করোনার প্রথম ঢেউয়ের অভিঘাত অতিরিক্ত ২৩ কোটি ভারতীয়কে দারিদ্রসীমার নিচে নিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ আরও অনেক বেশি নিষ্ঠুর প্রতিপন্ন হয়েছে ইতিমধ্যে। গত ১৫ মাসে আমাদের দেশে দুই দশকের বৃদ্ধির হার শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে, অথচ পনেরো মাসেই, এই দেশে ৪০ জন নতুন বিলিয়নেয়ারের উত্থান ঘটেছে! লিখছেন প্রীতিশ নন্দী।
দেশের কোভিড সংকট মোকাবিলায় কেন্দ্রীয় সরকার যে যারপরনাই ব্যর্থ এবং কেবল ব্যর্থই নয়, চূড়ান্তরূপে ব্যর্থ- তা এখন সুপ্রতিষ্ঠিত। এমনকী, দুর্নীতিগ্রস্ত মিডিয়া, যারা সাধারণত সরকারের ব্যর্থতা জনসমক্ষে তুলে ধরতে খুব একটা তত্পর নয়, তাদের গলাতেও এখন উল্টোসুর। তবে, সেটা ঠিক উদাত্তভাবে বলা নয়, কুঁতকে বলা। কুঁতকে কুঁতকে তারা প্রায়শই এই স্বীকারোক্তিমূলক খবর করছে এবং তার সঙ্গে দেশের জনগণকে বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছে যে- দেশের প্রশাসন সাধ্যের বাইরে গিয়ে অন্যান্য দেশের তুলনায় সুপরিকল্পিত এবং শক্ত হাতে অতিমারী মোকাবিলা করেছে, তা সত্ত্বেও দুনিয়ার চোখে তাদের অক্ষম সাব্যস্ত করার এক বিশ্বব্যাপী ষড়যন্ত্র চলছে।
[আরও পড়ুন: ছুঁয়েছিলেন সমুদ্রের রহস্যকে! টাইটানিক ডুববে, জানতেন তিনি?]
প্রথমেই বলি, উপরোক্ত দাবি সর্বৈব মিথ্যা। ভারতকে বিশ্ব দরবারে নীচ করার কোনও দায় পড়েনি কারও। বিশ্বব্যাপী মিডিয়া কেবল আমাদের অপদার্থতার দিকে আঙুল তুলেছে। দেখিয়ে দিয়েছে- কীভাবে প্রকৃত মৃত্যুর পরিসংখ্যানকে ফাঁকি দেওয়া চলছে, যখন কিনা দেশজুড়ে দিনরাত একের পর এক চিতায় জ্বলছিল মৃতদেহের সার। সাংবাদিকতার সর্বজনীন লক্ষ্যই হল: কেউ কিছু লুকনোর চেষ্টা করছে মনে হলেই তা জনসমক্ষে পেশ করা। সেখানেই হয়তো লুকিয়ে আছে আরও বড় গল্প। এক্ষেত্রেও যেমন: এক ভয়াবহ অচলাবস্থার আখ্যান।
সরকার প্রথমে এই অভিযোগ অস্বীকার করলেও, পরবর্তীতে যখন সমস্যা একেবারে ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখন সমস্যার বৃহৎ ব্যাপ্তির উপর শুরু হল দোষারোপের পালা। দেশের বিশাল জনসংখ্যার কারণেই করোনা আবহে কাজ সুপরিকল্পিতভাবে চালনা করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল বলে দাবি করেন তাঁরা। পাশাপাশি, বিরোধী দল শাসিত রাজ্যগুলির উপরেও দোষ চাপানো চলেছে যথেচ্ছভাবে- কেন্দ্র কর্তৃক পরিকল্পনাগুলি নাকি তারা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করতে পারেনি! সমস্ত ব্যর্থতাই, তাদের দাবি, শেষ মুহূর্তের গাফিলতির ফল- পর্যাপ্ত সংখ্যায় করোনা পরীক্ষা না করতে পারার ব্যর্থতা, মুমূর্ষু রোগীর কাছে জীবনদায়ী অক্সিজেন, প্রয়োজনীয় ওষুধ পৌঁছে দিতে না পারা এবং হাসপাতালে পর্যাপ্ত বেডের জোগান না থাকার ব্যর্থতা। সবশেষে, ভ্যাকসিন থাকা সত্ত্বেও দেশের মানুষের টিকাকরণ সম্পূর্ণ না করতে পারা। আর, তদুপরি, জনাকীর্ণ হাসপাতালের বাইরে অক্সিজেনের অভাবে মানুষ যখন রোজ মারা যাচ্ছিল, তখন কেন্দ্রীয় সরকারের পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ না করার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সলিসিটর জেনারেল দিল্লি সরকারকে বলেছিলেন- ‘ছিঁচকাঁদুনে’ হওয়া বন্ধ করুন!
