পরিকাঠামো নির্মাণে গাফিলতি, অর্থবরাদ্দ কমতে থাকা, লাভের হাড় জিরজিরে চেহারা ঢাকতে ভরতুকি বাড়ানো– নয়ের দশক থেকেই আস্তে আস্তে কলকাতার রাজপথে ট্রামকে ‘প্রান্তিক’ করে তোলে। যে বিপুল আবেগ ট্রামকে নিয়ে গচ্ছিত ছিল জনমানসে, তা কিন্তু ব্যবসার অঙ্কে ফুটে ওঠেনি। পরিণতি: ট্রামের বিদায়। লিখলেন অভিজিৎ সাহা।
কলকাতার ট্রাম কেবল ‘জয় রাইড’ হয়ে সীমাবদ্ধ থাকবে– সম্প্রতি এই সরকারি ঘোষণায় যথেষ্ট আলোড়ন তৈরি হয়েছে। ট্রামকে কেন্দ্র করে যে সহজাত আবেগ, অগাধ ভালবাসা ও স্মৃতিমেদুর অভিজ্ঞতার স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ লক্ষ করা যাচ্ছে, তার কিঞ্চিৎ যদি এই ধ্বস্ত গণপরিবহণ মাধ্যমটিকে অর্থনৈতিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করার ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যেত, তাহলে সম্ভবত তাকে কেবলই স্মৃতি-বন্দি হতে হত না।
আবেগসঞ্জাত অভিজ্ঞতাকে ব্যবহারিকতার স্তরে রূপান্তরিত করা সম্ভব হলে– নতুন সম্ভাবনা তৈরির অবকাশ থাকতে পারত। নাগরিক জীবনে গতির ক্রমপ্রসারিত ধারণার মধ্যে সাবেক ট্রাম ক্রমে ফিকে হয়ে উঠেছে। কলকাতার ভূতল পরিবহণ মানচিত্রে প্রায় ১৫০-উত্তীর্ণ এই ব্যতিক্রমী মাধ্যমটিকে সচল রাখার চেষ্টা যে সাম্প্রতিক অতীতে দৃশ্যমান হয়নি, তা তো নয়। তবে বাতানুকূল কামরায় আরামপ্রদ যাত্রার হাতছানিও ট্রামে যাত্রী পরিষেবার ছবিটা বিশেষ বদলাতে পারেনি। লক্ষণীয়, লাভজনক মাধ্যম হিসাবে ট্রাম-শিল্পকে তুলে ধরা বা দীর্ঘমেয়াদি নগর পরিকল্পনায় একে সচল রাখার সদিচ্ছায় উল্লেখযোগ্য ঘাটতি গত শতকের শেষ দুই
দশকে দৃশ্যমান হতে শুরু করে।
স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে ট্রামভাড়া বৃদ্ধির সামান্য প্রচেষ্টাকে গণ-প্রতিরোধ ও হিংসার মধ্য দিয়ে বারবার প্রতিহত করা হয়েছিল। বিক্ষোভের নামে এই ভারী ও মূল্যবান শিল্পের উপর আঘাত নেমে এসেছে, অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে একাধিকবার। ট্রামের মতো গণ-পরিবহণের বিকাশ যাতায়াতের স্বাচ্ছন্দ্য ও কলকাতার সার্বিক উন্নয়নের প্রশ্নটির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত হওয়া সত্ত্বেও এর ভাড়াবৃদ্ধির ইস্যুটিকে বারবার নেপথ্যের সারিতে রাখা হয়েছিল। স্বভাবতই মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পরিষেবার ব্যয় বাড়লেও, আয় বাড়েনি। উপরন্তু, ১৯৬৭ সালে ট্রাম কোম্পানির পরিচালনা ভারগ্রহণের পর থেকে বিশাল সংখ্যক কর্মীর দায়ভার চলে আসে রাজ্য সরকারের কঁাধে। প্রসঙ্গত বলা প্রয়োজন, বাম-জামানায় ট্রামকর্মীদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের দিকটি যেভাবে গুরুত্ব পেয়েছিল; অনুরূপভাবে ট্রাম-শিল্পের সম্ভাবনার ক্ষেত্রটি অগ্রাধিকার পায়নি।
