shono
Advertisement
Social Media

মূলস্রোতের মিডিয়ার তুলনায় সমাজমাধ্যমের শক্তি বাড়ছে?

যদিও সমাজমাধ্যমের দায় কম– ব্যবস্থাকে ঠিক পথে এনে সংস্কার করার।
Published By: Kishore GhoshPosted: 08:22 PM Sep 14, 2024Updated: 08:32 PM Sep 14, 2024

আর. জি. কর কাণ্ডের পর যে-জনজাগরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে মূলস্রোতের মিডিয়ার প্রচার বা প্রসারের তুলনায় সমাজমাধ‌্যমকে মনে হচ্ছে বেশি শক্তিশালী। আবার এ-ও ঠিক, সমাজমাধ্যমের দায় কম– ব্যবস্থাকে ঠিক পথে এনে সংস্কার করার। লিখছেন শুভময় মৈত্র

Advertisement

সংবাদ আর সমাজমাধ্যম– এই দুইয়ের মিল এবং পার্থক্য অনেক। আপাতত সংজ্ঞায় ঢুকছি না। যে মূল পার্থক্যের কথাটা বলতে হবে, তা হল, সংবাদমাধ্যম তবু দেশের কিছু নিয়ম-নীতি মেনে চলে। সে-নিয়ম আধিপত্যবাদী কিংবা বিজ্ঞাপনদাতার মতের অনুসারী হতেই পারে। অনেক ক্ষেত্রেই তার মালিকানা থাকে, বিশেষ সম্পাদকীয় ভাবনা থাকে, বিভিন্ন লুকনো সুতোর টান থাকে, যা মুনাফা এবং রাজনীতির সীমানায় কৌশলগত অবস্থান নেয়। অন্যদিকে, সমাজমাধ্যমে সেই বাধা খুবই কম। সেখানেও রাজনীতি আছে, তবে তা বেশিটাই ব্যক্তিভাবনা। ফলে, নৈরাজ্যবাদের পরিসর অধিক। সেখানেও কেউ যে মুনাফা করে না তা নয়, তবে সেই সংখ্যা খুব কম। সোজাকথায় সরকারের দখল সমাজমাধ্যমে প্রায় নেই। কেউ ভীষণ গোলমাল পাকালে, অথবা ব্যক্তিবিশেষকে ধমকানোর প্রয়োজন হলে, রাষ্ট্র তার দাঁত-নখ বের করে বইকি, তবে তাকে যে শেষ পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতে পারে– এমনটা নয়।

এখানে আবার দ্বান্দ্বিক ভাবনা বর্তমান– মানুষের পাকানো গোলমাল কখনও গণতন্ত্রের পক্ষে, কখনও বিপক্ষে। তবে, সাম্প্রতিক উদাহরণ সাপেক্ষে আর. জি. কর কাণ্ডের পর যে-জনজাগরণ দেখা যাচ্ছে, তাতে সমাজমাধ্যমের চলমানতাকে গণতন্ত্র রক্ষায় বেশ ইতিবাচক বলেই মনে হয়। এর কারণ, মানুষের মিছিলে বা প্রচারে যে ধরনের গুণগত মান প্রত্যক্ষ করা যাচ্ছে, তা অনেক ক্ষেত্রেই অনবদ্য। উদাহরণস্বরূপ, অরিজিৎ সিংয়ের যে ‘আর কবে’ গান সমাজমাধ্যমে সামনে এসেছে, তা গত কয়েক দশকের মধ্যে বাংলার গণসংগীতের জগতে খুব বেশি খুঁজে পাওয়া যাবে না। এছাড়াও, মানুষের টুকরো ব্যঙ্গবিদ্রুপ অতিক্রম করে সামনে আসছে বাঙালি মধ্যবিত্তের সুস্থ এবং উদারবাদী সাংস্কৃতিক ভাবনা।

মোটের উপর, সমাজমাধ্যম অধিকার করে থাকে রাজনীতির তীব্র থেকে তীব্রতর প্রচার, কিছু অশালীন কিন্তু আপাত আকর্ষণীয় চলছবি, রান্না বা মাছ ধরার অতিমানবিক কার্যকলাপ, যুক্তিযুক্ত বা যুক্তিহীন মজার সাড়ে বত্রিশ ভাজা। সাধারণভাবে সুস্থ সংস্কৃতি খুব যে হালে পানি পায়, এমনটা নয়। কিন্তু এখন মধ্যবিত্ত বাঙালির গর্জে ওঠার দিনে শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের
যে-স্বর, তা অনেক ক্ষেত্রেই তুলনায় সুস্পষ্ট এবং সমাজধর্মী। বহু ‘কনটেন্ট’-এ রাজনৈতিক যুক্তি এবং প্রতিযুক্তির মিশেল অনবদ্য। অর্থাৎ, সোজা কথায় সিপিআইএম, কংগ্রেস, বিজেপি, তৃণমূল আছে, কিন্তু তাকে অতিক্রম করে আপামর রাষ্ট্রশক্তি এবং আমাদের দেশের যে গোলমেলে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, তার বিরুদ্ধে প্রশ্ন উঠছে অত্যন্ত স্বচ্ছতার সঙ্গে।