ব্যবসায়ীক ক্ষেত্রে যদিও পরিস্থিতিটা খানিক দোদুল্যমান। অনেক সংস্থা এই অতিমারীর আবহেও দুর্দান্ত ফল দেখিয়েছে। শেয়ারবাজারের আচরণ তো এমন যেন, কিছুই হয়নি, সব ঠিকই আছে। অন্যদিকে, লকডাউনের ফলে ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলিকে পথে নামিয়ে দিয়েছে। হকার, ভেন্ডররা অনেকদিন আগেই যাঁর যাঁর নিজের গ্রামে ফিরে গিয়েছেন। যে দেশে কোটি কোটি মানুষ ইতিমধ্যেই বেকার, সেই দেশে ১২.২ কোটিরও বেশি মানুষ করোনা আবহে চাকরি খুইয়েছেন। তঁারা তঁাদের শেষ সঞ্চয় অবলম্বন করে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে। পরিবারের পর পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি ৭.৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। ৯.৩ শতাংশ রাজস্ব ঘাটতি রয়েছে। তবুও, কৌতূহলজনকভাবে, দেশের ১০০ জন শীর্ষস্থানীয় ধনকুবেরের সম্পদ ৩৫ শতাংশ বেড়ে ১২,৯৭৮,২২ কোটি টাকায় গিয়ে দঁাড়িয়েছে! এই বাড়তি ১৩৮ মিলিয়ন অর্থ দিয়ে প্রত্যেক দরিদ্রতম ভারতীয়র হাতে ৯৪,০৪৫ টাকার চেক তুলে দেওয়া সম্ভব।
করোনার প্রথম ঢেউয়ের অভিঘাত অতিরিক্ত ২৩ কোটি ভারতীয়কে দারিদ্রসীমার নিচে নিয়ে গিয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউ আরও অনেক বেশি নিষ্ঠুর প্রতিপন্ন হয়েছে ইতিমধ্যে। গত ১৫ মাসে আমাদের দেশে দুই দশকের বৃদ্ধির হার শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে, অথচ পনেরো মাসেই, এই দেশে ৪০ জন নতুন বিলিয়নেয়ারের উত্থান ঘটেছে! কী অদ্ভুত না? আমরা ইতিমধ্যে কী হারিয়েছি, তা নিয়ে আলোচনা করার মতো অবোধ আমরা নই। একথা ঠিক, গঙ্গায় ভেসে যাওয়া কয়েকশো মৃতদেহের ছবি আমাদের চিরকাল তাড়া করে বেড়াবে। যারা এই অতিমারীর আবহে মৃত্যুকে আটকানোর পরিবর্তে বেশি সময় ব্যয় করেছে তথ্য গোপনে, তাদের প্রতিও আমাদের ক্ষোভ চিরতরের। বিশ্ব দরবারে ভারত নিজের ভাবমূর্তি হারিয়ে ফেলেছে। তবে তা শুধুমাত্র অতিমারী সংঘটিত হওয়ার কারণে নয়, কারণটা রাজনীতিবিদদের বোকামি এবং অহংকারী, অলস আমলাতন্ত্রের তৎপরতার অভাব। যে বিষয়টি আরও নিন্দনীয় তা হল, সংকটকালে যথাযথ গুরুত্ব না দেওয়া এবং সব জেনে বুঝেও ‘তালি বজাও-থালি বজাও’-এর মতো হাস্যকর কর্মসূচির অবলম্বন। অপরদিকে অবলীলায় ‘সুপার-স্প্রেডার ইভেন্ট’ পরিচালনা করার ছাড়পত্র দেওয়া। শুধুমাত্র কুম্ভমেলায় ৯১ লক্ষ মানুষ জড়ো হয়, যাদের মধ্যে অনেকেই করোনা আক্রান্ত হয়ে বাড়ি অবধি বয়ে নিয়ে গিয়েছিল এই মারণ ভাইরাসকে।
