপস্থিত থাকতে হবে।
Advertisement