আপাতত রাজ্যের দায়িত্বে তৃণমূল, ফলে তার স্বাস্থ্য বা পুলিশি ব্যবস্থায় আব্বুলিশ দিচ্ছে জনগণ। একইভাবে, কেন্দ্রে বিজেপি থাকায় সিবিআই বা উচ্চতম আদালতের বিষয়ে আলোচনায় বিজেপির দিকে আঙুল তুলছে মানুষ। সিপিআইএম-কংগ্রেস ক্ষমতায় না থাকায় কিছুটা ফুরসত পেলেও, জনগণ সুযোগ পেলে তাদের দিকেও টিকাটিপ্পনী ছুড়ে দিচ্ছে। গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি শিক্ষিত, উদারবাদী, মধ্যবিত্ত বঙ্গবাসীর যে-ধিক্কার, তা সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে সমাজমাধ্যমের চরিত্রকে বিশেষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।

কোন জায়গায় সমাজমাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ এবং কোথায় তার অসম্পূর্ণতা? এর জন্য উল্টোদিকের একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। এই অশান্ত সময়ের মধ্যেও গত সপ্তাহে দেখলাম একটি অনবদ্য নাটক, ‘উত্তরপাড়া ব্রাত্যজন’-এর প্রযোজনায় বাদল সরকার মহাশয়ের লেখা ‘হট্টমালার ওপারে’। সম্পাদনা ও নির্দেশনায় প্রখ্যাত অভিনেতা এবং নাট্যকর্মী কৃষ্ণেন্দু দেওয়ানজী। দুই চোরের গল্প, যারা পালাতে গিয়ে নদীর জলে ডুবে যায়। এরপর তারা মরল না বঁাচল, সেই ধোঁয়াশার মধ্য দিয়ে পৌঁছয় এক নতুন দেশে, যেখানে সবটাই স্বপ্নের মতো সুন্দর, সে এক সাম্যবাদের অলীক পৃথিবী। মোটকথা, সেই নাটক বলে এক দুর্নীতিমুক্ত আদর্শ সমাজের কথা। শুরুতে এবং শেষে বারবার মনে করিয়ে দেয়– ভারতে কী ভয়ানক ধনবৈষম্য! এখনকার পশ্চিমবঙ্গের নিরিখেও এই নাটককে ভিন্ন প্রাসঙ্গিকতায় ব্যাখ্যা করা যায়, তবে সে-তর্ক আপাতত শব্দসংখ্যায় সীমাবদ্ধ থাক। এই যে একঘণ্টা পার করা ঝকঝকে উপস্থাপনা, তা কিন্তু সমাজমাধ্যমের কনটেন্ট নয়, যা কিনা অল্প সময়ে বানিয়ে ফেলা যায়। অর্থাৎ, পরিশ্রম বেশি। আর প্রচার? প্রেক্ষাগৃহে বসে দেখল ৩০০ মানুষ। সমাজমাধ্যমে গলাব্যথায় গার্গলের ভিডিও দিলেও এর থেকে বেশি ভিউ।

অর্থাৎ, খুব গভীর কোনও বিষয়, যা নিয়ে আপনি অনেকটা সময় ভাববেন, তার জন্য সমাজমাধ্যম নয়। বুঝতে হবে, দীর্ঘ সময় ধরে বানানো একটি কালজয়ী চলচ্চিত্র ইউটিউবে থাকলেও, তা সমাজমাধ্যমের অংশ নয়। কিন্তু ‘সোনার কেল্লা’ থেকে ছোট্ট তিনটি ফ্রেম কেটে নিয়ে ফেলুদা, লালমোহনবাবু আর তোপসের মুখে কথা বসিয়ে এখনকার শাসককে তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ করাটা নবতম বৈদ্যুতিন মহাজগতের শক্তি। সমাজমাধ্যমের মূল অসম্পূর্ণতা তার অগভীরতায়, অন্যদিকে তার বিপুল সাফল্য প্রচার এবং প্রসারে।