এবার সম্ভবত সময় এসেছে প্রশাসনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পুনর্বিবেচনা করার। অথবা আর কী অবশিষ্ট রয়েছে তা দেখার অপেক্ষায় দিন গোনা পড়ে থাকবে কেবল। বিষয়টা আর স্বৈরী অথবা পৌরুষ প্রদর্শনে আটকে নেই। প্রয়োজন রয়েছে ঐকমত্যের। প্রধানমন্ত্রী একজন যথেষ্ট বিচক্ষণ মানুষ। তাঁকে অবশ্যই বুঝতে হবে, সমালোচকদের চেয়ে তাঁর সমর্থকরা সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতায় বেশি ক্ষতি ডেকে আনছে। আপনি যদি টেলিভিশনে প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্রদের অথবা তাঁর অধীনে থাকা মন্ত্রী বা সাংসদ, বিধায়কদের কথা শোনেন তাহলে আপনি নিজেই আগে লজ্জিত বোধ করবেন। সাত বছর আগে আমরা যে ভারতে ভোট দিয়েছিলাম, তার সঙ্গে আজকের ভারতের কিন্তু কোনও মিল নেই।
পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন আসতে বাকি তিন বছর। এখনও পর্যাপ্ত সময় রয়েছে বৃহত্তর দায়িত্ব নেওয়ার। ঘৃণা জর্জরিত ভাষা অর্থাৎ ‘হেট রেটোরিক’ ব্যবহারে ইতি টানার। মতবিরোধের আওয়াজ শুনেও তাদের নীরব থাকার দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টার পরিবর্তে জাতীয় আলোচনায় অংশগ্রহণ করার। অসন্তুষ্ট কৃষক, অস্থির ছাত্র, কারাবন্দি সমাজকর্মী, শিক্ষাবিদ, সোশ্যাল মিডিয়ায় সমালোচক, চিন্তাবিদ– কেউই রাষ্ট্রের শত্রু নয়। এদের সুপ্ত কণ্ঠস্বর প্রতিটি রাষ্ট্রকে শুনতে হবে। এভাবেই সরকার জনগণের সঙ্গে দায়িত্ব ভাগ করে নেবে। ফলে কোনও ভুল হলেও, সেই অপরাধবোধের সম্পূর্ণ দায়ভার একা কারও উপর বর্তাবে না।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে সবচেয়ে বিস্ময়কর দিক হল, এই ভয়াবহ ট্র্যাজেডির মাঝেও আমরা খুঁজে পেলাম বহু নায়ককে। যেমন, চিকিৎক, যাঁরা অসুস্থ মুমূর্ষু রোগীদের সহায়তায় অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন, স্বাস্থ্যকর্মী যাঁরা সপ্তাহের পর সপ্তাহ বাড়ি ফিরতে পারেননি, অথচ অন্যকে বাঁচানোর তাগিদে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়েছেন প্রতিদিন। লড়াই শেষে প্রাণ হারিয়েছেন হাজারেরও বেশি সংখ্যক ফ্রন্টলাইন ওয়ার্কার, শুধুমাত্র করোনার দ্বিতীয় তরঙ্গে ইতিমধ্যেই প্রাণ হারিয়েছেন ৩০০ জন। অথচ কেন্দ্র আদালতকে জানিয়েছে, তারা কোভিডে মৃত স্বাস্থ্যকর্মীদের কোনও তথ্য বা নথি রাখেনি! কিন্তু ভাবুন, এঁরা ছিলেন বলেই আমরা আজ জীবিত! আমরা কি অম্ততপক্ষে তাঁদের নামগুলো জানতে পারি না? যদি সরকার তাঁদের পরিবারকে সমর্থন না করতে চায়, আমরা সাধারণ নাগরিকরা কি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ তাঁদের জন্য কিছু করতে পারি না?