১৯৮০-’৮১ থেকে ১৯৮৯-’৯০ সময়সীমায় এই শিল্পকে সচল রাখতে রাজ্য সরকার গড়ে বার্ষিক সাড়ে ৯ কোটি টাকা ভরতুকি দিয়েছিল। দীর্ঘমেয়াদি ভরতুকি প্রদানের প্রচেষ্টা আপাতভাবে সরকারের জনমোহিনী ভাবমূর্তির পরিচায়ক হলেও শিল্পের সংকট দূর করতে বা তাকে লাভজনক মাধ্যমে রূপান্তরিত করতে ফলপ্রসূ হয়নি। ট্রামের ক্ষেত্রেও তা খুব স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।
ট্রাম-শিল্পে প্রয়োজনীয় লগ্নির অভাব এই শিল্পকে দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মুখোমুখি দঁাড় করিয়েছিল। তাৎপর্যপূর্ণভাবে আটের দশক থেকে ভূতল পরিবহণ ব্যবস্থায় ট্রাম যে ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ছিল, তার পিছনে তদানীন্তন সরকারের অবহেলা বিশেষভাবে দায়ী ছিল। ট্রামের বিভিন্ন ছোট-বড় পরিষেবাগত ক্ষেত্রের কাজে ট্রাম কোম্পানির নিজস্ব কর্মীদের ব্যতিরেকে কন্ট্র্যাক্টরি প্রথার মাধ্যমে কাজ করিয়ে নেওয়া, গড়িয়াহাট মোড় ও বালিগঞ্জের মধ্যবর্তী অংশের পাশাপাশি টেন্ডার দিয়ে প্রায় ১১টি জায়গায় সংরক্ষিত পথের অবলুপ্তি ঘটানো, চালু ট্রামগুলিকে অকেজো করে ডিপোগুলিকে জঞ্জালের স্তূপে পরিণত করা, যাত্রী-স্বার্থ গৌণ রেখে কোম্পানির ক্যান্টিনে উদারহস্তে ভরতুকি প্রদান, বিপুল সম্ভাবনার অঁাতুড়ঘর হওয়া সত্ত্বেও নোনাপুকুর ওয়ার্কশপকে যথোপযুক্তভাবে ব্যবহারে ক্ষেত্রে সদিচ্ছাগত অভাব– এই শিল্পের ক্রমিক অবনমনকে তরান্বিত করে। পাশাপাশি, উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতির অভাবে নিয়মিতভাবে ট্রামের লাইনচ্যুতি, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, তার ছিঁড়ে যাওয়া, নানাবিধ দুর্ঘটনা– যাত্রী পরিষেবার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল। দ্রুত, ঝঞ্ঝাটমুক্ত ও সহজ চলাচলের ‘বিকল্প’ মাধ্যম হিসাবে মেট্রো ও বাসের জনপ্রিয়তা ক্রমে বাড়তে শুরু করে। ১৯৬৩ সালেও যেখানে রোজ গড়ে ৪০৯টি ট্রাম শহরে পরিষেবা দিত, ১৯৯১-’৯২ সালে সেই সংখ্যাটা নেমে আসে ২২৫-এ।
লক্ষণীয়, বিশ্বব্যাঙ্কের ঋণ আসা বন্ধ হলে ট্রাম হয়ে উঠেছিল বাম সরকারের কাছে কেবলই ‘প্রাগৈতিহাসিক পদার্থ’। সাতের দশক থেকে শ্যামবাজার-দক্ষিণেশ্বর ভায়া ডানলপ; শ্যামবাজার-যশোর রোড; মৌলালি-পার্ক সার্কাস-সহ একাধিক রুটে ট্রামকে সম্প্রসারিত করার প্রস্তাবনা উঠে এসেছিল। তবে, কেবলমাত্র দু’টি রুটে যথাক্রমে মানিকতলা ও বিধাননগর স্টেশনের মধ্যে (১৯৮৫) এবং বেহালা থেকে জোকা পর্যন্ত (১৯৮৬) ট্রাম রুটের সম্প্রসারণ করা হয়েছিল। বৈষ্ণবঘাটা-পাটুলির মতো নতুন টাউনশিপকে ট্রাম লাইনে সংযুক্ত করার মত উঠে এলেও, তা রূপায়িত হয়নি।