সেই জায়গায় দঁাড়িয়েও এ-কথা বলতে হয় যে, আর. জি. করের ঘটনার পর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তু আকাশপাতায় সামনে এসেছে, যা এই অান্তর্জালের যুগেও বাঙালি মধ্যবিত্তের সংস্কৃতিকে পুষ্ট করে। সৃষ্টির গুণ অনেক বেশি বিচ্ছুরিত হয় রাষ্ট্রশক্তির বিপক্ষে গণতন্ত্রের মাথা তুলে দঁাড়ানোর সময়। ফলে, ঘটমান বর্তমানে সমাজমাধ্যমের যে উদারবাদী মধ্যবিত্ত বাঙালি অধ্যুষিত অংশ, তা গুণগত মান রক্ষার ক্ষেত্রে অবশ্যই নতুন ইতিহাসের সাক্ষী। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মাইনে করা অন্তর্জাল-বাহিনীকে অনেকটাই কোণঠাসা করে দিয়েছে এখনকার আন্দোলনের অদলীয় চরিত্র, যে-কৃতিত্ব নাগরিক সমাজকে দিতেই হবে।

সমাজমাধ্যমের বিপ্লব যেমন মানুষের পথ হঁাটার খবরকে খুব তাড়াতাড়ি সমব্যথীর কাছে পৌঁছে দেয়, তেমনই কিন্তু ভুল পথে হঁাটার বিষয়টিকেও অস্বীকার করলে ভুল হবে। যেহেতু সমাজমাধ্যমে প্রস্তুতি থেকে প্রচার– পুরো বিষয়টিই ঘটে যায় অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে, তাই হঁাটু ঝঁাকানো প্রতিক্রিয়াই হয় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। সত্যি তো থাকবেই, কিন্তু সমাজমাধ্যমে মিথ্যের প্রচারকেও তো অস্বীকার করা যায় না। ফলে, রাষ্ট্রশক্তি যেমন সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করতে পারে, তুমুল নৈরাজ্যবাদীদের ক্ষেত্রেও সে-পরিসর বিস্তৃত। আর, এত তাড়াতাড়ি যুক্তি এবং প্রতিযুক্তি সারিবদ্ধভাবে সামনে আসতে থাকে যে, তা অনেক সময়ই মানুষের দৃঢ় এবং দীর্ঘমেয়াদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিপন্থী।

সোজাকথায়, আর. জি. কর কাণ্ডের পর আমাদের ব্যবস্থাটা নিয়ে যে-সমস্ত প্রশ্ন উঠেছে, তাতে সার্বিকভাবে কোনও ভুল নেই। একইসঙ্গে সমাজমাধ্যমের কোনও দায় নেই সেই ব্যবস্থাকে ঠিক পথে নিয়ে যাওয়ার। তাই মন্দের দিকে সমাজমাধ্যমে ঘৃণা এবং ভয় যেমন দ্রুত সংক্রমিত হয়, উল্টোদিকে ভালবাসা আর সাহসও তেমনই। মনে রাখতে হবে, বাঙালিদের মধ্যে ‘হুমকি সংস্কৃতি’ মোটেই নতুন নয়। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা বা বাংলাদেশে রাজনৈতিক ক্ষেত্রের অনেকটাই পরিচালিত হয় হুমকির উপর ভিত্তি করে, বিশেষ করে নির্বাচনের সময়। তাই, সমাজমাধ্যমে আমরা সবাই ‘ভাল’-র দলে থাকতে চাইলেও, আদতে সে আমাদের কোন রাস্তায় নিয়ে যাবে এই বিচার আগামীতেই তোলা থাক।

সাম্প্রতিক নাগরিক সমাজের যে প্রতিবাদের প্ল্যাটফর্ম, সেখানে সমাজমাধ্যমের জবাব নেই। কিন্তু বিধিসম্মত সতর্কীকরণ মাথায় না রাখলে গণতন্ত্র পুষ্ট হওয়া কঠিন। অর্থাৎ, এই অশান্ত প্রতিবাদী সময় সমাজমাধ্যম নিয়ে আপ্লুত হলেও সতর্কতা ভুললে কিন্তু হঁাটুতে চোট লাগতে পারে।

 

(মতামত নিজস্ব)
লেখক আইএসআই কলকাতার অধ্যাপক
maitra.subhamoy@gmail.com

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

হাইলাইটস

Highlights Heading
  • এখানে আবার দ্বান্দ্বিক ভাবনা বর্তমান– মানুষের পাকানো গোলমাল কখনও গণতন্ত্রের পক্ষে, কখনও বিপক্ষে।
  • সোজাকথায়, আর. জি. কর কাণ্ডের পর আমাদের ব্যবস্থাটা নিয়ে যে-সমস্ত প্রশ্ন উঠেছে, তাতে সার্বিকভাবে কোনও ভুল নেই।
Advertisement