আমরা যদি যুদ্ধে শহিদ সৈন্যদের নাম ফলকে লিখে রাখতে পারি, তবে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরাও কি অমরত্বের দাবিদার নন? এই অতিমারী তো কোনও অংশে যুদ্ধের চেয়ে কম নয়! এর কবলে এখনও পর্যন্ত যে সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, কোনও যুদ্ধেও এত প্রাণহানি হয়নি। দেশের নাগরিকরা ইতিমধ্যেই উদ্ধারকার্যে হাত লাগিয়েছে। ‘মিশেলিন’ খ্যাত ‘স্টার শেফ’ বিকাশ খান্না ম্যানহাটনে বসে ভারতের ৪ কোটির বেশি মানুষের মুখে অন্ন তুলে দিয়েছেন। কোভিডের প্রথম ঢেউয়ের সময় ১ কোটি মিলিয়ন হকার এবং তাঁদের পরিবারের কাছে প্রয়োজনীয় রেশন পৌঁছে দিয়েছেন। অভিনেতা সোনু সুদ দিন-রাত এক করে কয়েক হাজার পরিযায়ী শ্রমিকের ট্রেন ও বাসের টিকিট কেটে দিয়ে (এমনকী একবার বিমানেও) বাড়ি ফিরতে সহায়তা করেছেন। অনেক সময়ে হাসপাতালে বেড, ওষুধ, অক্সিজেন সিলিন্ডারের মতো মহার্ঘ জিনিসও মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি l
শুধুমাত্র সেলিব্রিটিদের কথা বললেই শেষ হয় না। সাধারণ মানুষও যথাসাধ্য এগিয়ে এসেছেন। মানুষ তাদের অতি প্রয়োজনীয় শেষ অবলম্বনটুকুও বৃহত্তর স্বার্থে নিয়োগ করেছে। অ্যাম্বুল্যান্স নাকচ করা মুমূর্ষু রোগীকে বহু প্রতিবেশী নিজ-উদ্যোগে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। নিজের পরিবারের সদস্যরা যখন সংক্রাম ছড়িয়ে পড়ার ভয়ে কাবু়, তখন অপরিচিত ব্যক্তি এসে সেই মৃত মানুষের জন্য প্রার্থনা করেছে, মুখাগ্নি করেছেন, কবরে নুন দিয়েছেন। এই দুর্দশার দিনে অনাথ শিশু, পরিত্যক্ত পোষ্যদের দত্তক নিয়েছেন অনেকে নিজেদের শোক উপেক্ষা করে। স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলি ঝুঁকিপ্রবণ কারাবন্দি, কাজ খুইয়ে বসে থাকা যৌনকর্মী, গৃহহীন মানুষ, একা নিরুপায় বৃদ্ধ বাবা-মায়েদের সহায়তায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে চলেছে। সকলের তরে কেউ না কেউ আছেন, সাহায্য আসবেই- এই বিশ্বাসকেই মজবুত করেছেন তাঁরা। সিস্টেম যখন সর্বৈবভাবে ব্যর্থ, আমজনতাই ত্রাতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে বারবার।
যেদিন অতিমারীর আস্ফালন থেমে যাবে, সেদিন এই মানুষগুলোর অবদানের কথা মনে রাখা হবে। যখন সাংসদ এবং বিধায়করা কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য গোমূত্র খাওয়া বা সারা গায়ে গোবর মাখার পরামর্শ দেন, যখন ঝানু-ব্যবসায়ী যিনি যোগগুরু হিসাবেও দ্বিগুণ খ্যাত, তিনি অ্যালোপ্যাথি চিকিত্সকদের বদনাম করে বিকল্প হিসাবে অপরীক্ষিত ওষুধ বিক্রি করেন এবং দরিদ্র ও অজ্ঞ ভারতীয়দের প্রতারিত করেন, যখন প্রতিষ্ঠান ইচ্ছাকৃত বিজ্ঞানকে প্রত্যাখ্যান করে, সেই সময়ে এই সাধারণ ভারতীয়দের হাতেই থাকে দেশ ও কাঙ্ক্ষিত ভারত গড়ে তোলার দায়িত্ব। বাস্তবে মানুষ যাঁদের হাতে এই দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল, তাঁরা আজ ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও পরিস্থিতি শোধরালেন না। বরং, কেবল ভোট চেয়ে গেলেন।