কলকাতার পরিবর্তমান স্থানিকতা ও জনচাহিদার নিরিখে ট্রাম রুটের যে-মাত্রায় সম্প্রসারণ হওয়া প্রয়োজন ছিল, তা-ও হয়নি। ১৯৮৭ সালে তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু স্বয়ং ট্রাম সম্প্রসারণের বিপক্ষে মত রেখেছিলেন। যার মধ্য দিয়ে নতুন রুটে ট্রামের সম্প্রসারণ, বা নতুন গাড়ির সংখ্যা বাড়ানোর উদ্যোগ কার্যত মুখ থুবড়ে পড়ে। বস্তুত, পূর্ব ভারতের অন্যতম শিল্প ও বাণিজ্যকেন্দ্র হওয়ার সুবাদে ইতিমধ্যে কলকাতার আর্থ-সামাজিক গুরুত্ব যথেষ্ট বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। ১৯৮৬ সালে কলকাতা নগর পরিবহণ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলে, রাজ্য সরকার কর্তৃক পরিবেশিত কলকাতার ভবিষ্যৎ নগর পরিকল্পনার রূপরেখায়, এই শহরের জনস্ফীতির আগাম পূর্বাভাস পাওয়া গিয়েছিল। এর সঙ্গে সাযুজ্য রেখে প্রয়োজন ছিল একটি অত্যাধুনিক, দীর্ঘমেয়াদি ও বহুমুখী পরিবহণ পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনার বৃহত্তর ক্যানভাসে ট্রামের কার্যকারিতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও পরিকাঠামো নির্মাণ, কারিগরি উন্নয়ন, অথবা টাইম টেবিলের বিন্যাসের কোনও চেষ্টা অন্তত লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকী, পরিষেবাকে পরিবর্তিত সময়ের নিরিখে যাত্রী সাধারণের কাছে অর্থবহ ও আকর্ষণীয় করে তোলারও উদ্যোগ কার্যত অনুপস্থিত ছিল সর্বস্তরে।
কেবলই আর্থিক ভরতুকি দিয়ে ট্রামের মতো একটি লাভজনক মাধ্যমকে ক্রমশ সংকোচনের পথে ঠেলে দেওয়া হয়। ১৯৯২ সালে তদানীন্তন পরিবহণ মন্ত্রী শ্যামল চক্রবর্তীর প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী, ১৯৯১-’৯২ সালে ট্রাম কোম্পানির আয় দঁাড়ায় সাড়ে ১০ কোটি, আর ব্যয় হয়েছিল ৩৫.২৫ কোটি টাকা। এমনকী, ঋণখাতে সুদ দিতে হয় প্রায় ২ কোটি টাকা। তিনি এ-ও জানান যে, এইভাবে চলতে থাকলে ট্রাম শিল্পের ‘স্বাভাবিক মৃত্যু অনিবার্য’। ট্রাম-শিল্পে ১৯৯২-’৯৩ অর্থবর্ষে আর্থিক ঘাটতির পরিমাণ দঁাড়ায় প্রায় ২৬ কোটি ৭৫ লক্ষ টাকা। তাৎপর্যপূর্ণভাবে, পূর্ববর্তী দশক থেকে ধীরে-ধীরে এর উপর থেকে আর্থিক ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণও সংকুচিত হতে শুরু করেছিল।
১৯৮৭-’৮৮ অর্থবর্ষে ব্যয়বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১১.২০ কোটি টাকা, ১৯৯১-’৯২ অর্থবর্ষে তা দঁাড়ায় ৪ কোটি টাকায়, আর ১৯৯২-’৯৩ অর্থবর্ষে ট্রাম-শিল্পের জন্য বরাদ্দ হয় সর্বসাকুল্যে ৬৭ লক্ষ টাকা। শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন, অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, বিদ্যুতের বর্ধিত মাশুল, ইস্পাতের মূল্যবৃদ্ধি-সহ শিল্প ব্যবস্থাপনার সার্বিক লোকসান ট্রাম পরিষেবার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটে শহুরে জীবনের সঙ্গে ট্রামের তারও আলগা হতে শুরু করে।
স্মর্তব্য, নয়ের দশকটি ভারতীয় অর্থনীতির ক্ষেত্রে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ একটি দশক।উদারীকরণের ধাক্কায় বাজার, লেনদেন, আর্থিক বিনিয়োগের সাবেক ধারণায় যেমন লক্ষণীয় বঁাকবদল ঘটতে শুরু করেছিল, তেমনই সাধারণ ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার প্রশ্নটিও এই সময় বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। সাধারণ জনজীবনের ক্ষেত্রে আবার যথাযথ পরিষেবা প্রাপ্তির প্রশ্নটিও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৯২ সালে ট্রাম-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক কর্মচারীদের দিয়ে বাস চালানোর পরিকল্পনা, এমনকী, ১৯৯৪ সালে হাওড়া ব্রিজ থেকে ট্রাম তুলে দেওয়ার ঘটনা– এই প্রেক্ষাপটে বিশেষ ইঙ্গিতবাহী। বলা বাহুল্য, এইভাবে আদতে পর্যায়ক্রমিকভাবে ট্রাম-শিল্পের সংকোচন নীতি গৃহীত হয়। ট্রামের মতো একটি সচল যানকে খুব পরিকল্পিতভাবে ও ধীরে-ধীরে রাজপথে প্রান্তিক করে দেওয়া হয়েছে পূর্ববর্তী সরকারের আমলে। এভাবে ট্রাম ক্রমশ নির্ভরতার জায়গা থেকেও কিন্তু পিছনের সারিতে সরে গিয়েছিল।
এখন কলকাতায় যান ও জনবিস্তারের পরিবর্তমান চালচিত্র, মুক্ত পরিসরের ক্রম সংকোচন, পার্কিং সমস্যা, ট্রামলাইন বরাবর হকার ও ফুটপাতবাসীদের যাপনের বিস্তার, অব্যবহৃত ট্রামলাইনে দুর্ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি, মেট্রো ও বৈদ্যুতিন বাসের মতো পরিবেশবান্ধব ‘বিকল্প’ যানের দ্রুত বিস্তার নগর পরিকল্পনায় যে নতুন স্থানিকতার সংযোজন ঘটিয়েছে, তার পরিবর্তন সহজ নয়।
এই প্রেক্ষাপটে ব্যবহারিক প্রয়োজনের নিরিখে ট্রাম পরিবহনকে বিবেচনা করা বা দৈনন্দিন সুযোগ-সুবিধার প্রশ্নে এর প্রাসঙ্গিকতার মূল্যায়ন করা খুব জরুরি। শহর ও তার রাস্তাঘাটের পরিকাঠামো খোলনলচে বদলে ট্রামোপযোগী পরিকাঠামোর পুনর্নির্মাণের ক্ষেত্রে চাহিদা-জোগানের যে ভারাসাম্য প্রয়োজন, আবেগসঞ্জাত উদ্দীপনা কি সেই সাধারণ প্রশ্নটিকে সম্বোধন করতে পারছে?
(মতামত নিজস্ব)